বাংলাদেশ স্বাধীন হবার আগেই, মানে ১৯৭১ সালের মার্চের শুরুতেই মার্কিন গোয়েন্দারা অনুমান করেছিল যে আওয়ামীলীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশকে স্বাধীন করতে পারবেন ঠিকই, তবে স্বাধীন বাংলাদেশের সূচনা খুব একটা সুখকর হবেনা। কেননা পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক নীতি, সম্পদের সীমাবদ্ধতা এবং অদক্ষ ও নিরক্ষর একটা জনগোষ্ঠীর বোঝা থাকবে আওয়ামীলীগের ঘাড়ে। তাদের ধারণা ছিল অর্থনৈতিক সমস্যা কাটিয়ে উঠতে না পারলে দলের ঐক্য ভেঙ্গে পড়বে এবং জনগণ হয়তো শেখ মুজিবকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে পারে। এর ফলে রাজনীতিতে চরমপন্থার প্রবেশ ঘটবে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠনের পর ঢাকাস্থ আমেরিকান দূতাবাস ওয়াশিংটনে যেসব গোপন বার্তা পাঠায় সেখানে কয়েকবার বঙ্গবন্ধু সরকারের পতনের সম্ভাবনার দিকে ঈঙ্গিত করা হয়েছিল।
১৫ই আগস্টের বর্বরোচিত হামলা থেকে শুরু করে পরবর্তী কয়েকদিনে রাজনীতির মাঠে ও সশস্ত্র বাহিনীতে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে সিআইএ এবং ঢাকাস্থ আমেরিকান দূতাবাসের প্রকাশ হওয়া বিভিন্ন নথি থেকে অনুবাদ থাকবে তথ্যমূলক এই সিরিজে। কয়েক বছর আগে দূতাবাসের নথিগুলো প্রকাশ করে উইকিলিকস। তারপর সিআইএ’র ফাইলগুলো উন্মুক্ত করা হয় অনলাইনে। দ্বিতীয় খন্ডে থাকবে মুজিব হত্যায় ভারত, চীন ও আমেরিকার ভূমিকা নিয়ে আলোচনা। পরে থাকবে মোশতাকের সাথে আমেরিকান রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাত, সেনাপ্রধান হিসেবে জিয়া ও উপ-প্রধান হিসেবে এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণ, খুনিদের থাইল্যান্ড গমন ও ফিরে আসা এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আওয়ামীলীগ ও দেশের পরিস্থিতি।
কোন এক অজানা কারণে ৬ই আগস্ট থেকে ১৪ই আগস্ট পর্যন্ত সময়ের কোন ঢাকাস্থ দূতাবাসের পাঠানো তারবার্তা বা সিআইএ’র প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি।
*
পনেরই আগস্ট ভোরে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে রাষ্ট্রপতির বাড়িতে হামলা করে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যসহ ১১ জনকে হত্যা করা হয়। ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে সাতটা পর্যন্ত থেমে থেমে গুলির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল। কাছেই শেখ ফজলুল হক মনির ধানমন্ডির বাড়িতেও হামলা চালায় সেনা সদস্যরা; খুন করে মনি ও তার অন্তঃসত্তা স্ত্রী আরজু মনিকে। আর মিন্টু রোডে আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তাকে হত্যা এবং তার দুই সন্তানসহ মোট চারজনকে হত্যা করে ঘাতকরা।
বঙ্গবন্ধুর খুনিদের অন্যতম মেজর ডালিম বাংলাদেশ বেতারের শাহবাগস্থ ঢাকা আঞ্চলিক কেন্দ্র থেকে খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের বিষয়টি নিশ্চিত করে এবং কারফিউ ঘোষণা করে। মোশতাক ছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রী ও বাকশালের কার্যকারি কমিটির সদস্য। তাছাড়া বিডিআর এবং রক্ষীবাহিনীকে হুঁশিয়ার করে বলা হয় যে, সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা না করলে চরম মূল্য দিতে হবে।
তখনকার রাষ্ট্রদূত ডেভিস বোস্টার বঙ্গবন্ধু হত্যার বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে ওয়াশিংটনে তারবার্তা পাঠান দুপুর ১:২০ -এ। তিনি লেখেন যে, ঢাকার সেনানিবাস ও ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের আশেপাশে বিপুল পরিমান ট্যাংক অবস্থান করছিল। তবে দূতাবাসের উপর হামলার কোন ঝুঁকি ছিল না।
১৫ই আগস্ট সিআইএ তাদের নিয়মিত ব্রিফিং-এ রাষ্ট্রপতি নিক্সনকে জানায় যে, “বাংলাদেশের পশ্চিমাপন্থী মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদকে দেশের রাষ্টপতি ঘোষণা করা হয়েছে। শেখ মুজিবের পরিণতি জানা যায়নি; কেউ বলছে গৃহবন্দী, কেউ বলছে তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। তার দুই ভাগনে ও প্রধানমন্ত্রী মনসুর আলীকেও হত্যা করা হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। মার্শাল ল ঘোষণা করা হয়েছে, বিমানবন্দর বন্ধ রয়েছে। দেশের নাম বদলে ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ করার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।”
অভ্যুত্থান কেন হলো বা নতুন সরকারের আচরণ কেমন হবে সে সম্পর্কে ততক্ষণ পর্যন্ত সিআইএ’র কাছে স্পষ্ট তথ্য ছিল না। “তবে আশার কথা এই যে, শেখ মুজিবের মন্ত্রীপরিষদে মোশতাকই সবচেয়ে বেশি পশ্চিমাঘেঁষা এবং দলের মধ্যে একটি মধ্যপন্থার ছোট দলের সে ছিল পৃষ্ঠপোষক।”
ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে মোশতাক হয়তো দলের ডানপন্থীদের কাছে টানবে, যারা শেখ মুজিবের স্বেচ্ছাচার এবং ভারত-রাশিয়া নীতি ও বামপন্থার বিরোধী ছিল। “যদিও শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে খুব কম লোকেরই কথা বলার সাহস ছিল, তথাপি অর্থনৈতিক সমস্যা কাটাতে কার্যকর ভূমিকা নিতে না পারায় চাপা অসন্তোষ ছিল চরমে।”
সিআইএ’র মতে ভারত এখন নিবিড়ভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে।
যদিও ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার একটা অভিযোগ আগে থেকেই ছিল, তথাপি আইনশৃংখলা পরিস্থিতির চরম অবনতি না হলে ভারত সরাসরি হস্তক্ষেপ করবে না।
অন্যদিকে, চীন ৩১ শে আগস্ট, ১৯৭৫ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় এবং সৌদি আরব দেয় তার পরের বছর।
(চলবে)