এগিয়ে চলো এক্সক্লুসিভ

মুজিবের চেয়ে মোশতাক সরকার বেশি আন্তরিক!

7 / 8

মুজিবের চেয়ে মোশতাক সরকার বেশি আন্তরিক!

মুজিবের চেয়ে মোশতাক সরকার বেশি আন্তরিক!
  • পড়তে সময় লাগবে মিনিট
  • পড়তে সময় লাগবে মিনিট

ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্টের নারকীয় হামলা থেকে শুরু করে পরবর্তী কয়েকদিনে রাজনীতির মাঠে ও সশস্ত্র বাহিনীতে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে সিআইএ এবং ঢাকাস্থ আমেরিকান দূতাবাসের প্রকাশ হওয়া বিভিন্ন নথি থেকে অনুবাদ থাকবে তথ্যমূলক এই সিরিজে। কয়েক বছর আগে দূতাবাসের তারবার্তাগুলো প্রকাশ করে উইকিলিকস। আর সিআইএ’র ফাইলগুলো উন্মুক্ত করা শুরু হয় গত বছরের ডিসেম্বর থেকে।

নোটঃ কোন এক রহস্যময় কারনে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কয়েকদিন আগের কোন তারবার্তা বা সিআইএ’র প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। তাছাড়া ১৫ই ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রদূত ডেভিস ইউজিন বোস্টারের পাঠানো একটি গুরুত্বপূর্ণ তারবার্তার (Bangladesh: Mujib's dictatorial powers may invite his ouster) মূল বার্তাটি পাওয়া যায়নি। এই বার্তায় স্পষ্টতঃই একটি অভ্যুত্থানের আশংকার কথা বলা হয়েছিল। আর ৪ঠা ফেব্রুয়ারি পাঠানো বার্তায় মুজিবকে মোঘল সম্রাটের সাথে তুলনা দেন বোস্টার। আরেকটি তারবার্তায় জানা যায় ২১শে মে ঢাকায় ফেরার পথে বঙ্গবন্ধুর উপর গ্রেনেড হামলা হলে তিনি বেঁচে যান, তবে তার দুই সফরসঙ্গী আহত হন। কারা, ঠিক কোথায় সেই হামলা করেছিল তা এখনো জানা যায়নি।

প্রাথমিক তথ্য

পনেরই আগস্ট ভোরে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যসহ ১১ জনকে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনির ধানমন্ডির বাড়িতেও হামলা চালায় সেনা সদস্যরা; খুন করে মনি ও তার অন্তঃসত্তা স্ত্রী আরজু মনিকে। আর মিন্টু রোডে আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তাকে হত্যা এবং তার দুই সন্তানসহ মোট চারজনকে হত্যা করে ঘাতকরা।

স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে নৃশংসতম এই সেনা অভ্যুত্থানে অংশ নেয়া খুনিদের অন্যতম মেজর ডালিম বাংলাদেশ বেতারের শাহবাগস্থ ঢাকা আঞ্চলিক কেন্দ্র থেকে খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের বিষয়টি নিশ্চিত করে এবং কারফিউ ঘোষণা করে। বিডিআর এবং রক্ষীবাহিনীকে বলা হয় সেনাবাহিনীকে সহযোগীতা করতে।

রাষ্ট্রদূত বোস্টার বঙ্গবন্ধু হত্যার বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে ওয়াশিংটনে তারবার্তা পাঠান দুপুর ১:২০-এ। তিনি জানান যে, ঢাকার সেনানিবাস ও ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের আশেপাশে বিপুল পরিমান ট্যাংক অবস্থান করছিল। তবে দূতাবাসের উপর হামলার কোন ঝুঁকি ছিল না।

