এগিয়ে চলো এক্সক্লুসিভ

আমার গল্পের হিরো আমার হাজব্যান্ড!

14 / 30

আমার গল্পের হিরো আমার হাজব্যান্ড!

আমার গল্পের হিরো আমার হাজব্যান্ড!
  • পড়তে সময় লাগবে মিনিট
  • পড়তে সময় লাগবে মিনিট

ইরানা সাবরীন

করোনা ভয়াবহতা যখন থেকে শুরু হচ্ছিলো তখন থেকেই আমি আর আমার হাসবেন্ড ওয়ার্ক ফ্রম হোম শুরু করি। বাইরে যাওয়া সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেই। এভাবেই চলছিল, কিন্তু কত দিন সম্পূর্ণ বন্ধ রাখা যায়? বাজারে তো টুকটাক যেতেই হবে, বাজার বলতে পাশের একটা সুপার শপে যাওয়া। তাও সব নিয়ম মেনেই করেছি, প্রতিদিন করোনা আপডেট দেখে ভয় পাচ্ছিলাম আর নতুনভাবে সতর্ক হচ্ছিলাম। কিন্তু তাও  কিভাবে কোথা থেকে জানিনা এই করোনা আমার পরিবারেও হানা দিলো। 

জুনের শুরু থেকেই আমার মায়ের (শাশুড়ী মা) বেশ জ্বর এলো, এই আসে এই যায় অবস্থা। আস্তে আস্তে জ্বরের তীব্রতা বাড়ে, লক্ষণ দেখে রিলেট করার চেষ্টা করি জ্বরের সাথে আর কিছু সমস্যা হচ্ছে কিনা। কিন্তু জোর করেই নিজেদের মানানোর চেষ্টা করছিলাম যে না, এটা নরমাল জ্বর। কিন্তু ভয়টা বাড়ে যখন দেখি এন্টিবায়োটিক ঔষধেও কাজ হচ্ছিলো না। হুট করে দেখি আমার হাসবেন্ডেরও জ্বর এলো, সাথে শরীর ব্যথা। ও কোনো খাবারের স্বাদ গন্ধ পাচ্ছিলো না, তখন গিয়ে বুঝতে শুরু করলাম এসব নরমাল জ্বর নাও হতে পারে। 

Caption

ঔষধের সাথে সাথে দুইজনকেই বাকি সব উপায়ে ট্রিটমেন্ট দেয়ার চেষ্টা শুরু করলাম, আর করোনা টেস্টের জন্য খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম যে কোথায় করবো, কোথাও খালি স্লট নেই তখন। এই করতে করতে আমার হাসবেন্ডের জ্বর-ব্যথা সেরে যেতে থাকল। কিন্তু মায়ের শরীর দুর্বল হতে থাকল ক্রমাগত। সেইসঙ্গে কাশি বেড়ে গেল, আর তখনই আমার একদিন জ্বর আসে, সাথে প্রচন্ড ঠান্ডা সর্দি। পাশাপাশি গলাব্যথায় অবস্থা খারাপ। 

অবশেষে টেস্ট করতে পারলাম, আমার  পনেরো মাসের ছোট বাচ্চাটা আর মা কে নিয়েই বেশি ভয় পাচ্ছিলাম। টেস্ট  এর রেজাল্ট এ আমার আর মায়ের পজিটিভ এলো আর আমার হাজব্যান্ড আর বাচ্চার নেগেটিভ। হঠাৎ করেই এত্ত ভয় পেয়ে যাই যে কিভাবে কি করবো, আমার এত ছোট বাচ্চাটা কিভাবে থাকবে মাকে ছেড়ে, আমি কিভাবে থাকবো বাচ্চাকে রেখে আলাদা। আমরা কিভাবেই বা আইসোলেশন মেইনটেইন করবো, আর যেভাবে চারপাশে মৃত্যুর খবর আসছিলো যে রীতিমতো ঘাবড়ে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। 

