এগিয়ে চলো এক্সক্লুসিভ

মোশতাক চাইলো স্বীকৃতি, জিয়া-ফারুক-রশীদ সামরিক সহায়তা!

6 / 8

মোশতাক চাইলো স্বীকৃতি, জিয়া-ফারুক-রশীদ সামরিক সহায়তা!

মোশতাক চাইলো স্বীকৃতি, জিয়া-ফারুক-রশীদ সামরিক সহায়তা!
  • পড়তে সময় লাগবে মিনিট
  • পড়তে সময় লাগবে মিনিট

ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে ১৫ই আগস্টের নারকীয় হামলা থেকে শুরু করে পরবর্তী কয়েকদিনে রাজনীতির মাঠে ও সশস্ত্র বাহিনীতে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে সিআইএ এবং ঢাকাস্থ আমেরিকান দূতাবাসের প্রকাশ হওয়া বিভিন্ন নথি থেকে অনুবাদ থাকবে তথ্যমূলক এই সিরিজে। কয়েক বছর আগে দূতাবাসের নথিগুলো প্রকাশ করে উইকিলিকস। আর সিআইএ’র ফাইলগুলো উন্মুক্ত করা শুরু হয় গত বছরের ডিসেম্বর থেকে।

আজকের পর্বে থাকছে নতুন সরকারের স্বীকৃতি আদায়ে আমেরিকান রাষ্ট্রদূতকে খন্দকার মোশতাকের অনুরোধের কারন এবং মোশতাক সরকারের প্রতি আমেরিকার দৃষ্টিভঙ্গি ও পরামর্শ সম্পর্কে উইকিলিকসের ফাঁস করা একটি তারবার্তার অনুবাদ। ঘটনাটি ২০শে আগস্টের।

এর আগে পঞ্চম পর্বটি ছিল হত্যাকাণ্ডের মাত্র আট দিন পর সেনাবাহিনীতে ঘটে যাওয়া নাটকীয় রদবদল নিয়ে। চব্বিশে আগস্ট হঠাৎ মেজর জেনারেল কে. এম. শফিউল্লাহকে সরিয়ে তার ডেপুটি জিয়াকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয় খুনীদের ক্রীড়ানক মোশতাক।

পরবর্তীতে আসছে খুনিদের থাইল্যান্ড যাওয়া ও ফিরে আসা; এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আওয়ামীলীগ ও দেশের পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন নথির তথ্য। শেষ পর্বে থাকবে ৫ই আগস্ট আমেরিকান রাষ্ট্রদূতের সাথে বঙ্গবন্ধুর কথোপথনের অনুবাদ, যা মৃত্যুর আগে তার শেষ সাক্ষাৎকার বলে ধারণা করা হয়।

নোট- কোন এক রহস্যময় কারণে ৬ই আগস্ট থেকে ১৪ই আগস্ট পর্যন্ত সময়ে ঢাকাস্থ দূতাবাসের পাঠানো কোন তারবার্তা বা সিআইএ’র প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি।

*

মোশতাকের সাথে রাষ্ট্রদূতের প্রথম বৈঠক

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে আমেরিকার দ্বারস্থ হয় খন্দকার মোশতাক। তার উদ্দেশ্য ছিল ভারতের সম্ভাব্য হস্তক্ষেপ এড়াতে আমেরিকাকে ব্যবহার করা। এর আগে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নিক্সন সরকারের কর্মকর্তাদের মধ্যস্থতায় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সমঝোতার জন্য কলকাতায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে মোশতাক উপস্থিত ছিল। সেই সমঝোতা ব্যর্থ হয়।

১৯৭৫ সালের ২০শে আগস্ট ঢাকাস্থ আমেরিকান রাষ্ট্রদূত ডেভিড বোস্টারকে বঙ্গভবনে আমন্ত্রণ জানিয়ে “এবার আর সুযোগ না হারানোর” পরামর্শ দেয় মোশতাক। সে বলে পরিস্থিতি এতোই জটিল যে “এক্ষুণি, আজকেই” স্বীকৃতি প্রয়োজন।

বৈঠকে স্বীকৃতির ব্যাপারে স্পষ্ট কোন সিদ্ধান্ত না জানালেও অর্থনৈতিক সহযোগীতামূলক কর্মকান্ড স্বাভাবিকভাবেই চলবে বলে মোশতাককে আস্বস্ত করে বোস্টার।

