৫ জুন। বিশেষ ফ্লাইটে আমার মা ফিরে গেলেন নিউইয়র্কে, তার সংসারে। আমার ৮২ বছর বয়সী বৃদ্ধা মায়ের সেদিনই জ্বর এলো। আমার মেয়েকে জানালা থেকেই বিদায় জানালো মা। কাছে ভিড়তে দিলেন না। তারও দিন ১৫ আগে থেকেই আমার ইমিডিয়েট ছোট ভাই ফরহাদের ওয়াইফ রুকসু করোনায় আক্রান্ত। রুকসুর দুলাভাই বরিশালে বেশ নামকরা ডাক্তার। তার টেলি মেডিসিনে রুকসুর চিকৎসা চলছে। তার অক্সিজেন স্যাচুরেশন লেভেল কমে ৯০ তে নেমে গেল। ৯৫-১০০ থাকাটা স্বাভাবিক। অক্সিজেন সিলিন্ডার জরুরী দরকার।
এদিকে সিলিন্ডার ব্যাবসায়ীরা সিন্ডিকেট করেছে। কেউ চাইলেই দেয় না। অনেক ঘুরিয়ে-পেচিয়ে একসময় যখন বলবেন যা দাম লাগে দেব তখন বলবে দেখি পাই কিনা। আমাদের বাসা ঢাকার খিলগাঁওয়ে। ফরহাদ মিরপুর চলে গেল সিলিন্ডার কিনতে। আমি পাশের এক হাসপাতালের ম্যানেজারের সাথে কথা বলে কাছেই ইমারুল নামের একজনের সন্ধান পেলাম। সে আমাকে চেনে। ফোন করতেই সেই কথার মার প্যাঁচ।। দেখি স্যার পাই কিনা টাইপ কথা। যখন বললাম টাকা যা লাগে দেব তখন সে একটা সম্ভাবনার কথা জানালো। বললো সন্ধ্যা নাগাদ পেতে পারি। ফরহাদের সাথে তার যোগাযোগ করিয়ে দিলাম। অনেকগুন বেশী দামে একটা অক্সিজেন সিলিন্ডার কেনা হলো।
ফরহাদ নিজেও পজেটিভ। কিন্তু তার সিম্পটম নাই। বাসায় একে একে সবাই পজেটিভ হয়ে গেল- শুধু দুজন বাদ থাকলো। বোনের মেয়ে তাহিরা আর ছোট ভাই ফাহিম। আম্মার টেস্ট করালাম। IEDCR এ এক নাগাড়ে তিন দিন ধর্ণা দেয়ার পর বাসায় এসে স্যাম্পল নিয়ে গেল। দু'দিন পরে ইমেইল পেলাম- পজেটিভ। আম্মার হাঁপানি দীর্ঘদিনের। নিয়মিত ইনহেলার নিলে, ওষুধ আর নেবুলাইজিং করলে সুস্থ থাকে। পালস অক্সিমিটারে তার অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে যাচ্ছে। সিলিন্ডার প্রয়োজন আরো। দুটো সিলিন্ডার যোগাড় হলো আরো। একজন মহানুভব তার ভাড়ায় আনা সিলিন্ডার দিয়ে দিলেন।
রুকসুর অবস্থা খারাপের দিকে যেতে লাগলো। ইঞ্জেকশন দিতে হবে, দেয়ার জন্য কাছের অতি পরিচিত হাসপাতালটির অথোরিটি রাজী হলো না। কোভিড পেশেন্টকে তারা সার্ভিস দেয় না। ফরহাদকে বল্লাম ইউটিউব দেখে শিখতে। সে ইউটিউব দেখে ইঞ্জেকশন দেয়া শিখলো এবং তার স্ত্রী রুখসুকে নিজেই কয়েকদিন ধরে অনেকগুলো ইঞ্জেকশন দিল।
