এগিয়ে চলো এক্সক্লুসিভ

ভয় না পেয়ে সাহসিকতার সাথে করোনাকে মোকাবিলা করুন

30 / 30

ভয় না পেয়ে সাহসিকতার সাথে করোনাকে মোকাবিলা করুন

ভয় না পেয়ে সাহসিকতার সাথে করোনাকে মোকাবিলা করুন
  • পড়তে সময় লাগবে মিনিট
  • পড়তে সময় লাগবে মিনিট

জুনায়েদ আহমেদ

ভাইয়ার বিজনেসের জন্য আমাদের গাড়ির ড্রাইভার শুধু মাঝেমধ্যে ডেলিভারি দিতে বের হতো। এছাড়া প্রত্যেকেই আমরা বাসায়ই থাকতাম। ড্রাইভারসহ বাসার অন্যান্য হেল্পিং হ্যান্ড যারা আছে, তারা নিচতলায় থাকতো, আর আমরা থাকতাম দোতলায়। আর দরকার ছাড়া যেহেতু আমরা নিচে নামতাম না, তাই নিজ থেকে কেউ খোঁজ না দিলে জানতেও পারি না নিচে কী হচ্ছে না হচ্ছে। এ কারণেই ড্রাইভারের যে ঠান্ডা-জ্বর ছিল ১০ দিন ধরে, তার কিছুই আমরা জানতাম না। 

একদিন ড্রাইভার ফোন দিল বাবাকে। বললো তার নাকি প্রচন্ড শরীর খারাপ লাগছে, কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এসেছে। বাবা তৎক্ষনাৎ থার্মোমিটার নিয়ে নিচে নেমে যায়। নিজের হাতে জ্বর মেপে দেখে তার জ্বর ১০৫ এ উঠে গেছে! জরুরি চিকিৎসা দিয়ে জ্বর নামানোর পর ড্রাইভার বলে তার ৮-১০ দিন ধরেই জ্বর-ঠান্ডা, নাপা খেয়ে খেয়ে কমিয়ে রেখেছে। তাকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করে বাবা চলে আসে উপরে। 

এদিকে যে সেফটির কারণে আমরা দোতলায় ঘরবন্দী জীবন যাপন করছি, করোনা থেকে বাঁচার জন্য, সেই করোনার সিম্পটম ক্যারি করছে এরকম একজনের জ্বর বাবা মাপতে গেছেন শুনে মা চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করেছিলেন। যেহেতু বাবার শরীরের অবস্থা ভাল না, অলরেডি হার্টে রিং পরানো আছে, তাই সতর্কতার সাথে মা মূলত আপোষ করতে চাননি। 

সাথে রাখুন সেপনিল হ্যান্ড স্যানিটাইজার  

যাহোক, বাবা উপরে চলে এলেন, রাতে আর কিছু হলো না, স্বাভাবিকই ছিল সবকিছু। গন্ডগোলটা লাগলো পরদিন যখন দেখলাম বাবা কথা বলতে পারছেন না, গলা ভেঙে গেছে৷ যেহেতু আগেরদিন এমন একটা ব্যাপার হয়েছে, আর তার পরদিনই বাবার গলা বসে গেছে, তাই আমরা আর রিস্ক নিতে চাইনি। করোনা টেস্ট করতে দিলাম। জুলাইয়ের ৬ তারিখে রিপোর্ট এলো- পজিটিভ৷ 

ভাইয়া বললেন, যেহেতু বাবার কোভিড পজিটিভ এসেছে, তাই আমাদের সবারই টেস্ট করানো উচিত। এখানে বলে রাখি, দোতলায় আমি আব্বু-আম্মুকে নিয়ে থাকি, তিনতলায় ভাইয়া-ভাবী তাদের বাচ্চাসহ থাকেন। অতঃপর হেল্পিং হ্যান্ড সহ বাসার সবাই করোনা টেস্ট করতে দিলাম। রিপোর্ট পেয়ে থ বনে গেলাম। নিচতলা আর দোতলা নিয়ে বাসায় ১১ জন মানুষ, এবং প্রত্যেকেই পজিটিভ, অথচ তিনতলার প্রত্যেকেই নেগেটিভ! 

আমার দুঃশ্চিন্তা হচ্ছিল আম্মু আর আব্বুকে নিয়ে। কারণ যতটুকু জেনেছি, অল্প বয়স্কদের করোনা খুব বেশি কাবু করতে পারে না। কিন্তু বয়স্কদের বেলায় এটা খুব ভোগায়। জ্বর কারোরই খুব বেশি ছিল না, কিন্তু গলা ব্যথা, কাশি, সর্দি- এই সমস্যাগুলো হচ্ছিল। সারাদিনে অন্তত ১০-১৫ বার পালস অক্সিমিটারে চেক করে দেখতাম আব্বু-আম্মুর স্যাচুরেশন ঠিকঠাক আছে কিনা। 

একদিন দেখলাম আম্মুর অক্সিজেন লেভেল নরমালের চেয়ে কমে গেছে, ৮৯ এ চলে এসেছে। আবার ঘ্রাণ-টেস্টও চলে গেছিল মুখের৷ যেহেতু বাসার প্রত্যেকেই পজিটিভ, আর করোনায় যেকোনো সময় জরুরি পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়, তাই আমরা সর্বোচ্চ নিরাপত্তা মনে করে আম্মুকে হাসপাতালে ভর্তি করবার সিদ্ধান্ত নেই। আবার আব্বুর হার্টে রিং পরানো ছিল, কিন্তু নামাজ পড়ার সময় বারবার সেখানে টান লাগছিল দেখে ডাক্তার একটা সিটিস্ক্যান করার পরামর্শ দেন। সিটিস্ক্যান করাতে গিয়ে লাংস এক্সরেও করানো হয় আব্বুর, এবং দেখা যায় ৫০% ইতোমধ্যে ইনফেকটেড হয়ে গেছে। সুতরাং একই হাসপাতালে আব্বুও ভর্তি হোন।  