সেদিন থেকে শুরু হলো আমাদের করোনাযুদ্ধ। আমার ছোট বাচ্চাটা যখন মাম্মা মাম্মা বলে কাঁদতো তখন আর সামলাতে পারতাম না নিজেকে, ডক্টরের আন্ডারে থেকে মেডিসিন নেয়া শুরু করি, আর বুঝে যাই যে, কোনো ঔষধই আসলে করোনা এর জন্য না,সবই হচ্ছে বডির ইমিউনিটি সিস্টেম বাড়ানোর ঔষধ, তো এটাই মাথায় এলো যে, করোনার মেইন ঔষধ হলো 'সাহস'। 

প্রতিনিয়ত ভিডিও কলে বাচ্চাকে যখন দেখতাম তখনি মনে হতো আমাকে বাঁচতেই হবে। প্রতি ঘন্টায় মশলা পানি লেবু মধু দিয়ে গরম করে খাওয়া, লবঙ্গ পানি ফুটিয়ে ভাপ নেয়া, তীব্র মাথা ব্যথায় যখন কোনো ঔষধে ধরতো না তখন মেনথল দিয়ে গরম পানির ভাপ নেয়া, মানে কি করিনি এই কদিনে! প্রতি ঘন্টায় সব ধরণের মশলা (দারুচিনি, এলাচ, লবঙ্গ, কালোজিরা, তেজপাতা) দিয়ে ভালো ভাবে পানি ফুটিয়ে তাতে লেবু মধু লবন দিয়ে খেতাম, চা পাতা দিতাম না যাতে ঘুমের অসুবিধা না হয়। মেপে প্রচুর কুসুম গরম  পানি খেতাম, প্রতি দুই ঘন্টা পরপর পানি আর লবঙ্গ ভালো ভাবে ফুটিয়ে  ভাপ নিতাম। 

তীব্র মাথা ব্যথায় ওষুধ কাজ করতো না, তখন গ্রাম পানির ভাপে মেনথল  মিলিয়ে ভাপ নিতাম, দৈনিক চারটা মাল্টা সহ আমি লিচু, আনারস মানে যা যা ফল পেয়েছি খেয়েছি। প্রতিদিন একটা করে হাঁসের ডিম সিদ্ধ করে খেয়েছি। হালকা এক্সারসাইজ করেছি, গোসলে ডেটল মিশিয়ে কুসুম গরম পানি ব্যবহার করেছি। শুরুতেই শুধু বাসায় পরার দুইটা জামা বের করে রেখেছিলাম যাতে আলমারি ওয়ার্ডরোব খুলতে না হয়। রুমের জানালা খুলে সকালের রোদ গায়ে লাগাতাম, অক্সিজেন স্যাচুরেশন, প্রেশার ঠিক আছে কিনা চেক করতাম, খাবারে কোনো ধরণের স্বাদ গন্ধ পেতাম না। মনে হতো কাগজ চাবাচ্ছি, তাও গিলে গিলে খেয়েছি। এতো দুর্বল লাগতো যে 
শরীর ভেঙে আসতো তাও হালকা এক্সারসাইজ করার চেষ্টা করেছি। 

এখন বলি আমার সিম্পটমস গুলোর যন্ত্রণার কিছু কথা। আমার জ্বর শুধু দুই দিন এসেছিল। কিন্তু ঠান্ডা, সর্দি আর গলা ব্যথাটা এতটাই তীব্র ছিল যে মনে হচ্ছিলো গলার ভেতরে কোথাও বাজেভাবে কেটে গেছে, কথা বলতেও কষ্ট হতো। মাথা ব্যথা এত বেশি হতো যে গলগল করে বমি করতাম, সাথে রক্ত যেত। শরীরজুড়ে প্রচণ্ড ব্যথা ছিল, আর ছিল দুর্বলতা। একা হেঁটে যেতেও পা বাড়ানো সমস্যা মনে হতো। 

