পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্টের নারকীয় হামলা থেকে শুরু করে পরবর্তী কয়েকদিনে রাজনীতির মাঠে ও সশস্ত্র বাহিনীতে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে সিআইএ এবং ঢাকাস্থ আমেরিকান দূতাবাসের প্রকাশ হওয়া বিভিন্ন নথি থেকে অনুবাদ নিয়েই তথ্যমূলক এই সিরিজে। কয়েক বছর আগে দূতাবাসের তারবার্তাগুলো প্রকাশ করে উইকিলিকস। আর সিআইএ’র ফাইলগুলো ইন্টারনেটে উন্মুক্ত করা শুরু হয় গত বছরের ডিসেম্বর থেকে। আজকের পর্বে থাকছে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্রে মার্কিন কর্মকর্তাদের ভূমিকা নিয়ে ঢাকা ও দিল্লী থেকে ওয়াশিংটনে পাঠানো গোপন তারবার্তার সংকলন।
বঙ্গবন্ধুর খুনীদের সাথে তৎকালীন আমেরিকান রাষ্ট্রদূতের যোগাযোগ এবং ওয়াশিংটনে পাঠানো গোপন বার্তায় মুজিবের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করা, বাকশাল কায়েমের পর মুজিবকে স্বৈরাচার ও জনবিচ্ছিন্ন নেতা বলা এবং তাকে হত্যার পর বেশি আন্তরিক ও পশিমাঘেঁষা মোশতাক সরকারকে দ্রুত স্বীকৃতি দেয়া ইত্যাদি কারনে অনেকেরই ধারণা আমেরিকান দূতাবাসের কর্মকর্তারা ষড়যন্ত্রের বিষয়ে সবই জানতো, কিন্তু তা প্রতিহত করতে কোন ব্যবস্থা নেয়নি।
একবার তো শেখ হাসিনা রাষ্ট্রদূতকে জিজ্ঞেস করেই বসেন যে তাদের সরকার কোন কারনে তাকে বা তার দলকে অপছন্দ করে কিনা। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন বাংলাদেশের জনগণ, বিশেষ করে তার দলের অনেক নেতাই মনে করেন আমেরিকা তাকে বা তার দলকে ক্ষমতায় আসতে দেওয়ার ঘোর বিরোধী।
রাষ্ট্রদূত অবশ্য বুঝতে পারেননি শেখ হাসিনা নিজেও এমনটি মনে করেন কিনা।
১৯৯১ সালের ১০ই জুলাই – বিএনপি ক্ষমতায় আসার চার মাস পর – রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম ব্রায়ান্ট মিলমের সাথে বিশেষ সেই বৈঠকে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা আরো বলেন আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মীর ধারণা পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্ট সেনাঅভ্যুত্থানে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সাথে আমেরিকা কোন না কোনভাবে জড়িত ছিল।
তবে তার নিজের ধারণা কি ছিল তা এড়িয়ে যান।
তিনি বলেন এমন অবস্থায় আশির দশকে আমেরিকা সফর করাটা তার জন্য একটা বড় ঝুঁকি হয়ে দেখা দেয়। এ নিয়ে দলের বিভিন্ন স্তরে অনেকেই তার সমালোচনা করে। তবে এদের সংখ্যা খুব বেশি নয়।
শেখ হাসিনা মনে করেন হত্যাকান্ডের পরপর আমেরিকার উচিৎ ছিল অভিযোগগুলো গুরুত্বের সাথে দেখা এবং ভুল প্রমাণিত করা। তবে এ বিষয়ে বাংলাদেশের জনগণকে আস্থায় আনার সুযোগ এখনো আছে।
বৈঠকে রাষ্ট্রদূত দাবী করেন আমেরিকা কোন দেশে কোন বিশেষ দলের প্রতি সমর্থন জানায় না, বরং জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সব সরকারের সাথেই আন্তরিকভাবে কাজ করে। এমনকি তারা কোন দলের সব কর্মসূচীর সাথেও একমত নয়।
এর একদিন পর, ১১ই জুলাই ওয়াশিংটনে পাঠানো গোপন তারবার্তায় মিলম লেখেন, দুই ঘন্টার সেই বৈঠকে বিভিন্ন বিষয়ে শেখ হাসিনার প্রাণখোলা কথাবার্তা শুনে মনে হয়েছে তিনি দূতাবাস ও আমেরিকান সরকারের কাছে নিজের ও দলের ভাবমূর্তি আরো ভালো করতে চান।
উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমেরিকা পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষ নেয়। তাদের ঢাকাস্থ দূতাবাসের কর্মকর্তারা ১৯৭২ সাল থেকেই বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী ও ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে। তাছাড়া ১৯৭৫ সালের শুরু থেকে কয়েকবার ওয়াশিংটনে পাঠানো গোপনবার্তায় সম্ভাব্য সেনা অভ্যুত্থান সম্পর্কে আশংকা প্রকাশ করেন রাষ্ট্রদূত ডেভিস বোস্টার। কিন্তু সেসব তথ্য তিনি বঙ্গবন্ধুকে দেননি।
পরিকল্পনামাফিক বঙ্গবন্ধু নিহত হবার পরপর খুনীদের ক্রীড়ানক খন্দকার মোশতাকের সরকারকে আমেরিকা স্বীকৃতি দেয় এবং বাংলাদেশে তাদের সকল কর্মকান্ড চালু রাখার ঘোষণা দেয়; এমনকি নভেম্বরে খুনী ফারুক-রশীদকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে আগ্রহ দেখায় আমেরিকা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর থেকে নভেম্বরের মধ্যে জিয়া-ফারুক-রশীদ রাষ্ট্রদূত ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের সাথে দেখা করে সামরিক সহায়তার জন্য অনুরোধ করে, যা ওয়াশিংটনকে বিবেচনা করার জন্য বোস্টার সুপারিশ করে।
১৮ই আগস্ট নয়াদিল্লীতে আয়োজিত এক শোকসভায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তার বার্তায় বঙ্গবন্ধুকে মহান নেতা ও রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি বলেন ভারতের জনগণ বঙ্গবন্ধুকে তাদের একজন বন্ধু হিসেবে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে।
সভায় উপস্থিত ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিআই) সাংসদ ভূপেশ গুপ্ত বলেন আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও সিআইএ’র সমর্থনপুষ্টরাই মুজিবকে খুন করেছে।
একই দলের আরেক নেতা রমেশ চন্দ্র এপ্রিলে বাংলাদেশ সফরের সময় তিনি সেখানে অনেক সিআইএ’র এজেন্টকে দেখেছেন যারা উন্নয়ন-সহযোগী সংস্থাগুলোর হয়ে কাজ করছে। এই তথ্য মুজিবকে দেয়া হলে তিনি বলেন তিনি এসব কর্মকান্ডের কথা জানেন।
এছাড়া কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রাজেশ্বর রাও, কংগ্রেস সাংসদ সাত পাল কাপুর ও ভায়লার রবিও দাবী করেন ১৫ই আগস্টের সেনাঅভ্যুত্থানে সিআইএ জড়িত ছিল।
ভারতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত এই খবর ওয়াশিংটনকে জানায় নয়াদিল্লীতে নিযুক্ত আমেরিকান রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম সাক্সবে।
অন্যদিকে কলকাতায় কংগ্রেসের এক সভায় প্রিয়রঞ্জন দাশ মুন্সি বলেন মুজিব হত্যা আবারো প্রমাণ করলো এই উপমহাদেশে আমেরিকা ও চীন কতটা তৎপর।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকে ভারতের মিডিয়াতে একের পর এক এধরনের বক্তব্য ছাপা হওয়ার প্রেক্ষিতে নয়াদিল্লীর আমেরিকান দূতাবাস চিন্তিত হয়ে পড়ে এবং মিডিয়ার উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে সরকারকে আহ্বান জানায়। তবে সরকার এ বিষয়ে কোন ব্যবস্থা নিতে অস্বীকৃতি জানায়।
আটই সেপ্টেম্বর কলকাতার কনসুলার অফিসের কর্মকর্তা কর্নের সাথে আলাপ করছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যসচিব অশোক গুপ্ত। বললেন বাংলাদেশের পরিস্থিতি শান্ত হলেও মোশতাক সরকারের পরিণতি কি হবে বলা যাচ্ছে না। সেনাবাহিনির একটা অংশ শেখ মুজিবের হত্যাকারী সেনা কর্মকর্তাদের বিচার দাবী করছে। তাই যদি ঘটে, সেক্ষেত্রে মোশতাকেরও বিচার হবে।
অশোক বলেন তার ধারণা সরকার পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতন-নিপীড়ন বাড়বে। ফলে একাত্তর সালের মতো পশ্চিমবঙ্গকে আবারো একবার উদ্বাস্তু সমস্যা সামাল দিতে হবে।
এর আগে ৬ই সেপ্টেম্বর আমেরিকান দূতাবাসের এক কর্মকর্তার সাথে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা নিলু সেনের সাক্ষাৎ হয়, যিনি বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেনের ভাই এবং দূতাবাসের একজন নির্ভরযোগ্য সূত্র।
নিলু সেন বলেন মুজিবের বিকল্প খুঁজে পেতে খুনী সেনা কর্মকর্তাদের অনেক বেগ পেতে হয়েছে। মোশতাকের আগে তারা চার থেকে পাঁচজনকে রাষ্ট্রপতি পদ দেওয়ার প্রস্তাব করেছিল। এক পর্যায়ে নিলু সেন বলেন, “বাজী ধরে বলতে পারি, মোশতাক সরকার বেশিদিন টিকবে না।”
বোস্টার স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম আমেরিকান রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পান ১৯৭৪ সালে। এরপর ১৯৭৬ থেকে ১৯৭৯ পর্যন্ত গুয়াতেমালায় রাষ্ট্রদূতের পদে বহাল ছিলেন। ২০০৫ সালের ৭ই জুলাই হার্ট এটাকে মারা যান তিনি।
নভেম্বরের জেল হত্যা, সেনাবাহিনীতে আবার অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থান আর মোশতাকের পতনের পর জেনারেল জিয়া ক্ষমতা দখল করলে মুজিব হত্যায় জিয়া, পাকিস্তান ও আমেরিকার ভূমিকা নিয়ে আবারো গুঞ্জন শুরু হয়।
সে সময় ভারতীয় কংগ্রেসের বাংলা পত্রিকা যুগান্তরের ১৮ই নভেম্বর সংখ্যার প্রথম পাতায় বোস্টারকে নিয়ে একটি প্রবন্ধ ছাপা হয়; শিরোনাম ছিল ‘চিলির মূল হোতা এখন ঢাকায়’। পাঠকদের কাছে তাকে অন্যরূপে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। এবারেও প্রতিবাদ জানালো নয়াদিল্লীর আমেরিকান রাষ্ট্রদূত।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকায় দায়িত্ব পান বোস্টার। পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ বছর বয়স হবে। তিনি সবসময়ই ব্যস্ত; একটা আটাচি কেস নিয়ে ঘোরেন, কখনো ভুলেও ফেলে যান না। অনেকদিন ধরে তাকে সেনানিবাসসহ ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় দেখা গেছে। সাংবাদিকদের নিয়ে নিয়মিত ডিনার; কখনো বা সেনা কর্মকর্তাদের নিয়ে। মুজিব হত্যার পর জেল হত্যা ও জিয়ার ক্ষমতা দখল; বোস্টার এখন ব্যস্ত জিয়ার বলয়ের লোকদের নিয়ে। তিনি কি এই অবস্থায় একটি বিশেষ ভূমিকা নিতে পারতেন না? উত্তরটা হয়তো দীর্ঘ হবে। কিন্তু এটাই সত্য যে, ১৯৭৩ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর চিলির সেনাবাহিনী যখন রাষ্ট্রপতি সালভাদর এল্যান্ডেকে হত্যা করে তখন সেখানকার আমেরিকান দূতাবাসের চার্জ দ্য এফেয়ার্স ছিলেন বোস্টার।