দুইদিন আগেই আমার এক বন্ধুর বাবা শ্বাসকষ্টজনিত কারণে মারা গেল। বেশি দিন হয়নি আমার পরিবারে আমি সহ আমার বাবা মা কোভিডে আক্রান্ত হয়েছিলাম, এবং আমার বাবা-মা দুজনই সিভিয়ারলি আক্রান্ত হয়ে ৭ দিন হাসপাতালে ভর্তি ছিল। ক্ষুদ্র এক ভাইরাসের কারণে যথেষ্ট ভুগতে হয়েছে সবাইকে। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তাই কিছু ব্যাপার শেয়ার করছি, যদি কারো উপকার হয় তাতে।
২৯ জুন সকাল থেকে আমার বাবার কাশি, আমরা ভাবছি আব্বুর তো এমনিতেই কাশি হয়, কিন্ত সাথে রাতে এলো জ্বর। পরের দুইদিনও জ্বর ছিল, তখন আমি টের পেয়ে বলেছিলাম টেস্ট করতে, আব্বুর ভাষ্য- "আমি তো বের হই নাই, এটা নরমাল ভাইরাস জ্বর।"
২ জুলাই আমার জ্বর এলো, আমি আর আমার মা তখন বুঝতে পারছিলাম যে আমরা আব্বুর সেবা যত্ন করছি কাছে গিয়ে, সম্ভবত টেস্ট করতেই হবে কোভিডের। আমাদের সবার যেহেতু উপসর্গগুলো দেখা দিচ্ছে, তাই এটা করোনা হওয়ার ভালো সম্ভাবনা আছে। টেস্ট করলাম।
৪ জুলাই রিপোর্ট এলো, আমরা সবাই পজিটিভ, এমনকি আম্মুরও। অথচ আম্মুর সিম্পটমও ছিলনা তখন। ৪ জুলাই আবার আব্বুর জ্বর চলে গেছে, আমার টেম্পারেচার তখন ১০৩ ডিগ্রির কাছাকাছি। আমরা সবাই কোভিড হলে দেওয়া কমন ওষুধগুলো ইভারমেক্টিন, ডক্সিক্যাব, জিংক, মোনাস- ইত্যাদি খাচ্ছিলাম।
আমার বড় বোন অস্ট্রেলিয়ার তাসমিনিয়াতে জেনারেল ফিজিশিয়ান হিসাবে ইন্টার্ন ডক্টর, আর মামা ক্যান্সারের ডাক্তার। সেকারণে তাদের পরামর্শ নিয়ে ঔষধ খাচ্ছিলাম। সাথে তারা একজন কোভিড স্পেশালিস্ট ঠিক করে দিয়েছিলেন চট্টগ্রামের, তিনিও পরামর্শ দিয়েছেন। মূলত তার পরামর্শ মেনেই কাজ করেছি, যেহেতু তিনি কোভিডেরই স্পেশালিস্ট।
*আপু এবং ডাক্তার দুজনেই বললেন আমাদেরকে চেস্ট এক্সরে (ফুসফুসে কোন ধরণের ইনফেকশন হয়ে যাচ্ছে কিনা তা দেখার জন্য) আর ডি-ডাইমার টেস্ট (ব্লাড ক্লটিং হচ্ছে কিনা যার কারণে হার্ট অ্যাটাক হয়) এই দুইটা টেস্ট করে ফেলতে, করালাম। টেস্টের রেজাল্ট এলো, দুইটাই ভাল অবস্থায় আছে। মানে আমরা ঘরে থেকে সুস্থ হয়ে যাওয়ার পথে- এরকম আভাস পেলাম। বাবা মার অক্সিজেন স্যাচুরেশনও কখনও কমেনি এর মধ্যে।
এরপর আম্মুর জ্বর এলো,আব্বুর জ্বর নেই, এরকম অবস্থা থেকে দুইদিন পরে আবার হাই হয়ে গেল। আমার তিন দিন জ্বর ছিল, এরপর আমি মোটামুটি সুস্থ। জুলাইয়ের ৯ তারিখ মামা, আপু বলল যেহেতু ১০ দিনের কাছাকাছি আব্বু আম্মুর জ্বর যাচ্ছে না, আব্বু হিঁচকির কারনে ঘুমাতে পারছে না, তাই তারা এবার ফুসফুসের আরেকটা বড় টেস্ট 'চেস্ট সিটি স্ক্যান' করাতে বলল। অনেক সময় চেস্ট এক্সরে রিপোর্টে ফুসফুসের ইনফেকশন বোঝা যায় না। তাই সোজা সিটি স্ক্যান করে ফেলা উচিত। যেহেতু এটার উপর ফুসফুসের আর কোন টেস্ট নেই।