একই দিনে ওয়াশিংটনে পাঠানো তারবার্তায় বোস্টার স্বীকৃতি দেয়ার ব্যাপারে মত দেয়। বলেন, মোশতাক যখন নিজে থেকেই আমেরিকার সাহায্য চাইছে, এই অবস্থায় স্বীকৃতি দিলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে আমাদের পছন্দমতো পরিবর্তন আনতে তা কার্যকর ভূমিকা রাখবে। তাছাড়া ইংল্যান্ড, জাপান, বার্মাসহ আরো অনেকেই ইতিমধ্যে মোশতাক সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে।

তবে বোস্টারের মতে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেস কনফারেন্স করে মোশতাক সরকারকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য আমেরিকা প্রস্তুত থাকলেও আরো কয়েকদিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা উচিত।

মোশতাক জানায় আমেরিকার ফোর্ড সরকারের কাছ থেকে কি সহযোগীতা চাওয়া যেতে পারে তা সে তখনো ভাবেনি, কিন্তু আমেরিকার সরকারের কাছ থেকে তার স্বীকৃতি পাওয়াটা খুব জরুরি। এই স্বীকৃতি এদেশে ভারতের প্রভাব কমাতে সাহায্য করবে বলে সে জানায়। তার সন্দেহের কারন ছিল মুজিব-ইন্দিরার সখ্যতা, ভারতের মিডিয়াতে মোশতাকবিরোধী প্রচারণা ও মুক্তিযুদ্ধের সময়কার মতো পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে শরনার্থী শিবিরে বাংলাদেশীদের জড়ো করার চেষ্টা ইত্যাদি।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর কোন রক্তপাত ছাড়াই পরিস্থিতি শান্ত করা গেছে বলে জানায় মোশতাক। কিন্তু ভারত যদি স্থল বা আকাশপথে হামলা করে তাহলে বাংলাদেশ পুরোপুরি অরক্ষিত হয়ে পড়বে। এমতাবস্থায় আমেরিকা তার সরকারকে স্বীকৃতি দিলে ভারত হস্তক্ষেপ করার আগে আরো ভাববে।

বোস্টারের মতে ভারত সরকার ইতিমধ্যে অফিশিয়াল বক্তব্যে মুজিব হত্যা ও পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহকে বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ ও নিজস্ব বিষয় বলে জানিয়ে দিয়েছে। মোশতাক উত্তর দেয় তার আশা ভারত বাংলাদেশের বিষয়ে নাক গলাবেনা।

স্বীকৃতি লাভে মরীয়া মোশতাক

মোশতাকের অনুরোধে মাত্র এক ঘন্টার নোটিশে ২০শে আগস্টা বিকাল ৩টায় এক বৈঠকে অংশ নিতে দূতাবাসের রাজনৈতিক পরামর্শকসহ বঙ্গভবনে যান বোস্টার। কিন্তু দূতাবাসের কর্মকর্তাকে বাইরে পাঠিয়ে শুধু আমার সাথে আলোচনা করতে চায় মোশতাক।

শুরুতেই খুব আগ্রহ নিয়ে বোস্টার কবে দেশে ফিরে যাচ্ছে তা জানতে চায় মোশতাক। পরিকল্পনা বাতিল হয়েছে শুনে সে খুশি হয়ে যায় এবং বলে যে সে এটাই আশা করছিল! [অভ্যুত্থানের এক সপ্তাহ আগে বোস্টার মোশতাককে বলেছিল সে আমেরিকা ফিরে যাবে, কারন তাকে সিলেকশন বোর্ডের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে]। এরপর স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য বারবার তার হাত ধরে অনুনয় করছিল।

বোস্টারের এক প্রশ্নের জবাবে মোশতাক জানায় আগেরদিন সিদ্ধান্ত হয়েছে যে বাকশাল তথা এক-দলীয় ব্যবস্থা আর থাকছে না। তবে বহুদলীয় গণতন্ত্রে ফিরে যেতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

বৈঠকের শেষে রাষ্ট্রদূতকে যেকোন সময় বঙ্গভবনে আসার দাওয়াত দেয় মোশতাক, এবং তার পক্ষ থেকে আমেরিকার রাষ্ট্রপতিকে শুভেচ্ছা জানাতে বোস্টারকে অনুরোধ করে। তবে সেই মুহুর্তে এভাবে শুভেচ্ছা জানানো কূটনৈতিকভাবে সমীচীন কিনা তাও জানতে চায় হতবিহ্বল মোশতাক।

