ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে ১৫ই আগস্টের নারকীয় হামলা থেকে শুরু করে পরবর্তী কয়েকদিনে রাজনীতির মাঠে ও সশস্ত্র বাহিনীতে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে সিআইএ এবং ঢাকাস্থ আমেরিকান দূতাবাসের প্রকাশ হওয়া বিভিন্ন নথি থেকে অনুবাদ থাকবে তথ্যমূলক এই সিরিজে। কয়েক বছর আগে দূতাবাসের নথিগুলো প্রকাশ করে উইকিলিকস। আর সিআইএ’র ফাইলগুলো উন্মুক্ত করা শুরু হয় গত বছরের ডিসেম্বর থেকে।
আজকের পঞ্চম কিস্তিটি সেনাবাহিনীতে ঘটে যাওয়া নাটকীয় রদবদল নিয়ে। সেই হত্যাকাণ্ডের মাত্র আট দিন পর জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান হিসেবে পদোন্নতি পান ২৪শে আগস্ট। হত্যাকান্ডের সময় ও তার পরের কয়েকদিন চুপচাপই ছিলেন জিয়া। তবে সেদিন হঠাৎ মেজর জেনারেল কে. এম. শফিউল্লাহকে সরিয়ে তার ডেপুটি জিয়াকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয় খুনীদের ক্রীড়ানক খন্দকার মোশতাক।
পরবর্তীতে আসছে মোশতাকের সাথে আমেরিকান রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাত; খুনিদের থাইল্যান্ড যাওয়া ও ফিরে আসা; এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আওয়ামীলীগ ও দেশের পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন নথির তথ্য। শেষ পর্বে থাকবে ৫ই আগস্ট আমেরিকান রাষ্ট্রদূতের সাথে বঙ্গবন্ধুর কথোপথনের অনুবাদ, যা মৃত্যুর আগে তার শেষ সাক্ষাৎকার বলে ধারণা করা হয়।
নোট- কোন এক রহস্যময় কারণে ৬ই আগস্ট থেকে ১৪ই আগস্ট পর্যন্ত সময়ে ঢাকাস্থ দূতাবাসের পাঠানো কোন তারবার্তা বা সিআইএ’র প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি।
-
চব্বিশে আগস্ট নতুন চিফ অব আর্মি স্টাফ মেজর জেনারেল জিয়ার ডেপুটি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় ব্রিগেডিয়ার হু. মো. এরশাদকে, যে তখন প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে অবস্থান করছিল। পাশাপাশি তাকে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত করা হয়।
সেনাপ্রধানের পদ থেকে সরিয়ে মেজর জেনারেল শফিউল্লাহকে পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে যুক্ত করা হয়। তবে চিফ অব জেনারেল স্টাফ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের বিষয়ে তখনো কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। উভয়েই শেখ মুজিবের আস্থাভাজন ছিলেন।
২৫শে আগস্ট সকালে এই গোপন তারবার্তাটি ওয়াশিংটন পাঠান রাষ্ট্রদূত ডেভিড বোস্টার।
পনেরই আগস্ট সেনাবাহিনীর কাছ থেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে চার জাতীয় নেতাকে (তাজউদ্দীন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এ. এইচ. এম. কামরুজ্জামান) তার সরকারে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রন জানিয়েছিল মোশতাক। কিন্তু সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় তাদের গ্রেফতার করা হয়।
৩রা নভেম্বর কারাগারে তাদের খুন করে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা। ৪ঠা নভেম্বর থেকে তিনদিন ধরে চলা আরেকটি রক্তাক্ত অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানে খালেদ মোশাররফ নিহত ও কর্ণেল তাহের গ্রেফতার হন; এবার রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন জিয়া।
এর আগে ২৪শে আগস্টের রদবদলে চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ নামে একটি পদ সৃষ্টি করে বিডিআর প্রধান মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানকে নিয়োগ দেয়া হয়। খলিল জিয়ার চেয়েও সিনিয়র হওয়ায় তাকে তিন বাহিনীর প্রধানের চেয়েও বড় এই নতুন পদ দেয়া হয়।
তার স্থলে বিডিআর প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করা হয় চট্টগ্রামের ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার কাজী গোলাম দস্তগীরকে।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ফেরার পর থেকে মেজর জেনারেল খলিল রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবের উপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। কেননা তাকে বিডিআর-এ পাঠানো হয়, যদিও তিনি ব্রিগেডিয়ার থেকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি পান।
অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এবং বঙ্গবন্ধু সরকারের একসময়ের মন্ত্রী জেনারেল এম. এ. জি ওসমানী মোশতাকের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা পদে নিয়োগ পান। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে সংবিধান সংশোধনের বিরোধিতা করে তিনি সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন।
রাষ্ট্রদূত ডেভিড বোস্টারের মতে, ওসমানী বর্ষীয়ান বা সাবেক মন্ত্রী না হলে মোশতাক হয়তো তাকে প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী পদ দিতো। প্রটোকলবিহীন প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা পদ দেয়ার মাধ্যমে এখন থেকে মোশতাক তাকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করতে পারবে। এখন পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে ওসমানী হয়তো আপাতত প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন।
বোস্টার বলেন, পনেরই আগস্ট শেখ মুজিবকে উৎখাতের পর খুনীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল তার আস্থাভাজন মেজর জেনারেল শফিউল্লাহকে সরিয়ে দেওয়া। সেনাবাহিনীতে তাকে একজন অপেক্ষাকৃত দূর্বল নেতা হিসেবে দেখা হতো। এই সুযোগে সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়, যার ফলে কয়েকজন মেজর অভ্যুত্থান ঘটানোর মতো সুযোগ পায়। অবশ্য কয়েকজন বিশ্লেষক রাষ্ট্রদূতকে বলেন রদবদলের পর সেনাবাহিনী এখন অভ্যুত্থানকারীদের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে।
(চলবে...)