আমি, আমার ওয়াইফ বেনজীর আর ছেলে রাফিদ ১৬ জুন থেকে অসুস্থ হলাম। ১৭ জুন কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল রাজারবাগে গিয়ে সবাই স্যাম্পল দিলাম। ১৮ জুন সবাই কোভিড-১৯ পজেটিভ হিসাবে রিপোর্ট পেলাম। ভর্তি হলাম রাজারবাগ পুলিশ হসপিটালে। খুব যে বিস্মিত হলাম তা কিন্ত না।যেহেতু আমি পুলিশ কর্মকর্তা। করোনা শুরু থেকে সকলে লকডাউন পালন করলেও আমাদের জন্য এজ ইউজুয়াল অফিস ছিল।
শুরু হলো যুদ্ধ। আমার অক্সিজেন লেভেল নেমে গেল। শুরু থেকেই ২৪/৭ অক্সিজেন নিতে হয়েছে। প্রচণ্ড বুকে ব্যথা ছিল। রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে ডাক্তার নার্স সকলেই সার্বক্ষণিক বেশ ভাল সার্ভিস দিয়েছে অসংখ্য সীমাবদ্ধতার মধ্যেও। দিনে একবার ডাক্তার আসতেন, গেটের সামনে দাঁড়িয়ে সমস্যা শুনে ব্যবস্থাপত্র দিতেন।
আমার স্ত্রীর ঠান্ডা সংক্রান্ত বিভিন্ন জটিলতা আগে থেকেই ছিল। করোনার আঘাতে সে একেবারে কাহিল হয়ে গেলো। ডাক্তারের পরামর্শে তাকে ৩৫টা ইনজেকশান দেয়া হলো। টানা ৭/৮ দিন সে বলতে গেলে কিছুই খেতে পারেনি।প্রচন্ড দূর্বল ছিল পুরোটা সময়। এতটা শারীরিক কষ্ট ভোগ করেছে সে, যা চোখে দেখে সহ্য করা যায় না। বাথরুমে পর্যন্ত আমাদের ছেলেটা তাকে ধরে নিয়ে যেত। তুলনামূলক আমার ছেলে ভাল ছিল। কারণ বয়সটা তার ফেভারে।
একটা পরিবারে সবাই অসুস্থ। মোট ১০ জন! সময়টা কেমন দুঃস্বপ্নের মতো ছিল তা বুঝিয়ে বলা সম্ভব না। এমন দুর্দিন আল্লাহ কাউকে না দেখাক। বিশেষ করে আমার মা যাকে পুরোপুরি আল্লাহর হাতে সোপর্দ করে দিয়েছিলাম। ৮২ বছর বয়সে করোনা জয় আসলে এক প্রকার মিরাকলই বটে! আল্লাহর খাস রহমত ছাড়া সম্ভব না!
সদ্য করোনামুক্ত রোগী হিসাবে সবার সামনে কিছু বলার ক্ষুদ্র প্রয়াস।
১. পজিটিভ হলে, আতংকিত হওয়া যাবে না- পরম করুণাময়ের উপর অশেষ ভরসা রাখতে হবে।
২. একজন নির্ভরযোগ্য চিকিৎসকের
সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ রাখতে হবে। প্রথমেই তিনি কমন কিছু ঔষধ দেবেন। তা নিয়ম মেনে খেতে হবে।
৩. করোনাকালীন শরীরের অক্সিজেন স্যাচুরেশন পালস অক্সিমিটার দিয়ে ঘন ঘন চেক করতে হবে। এসময়ে বাসায় পালস অক্সিমিটার রাখাটা জরুরী।
৪. অক্সিজেন স্যাচুরেশন লেভেল ৯৪/৯৩% হলে বা তার নিচে নেমে গেলে বাসায় বসে অথবা বাসায় সম্ভব না হলে হসপিটালে গিয়ে অক্সিজেন নিতে হবে।
৫. করোনাকালীন শরীরে পুরানো অসুখ থাকলে সেগুলো আবার দেখা দিতে পারে, তার পৃথক চিকিৎসা করাতে হবে।
৬. পর্যাপ্ত পরিমাণ তরল খাবার খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
