এগিয়ে চলো এক্সক্লুসিভ

মুজিব হত্যায় উৎফুল্ল ভুট্টো, মওদুদী

2 / 8

মুজিব হত্যায় উৎফুল্ল ভুট্টো, মওদুদী

মুজিব হত্যায় উৎফুল্ল ভুট্টো, মওদুদী
  • পড়তে সময় লাগবে মিনিট
  • পড়তে সময় লাগবে মিনিট

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার আগেই, মানে ১৯৭১ সালের মার্চের শুরুতেই মার্কিন গোয়েন্দারা অনুমান করেছিল যে আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশকে স্বাধীন করতে পারবেন ঠিকই, তবে স্বাধীন বাংলাদেশের সূচনা খুব একটা সুখকর হবে না। কেননা পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক নীতি, সম্পদের সীমাবদ্ধতা এবং অদক্ষ ও নিরক্ষর একটা জনগোষ্ঠীর বোঝা থাকবে আওয়ামী লীগের ঘাড়ে। তাদের ধারণা ছিল অর্থনৈতিক সমস্যা কাটিয়ে উঠতে না পারলে দলের ঐক্য ভেঙ্গে পড়বে এবং জনগণ হয়তো জনপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে পারে। এর ফলে রাজনীতিতে চরমপন্থার প্রবেশ ঘটবে, বিশৃংখলা সৃষ্টি হবে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠনের পর ঢাকাস্থ আমেরিকান দূতাবাস ওয়াশিংটনে যেসব গোপন বার্তা পাঠায় সেখানেও কয়েকবার মুজিব সরকারের পতনের সম্ভাবনার দিকে ঈঙ্গিত করা হয়েছিল।

শুরুতে কাপুরুষোচিত সেই হত্যাকান্ডের আদ্যপান্ত বুঝতে অনেকেই গলদঘর্ম হয়েছে। তবে নানা সূত্র মিলিয়ে অনেক রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং সাংবাদিকরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য পাকিস্তান, চীন ও আমেরিকাকে দায়ী করতে থাকে। একটা সময় লিবিয়ার গাদ্দাফির নামও আসে কেননা তার দেশে গিয়েই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল খুনি কর্নেল ফারুক ও কর্নেল রশীদ। ফারুককে এই মামলায় ফাঁসি দেওয়া হলেও রশীদ এখনো পলাতক এবং তার বর্তমান অবস্থান স্পষ্ট নয়।

ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে ১৫ই আগস্টের বর্বরোচিত হামলা থেকে শুরু করে পরবর্তী কয়েকদিনে রাজনীতির মাঠে ও সশস্ত্র বাহিনীতে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে সিআইএ এবং ঢাকাস্থ আমেরিকান দূতাবাসের প্রকাশ হওয়া বিভিন্ন নথি থেকে অনুবাদ থাকবে তথ্যমূলক এই সিরিজে। কয়েক বছর আগে দূতাবাসের নথিগুলো প্রকাশ করে উইকিলিকস। আর সিআইএ’র ফাইলগুলো উন্মুক্ত করা শুরু হয় গত বছরের ডিসেম্বর থেকে।

আজকের দ্বিতীয় কিস্তিতে থাকছে বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘটনায় পাকিস্তানে সৃষ্ট প্রতিক্রিয়ার তথ্য যা ইসলামাবাদের দূতাবাস থেকে ওয়াশিংটন পাঠানো হয় ২০শে আগস্ট। দেখা যায় বাংলাদেশে ইসলামপন্থী নেতারা ক্ষমতায় আসার ফলে পাকিস্তানি রাজনীতিবিদ, মিডিয়া ও সাধারণের মধ্যে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।

তৃতীয় খন্ডে থাকবে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডে চীন, আমেরিকা ও লিবিয়ার ভূমিকা নিয়ে গোপন নথির অনুবাদ। এরপর প্রকাশিত হবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মোশতাকের সাথে আমেরিকান রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাতকার। পরের লেখাগুলোতে থাকবে সেনাপ্রধান হিসেবে জিয়া ও উপ-প্রধান হিসেবে এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণ, খুনিদের থাইল্যান্ড গমন ও ফিরে আসা এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আওয়ামীলীগ ও দেশের পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন নথির তথ্য।

নোট: কোন এক রহস্যময় কারনে ৬ই আগস্ট থেকে ১৪ই আগস্ট পর্যন্ত সময়ে ঢাকাস্থ দূতাবাসের পাঠানো কোন তারবার্তা বা সিআইএ’র প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি।

*

মুজিব হত্যার পরপর পাকিস্তানে খুশির বন্যা বয়ে যায়; বাংলাদেশকে আগের মতো ইসলামিক লেবাস পড়ানোর মোশতাকের পরিকল্পনা তারা আন্তরিকভাবে স্বাগত জানায় – সেখানকার পত্রিকা ও জনমত যাচাই করে এমনটাই বলেছিল ইসলামাবাদের আমেরিকান দূতাবাস থেকে। এছাড়া বাংলাদেশের সম্ভাব্য অর্থনৈতিক সংকট এবং ভারতের হস্তক্ষেপের বিষয়গুলোও বিভিন্ন মহলে বিশেষভাবে আলোচিত হয়।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের মতে, তারা দ্রুত মোশতাক সরকারকে সমর্থন জানাতে কাজ করছিল। জনগণের এই মনোভাব চলমান থাকলে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

তবে ইসলামীকরণের যে পরিকল্পনার কথা শোনা যাচ্ছিলো তা ভুল প্রমাণিত হলে জনগণের আনন্দ মাটি হবে এবং অপরদিকে প্রধানমন্ত্রী ভুট্টোর সম্মান নষ্ট হবে। কেননা ভুট্টো বাংলাদেশ ইসলামী প্রজাতন্ত্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দেওয়ার দুই দিনের মধ্যে জানতে পারে যে তথ্যটি হয়তো সত্য নাও হতে পারে। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের ধারণা সেই মুহুর্তে মোশতাক দেশের নাম না বদলালেও ভবিষ্যতে তা বাস্তবায়িত হতে পারে।