আব্বু-আম্মু দুইজনই হাসপাতালে। তাদের এক্সরে করার পর আমারও লাংস এক্সরে করতে দেই। রিপোর্টে যখন দেখি পার্ফেক্ট আছে সবকিছু, তখন নিজেকে পুরোপুরি রুমবন্দী করে ফেলি। রুম থেকে বের হই না, কাউকে ঢুকতেও দেই না রুমে। খাবার-দাবারের জন্য যেটা করা হতো তা হলো রুমের বাইরে প্লেটে করে খাবার ঢেকে রেখে যেত, আমি খাবার নিয়ে খাওয়া শেষ করে আবার টেবিলের উপর প্লেট রেখে দিতাম। দিনে অন্তত ৪-৫ বার ভাঁপ নিয়েছি, গরম পানি খেয়েছি প্রচুর। শুধু গরম পানিই নয়, যে খাবারটাই খেয়েছি, গরম গরম খেয়েছি। ডাল, স্যুপ টাইপের এনার্জেটিক খাবার খেয়েছি। শরীর দুর্বল যাতে না লাগে তাই প্রোটিন খেয়েছি বেশি। নাশপাতি, মাল্টা, লেবু- অর্থাৎ ভিটামিন সি আছে এরকম ফল প্রচুর খেয়েছি। এছাড়া ডাক্তারের সাথে কনসাল্ট করে ওষুধ তো চলছিলোই।

আসলে পজিটিভ হওয়ার শুরু থেকে কোনো ধরনের কোনো উপসর্গই দেখা দেয়নি আমার। পজিটিভ হওয়ার ৭ দিন পর, ৮দিনের মাথায় ১ দিনের জন্য আমার জ্বর আসে হালকা, এরপরই স্বাদ-ঘ্রাণ সব চলে যায়৷ স্বাদ-ঘ্রাণ চলে গেলেও আমি খাওয়া কমাইনি, কারণ জানতাম কেবলমাত্র ইমিউনিটি স্ট্রং থাকলেই এ রোগ থেকে দ্রুত মুক্তি মিলবে। 

প্রথম প্রথম অনেক ভয় পেয়েছি, কিন্তু ধীরে ধীরে ভয়টাকেই জয় করেছি। ডাক্তারের কথামতো প্রতিদিন নিয়ম করে ছাদে হাঁটতাম, রোদে বারান্দায় বসে থাকতাম ১৫-২০ মিনিট। এ ছাড়াও প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময়ে লাংস এক্সারসাইজ সহ অন্যান্য কিছু হালকা ব্যায়াম করতাম, ঘরের টুকটাক কাজ করার চেষ্টা করতাম। মূল কথা হলো বসে থেকে করোনাকে প্রশ্রয় দিতে চাইনি। মানসিকভাবে প্রফুল্ল থাকার জন্য নিয়ম করে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের সাথে ফোনে কথা বলতাম, মুভি দেখতাম, গান শুনতাম। এক কথা দুশ্চিন্তা থেকে যেভাবে নিজেকে ডাইভার্ট রাখা যায়, সে চেষ্টাই করতাম।

করোনা পজিটিভ হওয়ার ১১ দিন পর আবার করোনা টেস্ট করতে দেই, এবং এবার নেগেটিভ হই। আব্বু-আম্মু ছাড়া বাসার কাউকেই হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়নি, সবাই বাসাতেই ট্রিটমেন্ট নিয়ে নেগেটিভ হয়েছে। সবার শেষে, ২০ দিন হাসপাতালে থেকে, অতঃপর করোনা নেগেটিভ হন বাবা। 

করোনা নেগেটিভ হয়েছি ঠিকই, কিন্তু পরবর্তীতে সবাইকেই কিছু না কিছু জটিলতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। যেমন আমার কোমড় থেকে পা পর্যন্ত ভয়ানক ব্যথা সহ্য করতে হয়েছে। আম্মুকে মামসের জন্য পুনরায় হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে, আর বাবার হয়েছে ইউরিন ইনফেকশন। করোনা সম্ভবত আমাদের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা খানিকটা কমিয়ে দিয়েছে। 

তবে এটাই স্বস্তির যে করোনার কারণে বড় ধরনের কোনো ক্ষতির সম্মুখীন আমরা হইনি, আল্লাহর রহমতে সুস্থ হয়েছি প্রত্যেকেই। 

করোনাজয়ী হিসেবে সবাইকে বলবো, করোনাকে ভয় পাবেন না। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা ভীষণ জরুরি। এটা নিশ্চিত করুন। আম্মুকে হাসপাতালে ভর্তি করার পর ডাক্তারেরা বলেছেন আর দুইদিন দেরি করলে হয়তো অনেক কিছু হয়ে যেতে পারতো। তাই সবাইকে অনুরোধ, অবহেলা না করে সময় থাকতে সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিত করুন। কারণ করোনা এমন একটা রোগ, আপনি উপরে দিব্বি ভাল আছেন বোঝা গেলেও দেখা যাবে ভেতরে আপনার বড় কোনো ক্ষতি সে করে ফেলেছে। অতএব, ভয় না পেয়ে সাহসিকতার সাথে মোকাবিলা করুন, জয় আপনার হবেই। 

শেয়ারঃ


করোনাজয়ী'র গল্প