৭. কাশির সমস্যা হলে ওষুধের পাশা-পাশি ঘরোয়া চিকিৎসা নিতে হবে। সারাক্ষণ মুখে লবঙ্গ দিয়ে রাখলে উপকার হতে পারে।
৯. খুব বেশী এসিডিটি হতে পারে। চিকিৎসা নিতে হবে।
১০. পেট খারাপ হলে শরীরে শক্তি ধরে রাখার জন্য ওরস্যালাইন খাওয়া যেতে পারে, যদি প্রেশার হাই না থাকে।
১১. সবার কিন্ত জ্বর থাকে না, জ্বর থাকুক বা না থাকুক অন্তত ১৪ দিন সমস্ত নিয়মবলি মেনে চলতে হবে। আমার তেমন জ্বর ছিল না। তবে আমার ওইয়াফের টানা ৬/৭ দিন ১০৪ পর্যন্ত জ্বর ছিল।
১২. ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী রক্তের কিছু টেষ্ট করাতে হতে পারে। রক্তের টেষ্টের রিপোর্ট দেখে ডাক্তার ব্লাড থিনার জাতীয় ওষুধ/ইঞ্জেকশন সাজেষ্ট করবেন। সাথে আরো কিছু ওষুধ দিতে পারেন। যাতে শরীরে রক্ত জমাট বাঁধতে না পারে। (আমাকে এবং আমার ওয়াইফ দুইজনকেই দিয়েছিলেন)
১৩. চেষ্টের এক্সরে/ সিটি স্ক্যান করা লাগতে পারে। এরপর অবস্থা দেখে ডাক্তার চিকিৎসা দেবেন।
১৪. বয়সের তারতম্য অনুযায়ী একেকজনের একেক রকম সিম্পটম দেখা যাবে।
১৫. অক্সিজেন কমে যাওয়া আর শ্বাস কষ্ট এক উপসর্গ নয়। শ্বাসকষ্ট হলে আইসিইউতে নিয়ে ভেন্টিলেশান দেয়া লাগতে পারে। রোগী স্বাভাবিক শ্বাস নিতে অক্ষম হলেই কেবল ভেন্টিলেশন দেয়া হয়।
১৬. প্রথম উপসর্গ দেখা দেয়ার ১৮/১৯ দিন পর আবার টেষ্ট করাতে হবে। নেগেটিভ হলেও ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে।
১৭. এই সময় কিছু শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে। কোয়ারেন্টাইন টাইমে ঠিক মত খাওয়া দাওয়া করলে জটিলতা দূর হয়ে যাবে। এবং অবশ্যই ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ রাখতে হবে।
১৮. যথাসম্ভব ভিটামিন সি, ডি যুক্ত খাবার খান।
আমার ৮২ বছর বয়স্ক মা বাসায় বসেই ৩০ দিন অক্সিজেন নিয়েছেন। বাসায় বসেই চিকিৎসা নিয়ে আল্লাহর রহমতে ৪০ দিন পরে করোনা মুক্ত হয়েছেন। আল্লাহ তাঁকে দীর্ঘজীবি করুন। তাঁর অ্যাজমা সহ বার্ধক্যজনিত বেশ কিছু জটিলতা ছিল। অথচ তিনি এই সময়ে শ্বাস কষ্টে ভোগেননি। অন্যদিকে আমাকে কিন্তু হসপিটালাইজড হতে হয়েছে। কাজেই আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়ার কিছু নেই।
সবাই সুস্থ থাকুন। নিরাপদ থাকুন। যতটা সম্ভব ঘরেই থাকুন।
লেখক: শেখ এম এ যাহিদ
সিনিয়র এ এস পি, হিউম্যান ট্রাফিকিং এন্ড ভাইস স্কোয়াড, অর্গানাইজড ক্রাইম, সি আই ডি, ঢাকা।