[প্রসঙ্গতঃ ১৯৭৭ সালের ৫ই জুলাই ভুট্টোকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে জেনারেল জিয়াউল হক এবং ১৯৭৯ সালে একটি রাজনৈতিক হত্যা মামলায় তাকে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়।]

পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের এক কর্মকর্তা দূতাবাসকে বলেন মুজিব সরকারের পতন হওয়ায় বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক আরো বন্ধুত্বপূর্ণ হবে, ফলে এর মাধ্যমে পাকিস্তানের পক্ষে বাংলাদেশে একটি ভারত ও রাশিয়া-বিরোধী মনোভাব সৃষ্টি করা সম্ভব। চীন হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিবে, কিন্তু এতে করেও বাংলাদেশকে তিন দিক থেকে ঘেরা ভারতের প্রভাব খুব একটা কমবে না বলে ধারণা করে দূতাবাস।

হয়তো শুধু জনমতের কারণেই পাকিস্তানের সব পত্রিকা মুজিব হত্যা নিয়ে বিভিন্ন খবর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ছাপে। পাশাপাশি বিশেষভাবে আলোচিত হয় ভুট্টোর ঘোষণার কথা। আবার বাংলাদেশে ভারতের সম্ভাব্য সাঁড়াশি অভিযানের কথা বলে কোন কোন পত্রিকা। তবে মোশতাকের সরকার সৌদি আরবসহ বিভিন্ন ইসলামিক দেশের সমর্থন পাওয়ায় ভারত সেই চেষ্টা হয়তো করবেনা বলেও অনেকে মত দেয়। অন্য দিকে বাংলাদশের অর্থনৈতিকে সংকট কাটিয়ে উঠতে ধনী মুসলিম দেশগুলো আগের চেয়ে বেশি অর্থ সাহায্য করবে বলে আলোচনা হয়.

পাকিস্তানের অধিকাংশ জনগণ ও মিডিয়া মুজিব হত্যাকান্ডে স্বস্তিবোধ করলেও কিছু বুদ্ধিজীবী হামলার নৃশংসতায় ক্ষোভ প্রকাশ করে। তবে তারা সরকার উৎখাতের বিরুদ্ধে কোন মন্তব্য করেনি। অধিকাংশ পাকিস্তানীর মতে, শেখ মুজিব ছিলেন একজন দেশদ্রোহী এবং ইসলামের শত্রু। তাদের ধারণা বাকশাল গঠন করার কারনেই তার সরকারকে উৎখাত করা হয় এবং একজন দেশদ্রোহী বা স্বৈরাচার যেভাবে পরিণতি বরণ করে, ঠিক সেভাবেই তারও মৃত্যু হয়েছে।

মওদুদী: এটা আল্লাহর দয়া, ইসলামের বিজয়

রাজনৈতিক দল ও সমাজেরবিভিন্ন স্তরের নেতারা জনমত বুঝে বাংলাদেশে মোশতাক ও পাকিস্তান সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েমিডিয়াতে নানারকম বক্তব্য ও বিজ্ঞপ্তি দেয় বলে ওয়াশিংটনকে জানায় ইসলামাবাদ। জামায়াতে ইসলামীর প্রধান তাত্ত্বিক নেতা মাওলানা মওদুদী বঙ্গবন্ধু হত্যাকে আল্লাহর অশেষ কৃপা ও ইসলামের বিজয় হিসেবে বর্ণনা করে।

ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটি মোশতাক সরকারকে সমর্থন জানিয়ে প্রস্তাব পাশ করে যার বক্তব্য ছিল: বাংলাদেশে খুশি হবার মতো যে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে তাতে সেদেশের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক আরো গভীর হবে। এছাড়া বাংলাদেশের অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় বিশ্বের সব মুসলিম দেশকে আহ্বান জানায় পাকিস্তান। তবে ইউডিএফ অবশ্য পাকিস্তানের রাজনীতিতে চলমান অস্থিরতা নিয়ে নিজ দেশের সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলে সমাধানের পথ না খুঁজলে সেখানেও বাংলাদেশের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক মহাপরিচালক হায়াত মেহেদীর মতে, ক্ষমতার পট পরিবর্তনের কারনে দুই দেশের কূটনৈতিক পর্যায়ে সম্পর্ক গভীর হবে, কেননা বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যে শেখ মুজিবই সবচেয়ে বেশি কট্টর পাকিস্তান-বিদ্বেষী ছিলেন। তার প্রস্থানের ফলে বাংলাদেশ এখন থেকে এমনভাবে কাজ করবে যে পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়ার পেছনের কারনগুলোও সমাধান করা সম্ভব হবে। আবার বিহারীদের ফিরিয়ে নিতে শেখ মুজিবের সৃষ্টি করা চাপও কমবে। এতে করে বিহারীরা বাংলাদেশেই আরো ভালো সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারবে।

দুই দেশের মধ্যে দ্রুত কূটনৈতিক সম্পর্ক শুরু করতে পাকিস্তান তৈরি ছিল। তবে হাইকমিশন স্থাপনের আগেই বিহারীদের প্রত্যাবর্তন ও সম্পদ ভাগাভাগির ব্যাপারটি সমাধান করতে হবে কিনা এটা নিশ্চিত করতে পারেননি মেহেদী।

(চলবে…)

শেয়ারঃ


উইকিলিকস: মার্কিনীদের চোখে বঙ্গবন্ধু হত্যা