আমি, আম্মু, বড় ভাই-ভাবী, আর আদরের ভাতিজা নিয়ে আমাদের পরিবারের পাঁচ সদস্য। বড় ভাই একটি বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত আছেন। ঘরে সর্বপ্রথম জ্বরটা এসেছিলো তার, ঈদের ঠিক তিনদিন আগে ইফতারের পূর্বে। একই রাতে ভাবীরও জ্বর চলে আসে। এভাবেই ক্রমান্বয়ে আম্মু, আমি ও ভাতিজা- সবাই দুদিনের মধ্যেই জ্বরে আক্রান্ত হই।
পঁচিশ তারিখ রোজার ঈদ ছিল। পরদিন ভাইয়া অফিসে নিজের অসুস্থতা প্রসঙ্গে জানিয়ে কদিনের জন্য ছুটি আবেদন করলে, তারা জানায় করোনা টেস্ট করিয়ে নেগেটিভ রিপোর্টের ক্লিয়ারেন্স নিয়েই যাতে তিনি অফিসে যোগ দেন। প্রথম তিনদিনের উপসর্গে করোনার বিষয়টি আমাদের মাথায় এসেছিলো, তাছাড়া জ্বর আসার পর থেকেই প্রতি মুহুর্তে মনে হতো বুকের মধ্যে কেউ পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে। এ সমস্যাগুলো সকলের মধ্যেই দেখা দেয়। যেহেতু সবার উপসর্গ প্রায় একই, আর জ্বরটাও আছে সুতরাং ভাবলাম করোনা টেস্টের বিষয়টি আমাদের আমলে নেয়ার প্রয়োজন (বিশেষত আম্মুর জন্য)। এর মধ্যে আমি আম্মু এবং ভাইকে জানিয়ে দিই টেস্ট করার আগেই আমাদের কিছুদিনের জন্য যাবতীয় সকল বাজার করে ফেলাটা উচিত হবে। কারণ ফলাফল পজিটিভ আসলে কী মোকাবেলা করতে হবে তা একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কেউ জানেন না। আমার এক বন্ধুকে ডেকে, ওর বাইক নিয়ে যতটুকু পারি কয়েকদিনের বাজার করে নিই।
আর আমি যখনের কথা বলছি, তখন দেশজুড়ে সাধারণ ছুটি চলছে। কোনো ডাক্তার রোগী দেখছেন না, এমনকি হাসপাতালগুলোও সাধারণ রোগী ভর্তিতে ব্যাপক গড়িমসি করছে। চারপাশে চিকিৎসা না পেয়ে মানুষের অহরহ মৃত্যুর খবর সামনে ভেসে আসছিলো। সুতরাং আমাদের আতঙ্কে ভোগা স্বাভাবিক ছিল। সেই সময় জেনারেল হাসপাতালেই মূলত কোভিড টেস্ট হতো। খবর নিয়ে দেখলাম, সেখানেও হাজার বিপত্তি। একদিনে মাত্র ৮০ জনকে টেস্ট করানো হয়, এর ওপর আবার যাদের মধ্যে প্রকোপ কম তাদেরকেও টেস্ট না করিয়ে ফিরিয়ে দেয়া হয়। এমতাবস্থায় দুদিন পরে ভোর চারটায় গিয়ে আমরা দুই ভাই চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে কোভিড টেস্টের জন্য রেজিস্ট্রেশন করি, যা শুরু হয় সকাল ৯ টা থেকে। যাই হোক, টেস্টের তিনদিনের মাথায় আমাদের রিপোর্ট পজিটিভ আসে। আমরা বুঝে নিলাম আমাদের পরিবারের বাকিরাও পজিটিভ।
ঈদের পরদিন থেকেই মায়ের শরীরিক অবস্থা অবনতির দিকে এগোচ্ছিলো। জ্বর ১০৩-০৪ ডিগ্রী পর্যন্ত উঠতো, অস্বাভাবিক দুর্বলতা, আর শক্তিশালী ডায়রিয়া। বমি করেছেন, সেটা পরিষ্কার করতে গেলাম। আবার দেখা গেলো এদিকে তার টয়লেট হয়ে গেল। এন্টিবায়োটিক কাজ করছিলো না। কিছু খেতে পারছিলেন না, খেলেই পায়খানা হয়ে যাচ্ছিলো। মানে কোনো ফলপ্রসূ পরিবর্তন আমরা পাচ্ছিলাম না৷ তা আমাদের মানসিকভাবে আরো দুর্বল করে দেয়।
