ঋত্বিক শংকর সেন:
গত মাসের ১৩ তারিখে সাইট থেকে আসার পরে বাবার (আমার বাবা রথীন্দ্র নাথ সেন পেশায় একজন প্রকৌশলী) শরীর ব্যথা করছিল, সেটা উনি আমাদেরকে জানিয়েছিলেনও। জ্বর মেপে দেখা গেল টেম্পারেচার ১০২ ডিগ্রি। পরিস্থিতির কারণে করোনার কথা মাথায় এলেও, নিজেদেরকেই স্বান্তনা দিয়েছিলাম যে এটা ভাইরাস জ্বর হতে পারে, আর শরীরের ওপর দিয়ে যেহেতু ধকল যাচ্ছে, তাই শরীর ব্যথা হওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়। রাতে খাওয়ার পরে যখন জ্বর মাপা হলো, তখন টেম্পারেচার একশোর নিচে ছিল। একারণে আমরা ভেবে নিয়েছিলাম যে রেস্ট নিলেই জ্বরটা সেরে যাবে।
পরদিন সকালে বাবা অফিসে চলে গেলেন, সারাদিন আর মেপে দেখাই হয়নি যে তার জ্বর আছে কিনা। উনিও নিজের শরীর ব্যথা কিংবা খারাপ লাগছে- এরকম কিছুই বলেননি। বরং সন্ধ্যায় বলেছেন যে ব্যথা নেই। মা তবুও তার পিঠে গরম সেঁক দিয়েছিলেন সেদিন। এর পরদিন বিকেলে বাবা হঠাৎ বললেন তার শরীর খারাপ লাগছে। জ্বর মাপা হলো, টেম্পারেচার তখন ১০১ ডিগ্রিতে। আমরা তখন ওকটু ভয়ই পেলাম, মা সাথে সাথে একজন ডাক্তারের সাথে কনসাল্ট করলেন। বাবার প্রেশার এবং ডায়বেটিসের সমস্যার কথা জেনে ডাক্তার একটা ঔষধ দিলেন, বললেন এটা কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তৈরি করবে না।
তিনদিন ধরে জ্বর নামলো না, কখনও একশোর ওপরে, কখনওবা একটু নিচে। সকালে জ্বর থাকতো না, তখন মোটামুটি স্বাভাবিক সবকিছু। হালকা সর্দি আর জ্বর ছাড়া করোনার অন্য কোন উপসর্গই ছিল না। এই জ্বর যখন পাঁচ-ছয়দিন পেরিয়ে গেল, তখন আমরা একটু দুশ্চিন্তায় পড়লাম। জ্বরের প্যাটার্ন কিন্ত আগের মতোই, দিনে থাকে না, রাতে একশো এক ডিগ্রির ওপরে চলে যায়। আগের ডাক্তারের প্রেসক্রাইব করা ওষুধেও কাজ হচ্ছিল না। ঢাকার হেলথ এন্ড হোপ হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডাক্তার লেলিন আমার বাবার বন্ধু, আমরা তখন তার সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। উনি তখন সিভিসি, চেস্ট এক্সরে, ক্রিটেনিন সহ কয়েকটা টেস্ট করতে দিলেন। এটা জ্বর আসার পর অষ্টবম বা নবম দিনের ঘটনা।
টেস্টের রিপোর্ট ভালো ছিল, চেস্ট এক্সরেতেও কিছু ধরা পড়েনি। ডাক্তার তখন করোনা টেস্ট করাতে বললেন, জ্বরের কোন সুনির্দিষ্ট কারণ যেহেতু খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরদিন চট্টগ্রামের ইম্পেরিয়াল হাসপাতালে আমরা চারজনই করোনা টেস্টের জন্য নমুনা জমা দিলাম। বেসরকারী হাসপাতাল হওয়ায় খরচ বেশি হলেও, সেখানে ভীড় তেমন নেই, এবং একদিনের মধ্যেই রিপোর্ট পাওয়া যায়। পরদিন আমরা রিপোর্ট পাই বিকেলে, বাবার রেজাল্ট পজিটিভ, আমরা বাকি তিনজন নেগেটিভ।