সিটি স্ক্যানের রেজাল্ট দিলো, আব্বা আম্মার দুইজনেই লাং ব্যাক্টেরিয়াল ইনফেকশন এ আক্রান্ত, নিউমোনিয়া, যেকোন সময় ফুসফুসের অক্সিজেন সরবরাহ কমে বিশাল শ্বাসকষ্ট হতে পারে, মূলত কোভিড ইমিউন সিস্টেম দূর্বল করে দেয়, তাই লাংসে ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন অনেক বেড়ে নিউমোনিয়া হয় এবং এরপর শ্বাসকষ্ট হয়। এটা থেকে পরিত্রানের উপায় আছে, ডাক্তারের পরামর্শে হাই ডোজের কতগুলো এন্টিবায়োটিক ইনজেকশন নিতে হয়।
৭ দিন বা ক্ষেত্রবিশেষে ৭ দিনের বেশি সময় ধরে এই ইনজেকশনগুলো নেয়া লাগে। এগুলো নিলে নিউমোনিয়া চলে যেতে পারে, ব্লাড ক্লটিং রোধ করার জন্য রক্ত তরলের ইঞ্জেকশন পুশ করতে হয়, আর ৭-১৪ তম দিনেই করোনার ক্ষতি বেশি করে এটা জেনে রাখা উচিত। আমার এক বন্ধুর বাবা মাস খানেক আগে ব্লাড ক্লটিং হয়ে হার্ট এটাক করে করোনায় মারা যায়, যদি ডি ডাইমার টেস্ট টাইমলি করতো এবং ধরা পড়তো যে তার বাবার ক্লটিং হচ্ছে, তাহলে সামান্য কয়েকটা ইঞ্জেকশন নিয়ে হয়তোবা আঙ্কেল বেঁচে যেতে পারতেন।
অনেকের ফুসফুস ইনফেক্টেড হয়ে শ্বাসকষ্ট হয়ে মারা যায়, কোন জ্বর-কাশি কিচ্ছু নেই, প্রথম কয়েকদিন ছিল জ্বর, এরপর চলে গেছে, অনেকদিন না থেকে আবার এলো এবং হঠাৎ শ্বাসকষ্ট হয়ে মারা গেল আমাদের এক প্রতিবেশী। তাই সে যদি সিটি স্ক্যান করত তাহলে ধরা পড়তো যে তার লাংস ইনফেক্টেড, তখন সে যদি ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী টাইমলি এন্টিবায়োটিক ইনজেকশন + ফেভিপিরাভির(এন্টিভাইরাল ড্রাগ), কিংবা ডাক্তারের পরামর্শে রেমডেসেভির নিতো তাহলে লাং ইনফেকশন চলে যেত, এন্টিভাইরাল ড্রাগের কারনে ভাইরাসের রেপ্লিকেশন আটকে থাকতো, সময়ের সাথে ভাইরাসও মরে যেতো, শ্বাসকষ্টের পর্যায় পর্যন্তই পৌঁছাতোই না।
১০ জুলাই আমরা আব্বু-আম্মুকে হসপিটালে ভর্তি করাই, ১৭ জুলাই পর্যন্ত দুজনেরই এন্টিবায়োটিক ইঞ্জেকশন, রক্ত তরলের ইঞ্জেকশন ও ফ্যাভিপিরাভির এন্টিভাইরাল ড্রাগটি চলতে থাকে। ১৮ জুলাই তাদের ইনফেকশন চলে যায়। এসব ইঞ্জেকশন লোক এনে বাসায়ও দেওয়া যায় চাইলে।
আমার কথার সারমর্ম হচ্ছে, খুব দ্রুত চিকিৎসা করলে এই রোগ নিরাময়যোগ্য।
এরজন্য সিটি স্ক্যান আর ডি-ডাইমার টেস্টের গুরুত্ব অনেক বেশি, যাতে আপনার বাবা-মা বা কোন মুরুব্বির সিম্পটম নাই বা কম থাকা সত্ত্বেও ফুসফুস পুরো ইনফেক্টেড হয়ে যাচ্ছে কিনা তা আপনি জানতে পারেন। অনেকে কোভিডের টেস্ট করতেই ভয় পায়, তারা এই দুইটা টেস্ট মাস্ট করাবেন কমপক্ষে আপনার পরিবারের ৪০+ এইজড কাউকে, কম বয়স যাদের তাদের ইমিউউন সিস্টেম স্ট্রং থাকার কারণে তারা হয়তোবা বেঁচে যেতে পারে, কিন্তু তাদেরও করিয়ে ফেলা উত্তম, কোন রিস্ক না নিয়ে।
সিনিয়র সিটিজেন কারো সিম্পটম দেখা দেওয়ার সাথে সাথে ডি-ডাইমার টেস্ট আর সিটি স্ক্যান করে ফেলতে পারেন, ২য় দিন এবং ৭ম দিন বা ৮ম দিনে এই দুইবার টোটাল টেস্ট করানো উচিত। একই টেস্ট দুইবার করাবেন কারণ প্রথম দিনগুলোয় ভাইরাস লাংস পর্যন্ত না যেও থাকতে পারে তাই ৭ম ৮ম দিনে একই টেস্ট আবার করতে হয়, যাতে ফুসফুসে ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে...