ভার্সিটি বন্ধ থাকলেও অফিস করতে হতো নিয়মিত। যথেষ্ট সাবধানতার সাথেই যাওয়া আসা করতাম। কিন্তু তবুও শেষ রক্ষা হলো না...
আমরা বন্ধুরা মিলে করোনা দুর্গতদের সাহায্যের জন্য ফান্ড সংগ্রহ করতাম। অফিস টাইমের পরেও তাই অনেকটা সময় বাসার বাইরে থাকতেই হতো৷ বন্ধুর সাথে ফান্ড কালেক্ট করতে গিয়ে একদিন হালকা কাশি দিলাম। পরেই বন্ধু ফাজলামো করে বললো, কিরে বন্ধু, কাশি ক্যান! দেখিস, করোনা দুর্গতদের সাহায্য করতে গিয়ে নিজেই আবার আক্রান্ত হইস না, সাবধানে থাক।
ওর কথাটাই হিট করলো মাথায়! তাই তো! অনেকদিন ধরে শুকনা কাশি হচ্ছে আমার, মা বলেছিল যক্ষা টেস্ট করতে। পরিচিত ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী কাশির সিরাপ-এন্টিবায়োটিকও খেয়েছিলাম৷ কিন্তু কাজ হচ্ছিল না। জ্বর বা অন্য কোনো উপসর্গ ছিল না দেখে করোনা টেস্টের কথাও মাথায় আসেনি। উপসর্গহীন করোনাও তো হচ্ছে! এটার কথা ভুলে যাওয়া ঠিক হয়নি তখন। তাই ভাবলাম পজিটিভ হোক বা না হোক, কোভিড টেস্ট করাতে হবে।
টেস্ট করতে গিয়ে দেখি বিশাল ভোগান্তির ব্যাপার। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে লাইন ধরে সকাল ৭টা থেকে দুপুর ১২ টা পর্যন্ত স্যাম্পল কালেক্ট করা হয়৷ কয়দিন আগেই টাইফয়েড থেকে সেরে উঠেছি। মাথার ওপর চড়া রোদ নিয়ে এভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব ছিল না তাই একেবারেই৷ পরে অফিসের এক বড় ভাইয়ের বদৌলতে অন্য এক জায়গায় সুযোগ পাই আলাদা করে স্যাম্পল দেওয়ার।
মে মাসের ৯ তারিখে স্যাম্পল দেই। যেহেতু কাশি ছাড়া আর কোনো সমস্যাই হচ্ছিল না, তাই মনে মনে ধরেই নিয়েছিলাম নেগেটিভ আসবে রিপোর্ট। ১২ তারিখে রিপোর্ট জানালো- কোভিড পজিটিভ! বিছানায় শুয়ে ছিলাম, উঠে বসলাম। সত্যি বলতে কিছুটা ঘাবড়েও গিয়েছিলাম। বাসায় বয়স্ক বাবা-মা আছে, বোন আছে। কাশি তো অনেকদিন ধরেই। যেহেতু পজিটিভ হয়েছি, তাহলে তো তাদের পজিটিভ হওয়ার আশঙ্কাও আছে।
আমার মা আবার অসুখ-বিসুখে বেশি ঘাবড়ে যান। তাই প্রথমে তাকে বলবো না ভাবলেও পরে সবাইকে একসাথে ডেকে ঘটনা জানালাম। স্বভাবতই মা ঘাবড়ে গেল এবং তার জ্বর চলে আসলো। বাসার বাকীদের করোনা টেস্ট করাতে গিয়ে প্রচুর ঝামেলা পোহাতে হচ্ছিল, একারণে ডাক্তার বলে দিয়েছিল, সবার করোনা পজিটিভ ধরে নিয়েই যেন আলাদা হয়ে যাই। প্রত্যেকেই তখন আলাদা রুমে থাকতে লাগলাম। মায়ের জ্বর ১ দিন পরই ভাল হয়ে গেল, আর বাসার আর কারও কোনো সমস্যা ছিল না। শুধু মা কয়েকবার বলেছে তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। পরে অবশ্য এই সমস্যাও আর থাকেনি।
টানা ১১ দিন আমি ঘরবন্দী ছিলাম, এই ১১ দিনে প্রতিদিন ভোরে উঠে নামাজ পড়েই হালকা ব্যায়াম করেছি, বাসার সামনে খোলা জায়গা ছিল, সেখানে এত সকালে কেউ থাকতো না। আমি মাস্ক পরে সেখানটাতে হাঁটতাম। সাধারণত সকালের নাস্তাটা ঠিকমতো খাওয়া হতো না, কিন্তু এই ১১ দিন খাওয়া-দাওয়ার সাথে নো কম্প্রোমাইজ নীতি মেনে চলেছি। স্বাভাবিক খাবারই খেয়েছি, তবে টাইমলি খেয়েছি। আর প্রচুর চা খেয়েছি, প্রতি বেলায় গরম পানির ভাপ নিয়েছি নাক-মুখ দিয়ে। ডাক্তার কিছু ভিটামিন ও ঔষধ দিয়েছিল, সেগুলো কন্টিনিউ করেছি।
যে রাতে রিপোর্ট জেনেছি, ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে সবাইকে জানিয়েছিলাম যাতে যারা আমার সংস্পর্শে এসেছে, সবাই যাতে নিজ উদ্যোগে টেস্ট করিয়ে নেয় অথবা আলাদা থাকে। একারণে বিল্ডিংয়ের কিছু প্রতিবেশীর কাছ থেকে ফোনকল আসে, অনেকেই সাহস যুগিয়েছেন, একজন আবার বলেছিলেন ফেসবুকে জানানো ঠিক হয়নি, এর কারণে তাদের চলাফেরায় অসুবিধা পোহাতে হচ্ছে৷ কিন্তু পরবর্তীতে তিনি ক্ষমা চান এবং যথেষ্ট আন্তরিকতার সাথে পাশে ছিলেন।
১১ দিনের এই ঘরবন্দী সময়টায় আসলে আমার মনে হয়েছে করোনা যতটা না শরীরের, তার চেয়ে বেশি মনের রোগ৷ শরীরের খুব ক্রিটিকাল কোনো সমস্যা না থাকলে করোনা হলে ভয়ের কিছু নেই, মনে সাহস রাখতে হবে, দুশ্চিন্তা করা যাবে না একদমই। বাসায় থেকেও আমাকে অফিসের কাজ করতে হয়েছে, তাই চাইলেও ব্যস্ততার কারণে আমি দুশ্চিন্তা করার মতো সময় পাইনি।