রেজাল্ট আসার পরেই কিন্ত আসল বিপত্তি ও চ্যালেঞ্জটা শুরু হয়েছে। কারণ তখন পর্যন্ত উপসর্গগুলো ততটা ভয়াবহ ছিল না। বাবাও শারীরিকভাবে তখনও অতটা দুর্বল হয়ে পড়েননি। একটা চাপা আতঙ্ক তো ছিল সবার মধ্যে, তবে বাবা বাদে আমরা বাকি তিনজন (আমি, মা, ভাইয়া) যেহেতু সুস্থ ছিলাম, তাই ভেঙে পড়িনি। ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলা শুরু করলাম, বাবাকে তার রুমে আলাদা করে ফেলা হলো। এগারোতম দিনে বাবার করোনা পজিটিভ হবার রেজাল্ট পাই আমরা, আর সমস্যা শুরু হয় বারোতম দিন থেকে।
বাবার জ্বর তখন ১০২ এর নিচে নামছেই না। বিকেল থেকে জ্বর বাড়তো, রাত দশটা-এগারো পর্যন্ত থাকতো, সেটা ১০৩-১০৪ এ গিয়েও উঠতো। অক্সিজেন স্যাচুরেশন মেপে দেখতাম ৯০/৯১/৯২- যেটা কিনা একধরনের ক্রিটিক্যাল মোমেন্টই ছিল। ডায়বেটিস পেশেন্ট হওয়ায় সুগার ফ্ল্যাকচুয়েট করছিল খুব বাজেভাবে। কখনও সেটা ১৩ থাকতো, কখনও তিন! খাওয়ার পরেও সুগার লেভেল পাঁচের উপরে উঠানো কষ্ট হতো। এসব কারণে আমরা প্যানিকড হয়ে যাচ্ছিলাম, ভাবছিলাম বাবাকে হাসপাতালে ভর্তি করতেই হবে বুঝি।
এখানে দুইটা মানুষের কথা না বললেই না। একজন আমাদের ডাক্তার লেলিন আংকেল বলে দিয়েছিলেন, "যতক্ষণ পর্যন্ত আমি না বলব, তোমরা হসপিটালে যাবে না। বেশি দরকার হলে একটা অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্যবস্থা করো, আর পেশেন্টকে মেন্টাল সাপোর্ট দাও।" উনার কারণে আমরা ধৈর্য্য ধরতে শিখেছি নতুন করে। চট্টগ্রামেরই আরেক চিকিৎসক, ডাক্তার আরিফ বাচ্চু, উনিও আমাদের প্রচুর সাপোর্ট দিয়েছিলেন, বলেছেন, অক্সিজেন স্যাচুরেশন নব্বইয়ের নিচে না নামলে বাসা থেকে বের হবারই দরকার নেই।
এরমধ্যে বাবার শরীর ক্রমাগত দুর্বল হতে শুরু করে। পানির গ্লাসটা পর্যন্ত হাত দিয়ে ধরতে পারছিলেন না, এমনই ভয়ঙ্কর অবস্থা। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখার যেসব কথা বলা হয়, বাসার মধ্যে কেউ আক্রান্ত হলে সেগুলো মেনে চলা বেশ কঠিন, নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকেই সেটা বুঝতে পারলাম। যে মানুষটা বিছানা থেকে উঠতে পারছে না, পানির গ্লাসটা ধরে পানি খেতে পারছে না, তাকে একটা রুমে একদম আলাদা করে রাখাটা আসলে সম্ভব না কোনভাবেই। বাবার যে করোনা হয়েছে, এটা একরকম ভুলে গিয়েই আমরা তার সেবাযত্ন করেছি, নিজেরাও যে আক্রান্ত হতে পারি, সেটা মাথায় ছিলই না। তাছাড়া শারীরিকভাবে সুস্থ থাকাটাই তো সব নয়, বাবার পাশে সর্বক্ষণ কেউ না থাকলে, কথাবার্তা না বললে, তাকে অভয় না দিলে উনি মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে যেতে পারেন- এই ভয়টাও আমাদের মধ্যে ছিল। একারণে তার কাছে কাছেই ছিলাম আমরা তিনজন।