আমেরিকার কাছে অস্ত্র চেয়েছিল জিয়া-ফারুক-রশীদ

রাষ্ট্রদূতের সাথে সেই বৈঠকে (২০শে আগস্ট) মোশতাক মূলত স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা করে, এবং এর প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে। এছাড়া সম্ভাব্য আর কি কি ধরণের সহযোগীতা প্রয়োজন সে বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলেনি।

কিন্তু তার কিছুদিন পর নতুন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং পরে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের অন্যতম মেজর ফারুক ও মেজর খন্দকার আব্দুর রশীদ আমেরিকান দূতাবাসের রাজনৈতিক পরামর্শকের সাথে সাক্ষাত করে সরাসরি সামরিক সহায়তা চায়।

উভয় ক্ষেত্রেই ভারতের সম্ভাব্য আক্রমন ঠেকানোর কথা বলা হয়।

ওয়াশিংটনে পাঠানো গোপন বার্তায় বোস্টার বলেন, ফারুক ও রশীদ ২১শে অক্টোবর দূতাবাসের রাজনৈতিক পরামর্শকের সাথে তার বাসায় সাক্ষাত করে আমেরিকার সামরিক সহায়তার জন্য অনুরোধ করে। তারা জানায় মোশতাকই তাদের পাঠিয়েছে।

এর আগে জিয়া বোস্টারের কাছে একই ধরণের সাহায্যের জন্য আবেদন করে। তবে বোস্টার তখন তাকে নিরাশ করেন।

ফারুক-রশীদের মতে, ভারত অবশ্যই বাংলাদেশ আক্রমণ করে মোশতাক সরকারকে উৎখাত করতে চাইবে এবং বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ও পুলিশের সেই আক্রমণ প্রতিহত করার ক্ষমতা নেই। তবে ভারত সরাসরি আক্রমণ না করলেও এদেশের বিভিন্ন গোষ্ঠীকে মদদ দিতে চেষ্টা করতে পারে।

এছাড়া সোভিয়েত রাশিয়াও মোশতাক সরকারের জন্য হুমকি বলে তারা জানায়।

তারা বলে, পাকিস্তান ও চীন থেকে যে সাহায্য পাওয়া যাবে তা দিয়ে বহিঃশত্রুর আক্রমণ ঠেকানো সম্ভব না। সেক্ষেত্রে আমেরিকা সরাসরি বা তৃতীয় কোন দেশের মাধ্যমে সামরিক সরঞ্জাম দিতে পারবে কিনা জিজ্ঞেস করে খুনীরা।

বোস্টার লেখেন, অস্ত্র নয়, তারা চায় হেলিকপ্টার ও স্থলপথের যানবাহন যা দিয়ে দেশীয় বিভিন্ন সরকারবিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠীকে মোকাবেলা করা সম্ভব।

মেজরদের অনুরোধের প্রেক্ষিতে দূতাবাসের কর্মকর্তা তাদের বলেন এটা তার এখতিয়ারের মধ্যে পড়েনা। তিনি তাদেরকে পরামর্শ দেন তারা যেন ওয়াশিংটনে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাসের মাধ্যমে আমেরিকার পররাষ্ট্র দপ্তরের সাথে যোগাযোগ করে।

এই প্রস্তাবে মেজররা হতাশ হয়, কেননা তাদের ধারণা ছিল লিখিতভাবে অনুরোধ করলে আমেরিকান সরকার সেই আবেদন খারিজ করে দিতে পারে। তবে দূতাবাসের কর্মকর্তা বলেন তার ধারণা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখতে আমেরিকান সরকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে।

মেজররা তখন জোর দিয়ে বলে যে, সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায় অর্থনৈতিক অগ্রগতি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলেও সেই মুহুর্তে সম্ভাব্য হুমকি মোকাবেলাই মূখ্য উদ্দেশ্য।

নিজের পর্যবেক্ষণে বোস্টার জানান, ভারতীয়রা সে মুহুর্তে কি করছে তা তার জানা নেই, তবে বাংলাদেশ সরকার কি ভাবছে সেটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন ওয়াশিংটনের উচিত মেজরদের অনুরোধকে আমলে নেয়া।

(চলবে...)

শেয়ারঃ


উইকিলিকস: মার্কিনীদের চোখে বঙ্গবন্ধু হত্যা