স্বামী ও সন্তানের সঙ্গে করোনাজয়ী ইরানা সাবরীন

নিজে যা যা করতাম সব মাকেও করিয়েছি, কিন্তু অক্সিমিটারে এবার মায়ের অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমতে লাগলো। আবার ভয় পেয়ে গেলাম, নিজেও দুর্বল হয়ে যাচ্ছিলাম। বাসায় অক্সিজেন সিলিন্ডার ম্যানেজ করে মাকে অক্সিজেন দিতাম, প্রচুর ফল, আর পানি ছিল রোজকার রুটিন। কিন্তু আইসোলেশনের লাইফ তো আর মুখের কথা নয়, তাও আবার এত ছোট বাচ্চা রেখে। রুমে বসে শুনতাম বাচ্চার কান্না, কিন্তু কাছে যাওয়ার উপায় নেই। 

এই পুরো সময়টাতে আসলে এক্সট্রা কিছু করার মন মানসিকতা ছিল না, একটাই লক্ষ্য ছিল শরীর থেকে এই জীবাণু কিভাবে ধ্বংস করবো। আস্তে আস্তে মায়ের শরীর ভালোর পথে এগিয়ে গেল, আমার লক্ষণ কমতে শুরু করল। ১৬ দিন পর আবার টেস্ট করলাম। মায়ের নেগেটিভ এলো, কিন্তু আমার সেই পজিটিভই এলো আবার। 

এবার মানসিক ভাবে খুব ভেঙেই পড়তে যাচ্ছিলাম, কিন্তু তখন আমার কাছের মানুষরা প্রতিনিয়ত আমার সাথে করোনা থেকে বেঁচে ফেরা মানুষদের গল্প শেয়ার করতো, আর সেটা যে আমাকে কি সাহস দিয়েছে তা বলার বাইরে। এভাবে আস্তে আস্তে আবার টেস্ট করানোর সাহস পাই, আর আল্লাহর অশেষ রহমতে অবশেষে রেজাল্ট নেগেটিভ হয়। 

এবার আসি, এই পুরো সময়টাতে কিভাবে আমার ছোট বাচ্চা, আমাদের দেখাশুনা সব ম্যানেজ হয়েছে। এসব হয়েছে আমার হাসবেন্ডের কারণে, ও এই এতটা দিন একাই আমাদের বাচ্চার খাওয়া, ঘুম, গোসল, খেলা, সব সামলেছে। আমাদের যত্ন করেছে, ও আমাকে সাহস দিয়েছে এই বলে যে বাচ্চা তো দুজনেরই তাহলে মায়ের কাজ/বাবার কাজ আবার আলাদা কি কথা? আমার হাসবেন্ড নিজের মাকেও সাহস দিয়েছে যে আম্মু তোমার তো ক্যান্সার ও হয়েছিল আর তুমি ফিরে এসেছো আর এবার তো সামান্য করোনা, এবার পারবে না?

আমার গল্পের রিয়েল হিরো হলো আমার হাসবেন্ড। এই সময়ে আমার হাজবেন্ড একবার কাঁদতো আবার নিজেই হেসে আমাদের সাহস দিত। মায়ের বয়স হওয়াতে টেনশনে রাতে ঘুম হতো না,যে কখন কি হয়। এই পুরো সময়টা পার করে এটাই বলতে পারি, আল্লাহ যেন কোন মাকে এভাবে তার বাচ্চার থেকে দূরে থাকার কষ্টটা না দেয়। আর এই খারাপ সময়ে সবচেয়ে দরকার হয় মানসিক শক্তি, পজিটিভ সাপোর্ট, সাহস আর নিয়ম মেনে ভালো হওয়ার চেষ্টা। আর হ্যাঁ, সৃষ্টিকর্তার কাছে অনেক কেঁদেছি, শুকরিয়া আদায় করেছি। ভাবতেই পারছি না, আল্লাহ রহমত না করলে কি হতো!

শেষে বলবো, যদি উপরওয়ালা সহায় হন, তাহলে করোনা হলেও বেঁচে ফেরা যায়, শুধু লাগবে চেষ্টা আর সাহস। উদাসীন ভাবে কাজ না করে মনের ইচ্ছাশক্তির জোরে সব নিয়ম মানলে করোনাকেও জয় করা সম্ভব...

শেয়ারঃ


করোনাজয়ী'র গল্প