একদিন পর

পরদিন সকাল ৯:১০ মিনিটে অভ্যুত্থানপরবর্তী ঘটনাক্রম বিস্তারিত বর্ণনা করে ওয়াশিংটনে একটি গোপন তারবার্তা পাঠান বোস্টার। সাথে নতুন সরকার ও সেনাবাহিনীর মনোভাব নিয়ে তার পর্যবেক্ষণ জানান – যা উৎসুক পাঠকের চিন্তার খোরাক জোগাবে। বার্তাটি তিনি স্টেট ডিপার্টমেন্ট ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান ও নেপাল দূতাবাস এবং ইউএস পেসিফিক কমান্ডের প্রধানের কাছে পাঠান।

বোস্টার বলেন, প্রথম চব্বিশ ঘন্টার ঘটনাক্রম দেখে মনে হচ্ছে পাল্টা কোন অভ্যুত্থান ঘটবে না। শপথ গ্রহণের মাধ্যমে মন্ত্রীপরিষদ, সশস্ত্র বাহিনী, রাইফেলস, রক্ষীবাহিনী ও পুলিশ প্রধান মোশতাক সরকারের প্রতি আস্থা জানিয়েছে।

জনগণ উল্লাস প্রকাশ না করলেও অনেকেই হয়তো স্বস্তি বোধ করছেন, কেউ কেউ বা চুপচাপ মেনে নিয়েছেন। এত সহজে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া দেখে মনে হচ্ছে মুজিব জনগণের থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন কারণ তিনি তাদের আশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছিলেন, পরিবারকেন্দ্রীক ও স্বেচ্ছাচারী রাজনীতির জন্য তিনি অনেক বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। অবিশ্বাস করতেন বলে তার একসময়কার সবচেয়ে দক্ষ পরামর্শকরা দূরে সরে গেল; তিনি আরো স্বৈরাচারী হয়ে উঠেন।

অভ্যুত্থানকারীরা হয়তো দুটি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে ভেবেছিল আর দেরী করা ঠিক হবেনা – ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে জুন মাস থেকে মুজিবের বিভিন্ন পদক্ষেপ এবং তার ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনির ক্রমাগত বাড়তে থাকা প্রভাব। আর ভারতের স্বাধীনতা দিবসের দিনটিকে বেছে নেয়াটা হয়তো কাকতালীয় হতে পারে, তবে সেটাও আমরা আমলে নিয়েছি।

মোশতাকের সরকার হয়তো টিকে যাবে তবে সেক্ষেত্রে প্রচুর সংস্কারমূলক পদক্ষেপ দেখা যাবে। ক্ষমতা গ্রহণের পর রেডিওতে দেয়া তার ভাষণে মোশতাক জানিয়েছে বিদেশীদের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ও ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিকভাবেই চলবে।

এরই মধ্যে বোঝা যাচ্ছে মোশতাক পাকিস্তানসহ মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করবে। অন্যদিকে ভারতের উপর নির্ভরতা থেকে বের হয়ে আসবে। তাছাড়া মোশতাক বলেছে আমেরিকা, সোভিয়েত রাশিয়া ও চীনসহ বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলোর সাথে সে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখবে। তার মানে বিদেশীদের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারসাম্য আনার জন্য কাজ করবে এই সরকার। ফলে সোভিয়েত রাশিয়ার প্রভাব কিছুটা কমবে।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে নতুন সরকারের সাথে আমেরিকার সম্পর্ক আরো আন্তরিক হবে; মুজিবের আমলের চেয়েও বেশি। নতুন রাষ্ট্রপতি এর আগে অনেকবার উচ্ছ্বাসিতভাবে তার আমেরিকাপ্রীতি প্রকাশ করেছে; তাছাড়া দলে এখন আর আগের বামপন্থী ও আমেরিকা-বিদ্বেষীরা নেই। এমনও সম্ভাবনা আছে যে মোশতাক সরকার আমাদের কাছ থেকে আরো অনেক ত্রাণ সহায়তা চাইবে। সে আগেও আমাদের বলেছে একমাত্র আমেরিকাই পারে বাংলাদেশকে সত্যিকারভাবে সাহায্য করতে।

রাষ্ট্রদূত বলেন, মোশতাক সরকারের সাথে সেনাবাহিনীর সম্পর্ক কতটা নিবিড় তা এখনো বোঝা যাচ্ছে না। তবে প্রতিটি সরকারি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে ক্ষমতার পালাবদলে সেনাবাহিনীর ভূমিকার কথা স্পষ্ট করে বলা হচ্ছে। আমাদের বলা হয়েছে সেনাবাহিনী এখন মার্শাল ল’র আদেশ তৈরি করছে। এখন যদি পাকিস্তানি কায়দায় দেশ চালানো হয়, তবে এটাই হবে দেশের মূল আইন।

এতে করে সাময়িকভাবে জনগণের সাথে সেনাবাহিনীর একটা দ্বন্দ্ব তৈরি হতে পারে; তবে মোশতাক ইতিমধ্যে সংবিধান সংশোধনের ঈঙ্গিত দেয়ার মাধ্যমে একটি উদার রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরির কথা বলেছে।

সফলভাবে মুজিবকে উৎখাতের পর এখন মনে হচ্ছে, অভ্যুত্থানকারীরা পরের করনীয় নিয়ে বিশেষ কিছু ভাবেনি। তবে একবার যেহেতু রক্তের স্বাদ পেয়েছে, তারা এখন ক্ষমতার কেন্দ্রে থেকে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করবে। তারা এখনো এমন কোন বক্তব্য বা সিদ্ধান্ত দেয়নি যা মুজিবের আমলের থেকে খুব বেশি ভিন্ন। ফলে, আমি অবাক হবো না যদি দেখা যায় এই অভ্যুত্থানের পরিকল্পনার পেছনে আসলে খুব কম সংখ্যক ব্যক্তি জড়িত। যে কারনে তারা নতুন সরকারের রূপরেখা ও বিস্তারিত পরিকল্পনা তৈরি করোতে পারেনি।

সরকার যদি জনগণের অবস্থা পরিবর্তনে স্বদিচ্ছা প্রমাণ করোতে না পারে, তবে এই মুহুর্তে তারা যতটুকু প্রাধান্য পাচ্ছে তাও নিঃশেষ হয়ে যাবে। পাশাপাশি আমাদের আরেকটা ক্ষমতার লড়াই দেখতে হতে পারে।

বাঙালি রাজনীতিবদদের মধ্যে এখন এমন কেউ নেই যে কিনা শেখ মুজিবের মতো নেতৃত্ব দিয়ে বেশিদিন ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবে। ফলে বেসামরিক সরকার ব্যর্থ হলে সেনাবাহিনী হয়তো ভাবতে পারে এই জাতিকে তারাই আরেকবার বাঁচাতে পারে।

মোশতাকের কিছু পদক্ষেপ

বাইশে আগস্ট পাঠানো এক তারবার্তায় বোস্টার জানায় শেখ মুজিবকে হত্যার এক সপ্তাহ পর আইনশৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে থাকলেও জনগণের মধ্যে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসেনি। 

  • ঘটনার পর পর সাময়িকভাবে মার্শাল ল আরোপ করা হয়; কিন্তু ১৯ তারিখে তা অনির্দিষ্টিকাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়; সংবিধান সংশোধন করে মোশতাকের ক্ষমতা দখলকে বৈধতা দেয়া হয়।
  • পরের দিন সরকার জানায় সংবিধানের চারটি মূলনীতি (জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা) অপরিবর্তিত থাকবে।
  • একুশে আগস্ট তার নিজের কালো রঙের টুপিকে জাতীয় টুপি ও তার জামাকে (গলাবন্ধ ফুলহাতা আচকান বা শেরওয়ানী) সরকারি পোশাক হিসেবে ঘোষণা করে।
  • রেডিওতে রবীন্দ্র সঙ্গীত ও গীতা থেকে শ্লোক পাঠ বন্ধ করে দেয়া হয়। গীতা পাঠ পরে আবার চালু করা হয়।
  • বক্তব্যের শেষে জয় বাংলা’র বদলে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ ব্যবহার শুরু হয়।
  • দেশের নাম বদলে ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ করার পরিকল্পনা পরে বাতিল করা হয়।

এর মধ্যে ২০শে আগস্ট মোশতাকের অনুরোধে বোস্টার বঙ্গভবনে তার সাথে দেখা করলে রাষ্ট্রপতি তার সরকারের পক্ষে আমেরিকার স্বীকৃতি আদায়ের জন্য অনেক অনুনয় বিনয় করে। সেদিন পাঠানো তারবার্তায় বোস্টার নিজেও স্বীকৃতি দানের পক্ষে মত দেয়।

এর আগে ইংল্যান্ড, জাপান, বার্মাসহ আরো কয়েকটি দেশ মোশতাক সরকারকে স্বীকৃতি দেয়। এরপর পাকিস্তানের ভুট্টো সরকার মোশতাককে অভিনন্দন জানিয়ে চাল ও কাপড় পাঠায়। অন্যদিকে জামায়াতের প্রতিষ্ঠাত মওদুদী মুজিব হত্যাকে আল্লাহর কৃপা এবং ইসলামের বিজয় হিসেবে ঘোষণা করে।

২৩শে আগস্ট গ্রেপ্তার হন জাতীয় চার নেতা – তাজউদ্দীন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এ. এইচ. এম. কামরুজ্জামান। তাদেরকে সরকারে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রন জানিয়েছিল মোশতাক। কিন্তু সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় তাদের গ্রেফতার করা হয়।

পরের দিন মেজর জেনারেল কে. এম. শফিউল্লাহকে সরিয়ে উপ-সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয় মোশতাক। জিয়ার ডেপুটি হিসেবে নিযুক্ত হয় ব্রিগেডিয়ার এরশাদ। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এবং বঙ্গবন্ধু সরকারের একসময়ের মন্ত্রী জেনারেল এম. এ. জি ওসমানী মোশতাকের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা পদে নিয়োগ পান। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে সংবিধান সংশোধনের বিরোধীতা করে তিনি সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন।

জিয়ার সামরিক সরকারের কড়াকড়ির কারনে শেখ মুজিবের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী অনেকটা নীরবেই পালিত হয়। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বাড়তি পুলিশী পাহারা বসানো হয়।

একই সময়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সরকার-বিরোধী বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে জিয়ার বাহিনী, যাদেরকে আমেরিকান রাষ্ট্রদূত জাসদ সদস্য ও মুজিব সমর্থক হিসেবে চিহ্নিত করেন।

চার বছর পর

বঙ্গবন্ধু হত্যার চার বছর পর ১৯৭৯ সালের ১৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগসহ চারটি দল ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে ঢাকায় তার মৃত্যুবার্ষিকী পালন করে। বাকি দলগুলি হল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও রাশিয়াপন্থী দুটি ছোট দল।

বৃষ্টি উপেক্ষা করে দলগুলোর কর্মী-সমর্থকরা দুটি মিছিল ও একটি সমাবেশের আয়োজন করে বলে ওয়াশিংটনকে জানান বোস্টার।

আওয়ামী লীগের জনসভায় বক্তারা বলেন, সাম্রাজ্যবাদীরাই শেখ মুজিবকে হত্যা করেছে। কেননা তিনি সমাজতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতাকে বাদ দিতে চাননি। আর যারা এই দিনটিকে “মুক্তি দিবস” পালন করছে, সেইসব দালালদের জিহ্বা ও লেজ বাংলার মানুষ কেটে ফেলবে।

সন্ধ্যায় প্রায় ৩,০০০-৪,০০০ কর্মীর একটি মিছিল শেখ মুজিবের বাড়ির দিকে যেতে চাইলে পুলিশ আগের বছরের মতো এবারও রাস্তা আটকে রাখে এবং তাদের অন্য পথে চলে যেতে বলে।

(চলবে...)

শেয়ারঃ


উইকিলিকস: মার্কিনীদের চোখে বঙ্গবন্ধু হত্যা