খাবারে শুরুতে রুচি ছিল, কিন্ত জ্বর যখন ১০২-১০৩ এ উঠে যাচ্ছিল, তখন খাবারের রুচিও চলে যাচ্ছিল বাবার। তখন ডাক্তারের পরামর্শ নিয়েই আমরা তাকে তরল খাবার দিতে থাকলাম, ফলের জুস, স্যুপ এই টাইপের তরল খাবার। পানি গরম করে খাইয়েছি, গোসল করেছেন গরম পানিতে। ডাক্তার বলে দিয়েছিলেন সুগারটা যাতে কন্ট্রোলে থাকে। তিন-চারদিন পর থেকে জ্বর আস্তে আস্তে নামতে শুরু করলো।
প্রথমবার জ্বর আসার ২২তম দিনে আমরা আবার বাবার করোনা টেস্ট করাই, সেটার রেজাল্ট আসে নেগেটিভ। তবে সেই নেগেটিভ রেজাল্টটা খুব বেশি স্বস্তি হয়ে আসেনি আমাদের জন্য। করোনা টেস্টের সাথে সাথে আমরা বাবার চেস্টের সিটি স্ক্যানও করিয়েছিলাম। সেখানে দেখা গেল, কোভিড-১৯ নিউমোনিয়ার কারণে তার দুটো ফুসফুসই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কাজেই করোনামুক্তির যে আনন্দটা, বা একটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচার খুশি- সেটা আমরা পাইনি। ডাক্তার অভয় দিয়ে এটার জন্য কিছু মেডিসিন দিয়েছেন, সেগুলো চলবে আরও কিছুদিন।
আমাদের ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা আসলে অনেকের প্রাপ্য। আমরা যে বিল্ডিংয়ে থাকি, সেখানে আমাদের আরও বেশকিছু আত্মীয় থাকেন। আমাদের সাথে যুক্ত থাকায়, তাদের মধ্যে রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা ছিল। কিন্ত শত মানসিক চাপ ও আতংকে থাকা সত্ত্বেও তারা সর্বাত্মক সাহায্য করেছেন আমাদের, পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। দূরে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা করেননি কেউ, বরং ঝুঁকি নিয়েছেন। বাজার করা, খাবার রান্না করে পাঠানো থেকে শুরু করে ঔষধ এনে দেয়া- সব কাজই তারা করেছেন। কেউ প্রেশার মাপার মেশিন পাঠিয়ে দিয়েছে, কেউ ডায়বেটিস মাপার মেশিন পাঠিয়েছে। শারীরিক এবং মানসিক দুইভাবেই সর্বাত্মক সাহায্য আমরা পেয়েছি তাদের তরফ থেকে। মানবিক আন্তরিকতা এবং মানুষের প্রতি দায়িত্ববোধ নতুন করে অনুভব করেছি আমরা। ভাইয়ার অফিসের আশু ভাইয়াও অসম্ভব পরিশ্রম করেছেন পুরো সময়টায়। যে দুই ডাক্তারের কথা উল্লেখ করেছি, তাদের প্রতিও আমরা অসম্ভব কৃতজ্ঞ।
সবশেষে আমার মায়ের সংগ্রামের কথাটা না বললেই না। একমাত্র তার প্রখর মানসিক শক্তি ও তীব্র সাহসিকতার কারণেই আমরা এই অবস্থা থেকে উঠে আসতে পেরেছি। রোবটের মতো তিনি একদিকে বাবাকে সামলেছেন, অন্যদিকে আমাদের দুই ভাইকে আগলে রেখেছেন। পুরো ঘরের কাজ তিনি করছেন, বাবার জন্য খাবারও রেডি করছেন, কাপড় ধুয়েছেন। কিছুই বাদ দেননি! পরে ভাবলাম আসলে আমাদের মা তো এমনই। কলেজের শিক্ষকতা, সংগঠন ও পরিবার সামলানো, সবটাই তিনি সারাজীবন করে গেছেন যথাযথভাবে। বলতে একটুও দ্বিধা নেই, তার কারণেই এই বিপদ মোকাবেলাটা এত সহজ হয়েছে আমাদের জন্য...