কোনো কিছুই যেন আমাদের নিয়ন্ত্রণে ছিলো না! এছাড়া লকডাউনের মতো বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম শহরের স্বাভাবিক গতিময়তা পুরোপুরিভাবে লোপ পেয়ে গিয়েছিলো৷ সুতরাং মাকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হলে, সেই ব্যবস্থা করার পর্যাপ্ত সামর্থ্য আমাদের ছিল না। ডাক্তার দেখানো তো পরের কথা, অনেক ডাক্তার সামান্য মোবাইলেও সেই মুহুর্তে কোনো পরামর্শ দিতে চাচ্ছিলেন না। যা আমাদের আরো হতাশায় নিমজ্জিত করে। যদিও পরবর্তীতে বেশ কয়েকজন ডাক্তার আমাদের নির্দেশনা দিয়েছেন, সহায়তা করেছেন।
সময়ের পরিক্রমায় ভাতিজাসহ আমাদের চারজনের উপসর্গগুলো লোপ পেলো, কিন্তু মায়ের জ্বর, ডায়রিয়া, দুর্বলতা এসব প্রায় দুই সপ্তাহের অধিক ছিল। সবচেয়ে ভয় লাগতো যখন ঘাম দিয়ে মা একদম নিস্তেজ হয়ে যেত। পরে ধীরে ধীরে আবার স্বাভাবিক হতেন। সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমত এই যে, পুরো জার্নিতে অক্সিজেন স্যাচুরেশন মোটামুটি স্বাভাবিক মাত্রায় ছিল। ওটা যদি হেরফের হতো আমি জানি না আমরা কোথায় থাকতাম আজ।
এদিকে রিপোর্ট আসার পরদিনই পুরো বিল্ডিং লকডাউন করে দেয়া হয়। বলা ভালো, আমরা বিল্ডিং তো বটেই, পুরো এলাকাতেই প্রথম পরিবার ছিলাম যারা অফিসিয়ালভাবে কোভিড আক্রান্তের সার্টিফিকেট পেয়েছিলাম! এরপরেই শুরু হয়, চারপাশের মানুষের অসহযোগিতার পালা। প্রথমত দারোয়ানগুলো আমাদের চিনতেই চাইছিলো না। এমনকি বাইরে থেকে কোনো আত্মীয় বাজার, ওষুধ বা খাবার নিয়ে আসলে তারা সেটা পর্যন্ত বাসা পর্যন্ত আনতে দিতেও বাঁধা দিতো৷ তাদেরকেও লিফট ব্যবহার করতে দিতো না। এমনকি অক্সিজেন সিলিন্ডার পর্যন্ত অনেক কষ্ট করে ঢোকাতে হয়েছে।
প্রতিদিন বিল্ডিংয়ের ময়লা যিনি সংগ্রহ করেন, তিনিও দারোয়ানসহ অনেকের প্ররোচনায় আমাদের বাসার ময়লা নিতে অস্বীকৃতি জানান৷ পরে এ কাজে একজন লোককে আলাদাভাবে ঠিক করা লেগেছিলো। তাছাড়া বাড়িওয়ালা এবং দীর্ঘদিনের প্রতিবেশীরাও অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করে যদিও আমরা কোনোভাবেই তাদের সহযোগিতা কামনা করিনি। কিন্তু তাদের ন্যূনতম মানসিক সাপোর্ট থেকে আমাদের বঞ্চিত হওয়া, আমাকে পীড়া দেয়। মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেয়া, লিফট ব্যবহার করতে না দেয়ার ঘটনা তো আছেই, তবুও মানুষের নিরাপদে থাকার স্বার্থে সব মেনে নিয়েছি। তবে সবচেয়ে খারাপ লেগেছিলো আমাদের কাজের মহিলার ঘটনায়। তিনি ঈদের আগের দিন যাকাতের টাকা নিতে এসেছিলেন, পরবর্তীতে আমাদের আক্রান্তের খবর সবার কাছে পৌঁছালে উনাকে একদম ঘরে তালা লাগিয়ে বন্দী করে রাখার মতো অমানবিক কাজও ঘটে!
আরেকটি কষ্টের ঘটনা বলি। এর মধ্যে মায়ের কিছু টেস্টের খুব বেশি প্রয়োজন ছিল। আমি উনাকে একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে যাই। সেই মুহুর্তে উনার জ্বর ১০৩। সামনে দরজা দিয়ে দেখলাম টেম্পারেচার মাপা হচ্ছে। আমি ভাবলাম এখন যদি ঢুকতে যাই হয়তো ঢুকতে দিবেই না, আবার অযথা সিনক্রিয়েটও হতে পারে। আমি পেছনের দরজাটি চিনতাম, কোনোভাবে মাকে নিয়ে ঢুকে পড়ি। সব শেষ করে বের হতে যাব, শুরু হয় তুমুল বৃষ্টি। লকডাউনে রাস্তায় একটি সিএনজির দেখা নেই। আবার এদিকে মা দুর্বলতায় দাঁড়াতেই পারছেন না। কোনোভাবে একটি রিক্সা ম্যানেজ করে উনাকে বসাতে যাব, উনার পা হড়কে গেল। প্রচন্ড ব্যথায় উনি গোঙাতে শুরু করে দিলেন, আমার ভিতরটা কেঁপে উঠলো৷ নিজেকে সামলিয়ে কোনোভাবে রিক্সাওয়ালার সহায়তায় তাঁকে বসিয়ে ঘরে নিয়ে আসলাম।
এমতাবস্থায় কদিন পর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সাবজেক্টের ভাইভাতে বসেছিলাম, প্রশ্নের বাণে জর্জরিত হয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত আমি উত্তর দিতে পারছিলাম না। পরিবারের অসুস্থতার কথা জানালে, একজন শিক্ষক ব্যাপারটাকে তামাশা বানিয়ে মজা নেয়। রাগে, ক্ষোভে, কষ্টে সেই এক্সাম থেকে বেরিয়ে পড়ি৷ পরে আমার সহপাঠীরা আমার জন্য একজোট হয়ে প্রতিবাদ জানালে, ভিসি স্যারের হস্তক্ষেপে সেই শিক্ষক দুঃখ প্রকাশ করেন। তাকে বলার মতো কোনো জবাব ছিল না, আর ক্ষমা করারও আমি কেউ নই।
প্রতিনিয়ত হরেক রকমের চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেত, বুকটা ভার হয়ে আসতো। ভাইয়া, ভাবী আর আমি মিলে ঘরে এতোসব কাজ করেছি, ক্লান্তিতে মাঝে মাঝে আল্লাহকে বলতাম আমি আর পারছি না। আমাকে নিয়ে যান। আবার মায়ের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে যেতাম। ভাবতাম উনাকে সুস্থ করে তুলতেই হবে। আল্লাহর নিকট নিয়মিত নামাজ পড়ে অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য দোয়া চেয়েছি। এভাবেই দিনগুলো অতিবাহিত করেছি আমরা।
ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞ অনেকের প্রতি। আত্মীয় স্বজন খোঁজ নেয়ার পাশাপাশি যাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছে যথাসাধ্য আমাদের সাহায্য করেছে। বিশেষত আমার ছোটবেলার প্রিয় বন্ধুর কথা বলবো। সে যেন ফেরেশতা হয়েই এসেছিলো করোনাকালীন পথচলায়। নিজের বাইক ব্যবহার করে, প্রয়োজনীয় সব সহযোগিতা দিতো৷ আমার জন্য সবচেয়ে স্বস্তির বিষয় এটাও ছিল, জ্বর হওয়ার পর আমাদের সংস্পর্শে সে আসার পরেও ওর কিছু হয়নি। বিল্ডিংয়ের একজন তরুণ ডাক্তার নিজের প্রেশার মেশিন আমাদের দিয়েছিলেন৷ মাপতে পারতাম না, ইউটিউব দেখে শিখেছিলাম। এমন অনেক কাজ যা জীবনে কখনোই করিনি, এসব করতে হয়েছে, শিখতে হয়েছে। তীব্র কষ্টের মধ্যেও আমার ভাবীর পরিশ্রম ছিল অনন্য।
ফিরতি পরীক্ষায় আমাদের রেজাল্ট নেগেটিভ ও সুস্থ হয়ে উঠার পরে, আমাদের বিল্ডিংয়ের এক পুলিশ পরিবার করোনায় আক্রান্ত হয়৷ উনি সেই পথচলায় উনার মাকে হারিয়েছেন৷ একটি সংস্থা উনার মরদেহ নিতে আসার পূর্বে নিচে জানাজা হয়। সেই জানাজায় উপস্থিত ছিলো সেই পুলিশ কর্মকর্তা, একজন দারোয়ান এবং আমি। আর কেউ নামেনি, আসেনি। সত্য হলো, কোভিড আমাদের দেখিয়ে দিয়ে গেলো এই সমাজের রূঢ় বাস্তবতা। যদিও আজকে এই পর্যায়ে দাঁড়িয়ে কারো প্রতি আমার এবং আমার পরিবারের কোনো অভিযোগ, অনুযোগ নেই।
আজকাল সামাজিকতার নব্য সংজ্ঞা দাঁড় করানো হচ্ছে, 'নিউ নরমাল' এর ফিরিস্তি গাওয়া হচ্ছে। সবকিছুই হোক, সংক্রমণ রোগ বিশ্বব্যাপী মহামারী ধারণ করেছে তাই উত্তরণ অবশ্যই প্রয়োজন। তবুও মানুষের প্রতি অনুগ্রহ থাকবে, নব্য সামাজিকতার সংজ্ঞার আড়ালে অন্তত 'মানবতা, আন্তরিকতা ও দায়িত্বশীলতা'কে দয়া করে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দিবেন না। আজও আমি আর ভাইয়া বের হলে, এলাকার মানুষ এভাবে তাকায় যেন আমরা শাহরুখ খান! আমরা স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করি। অথচ খারাপ সময় আপনারও আসতে পারে, সংকীর্ণতা ত্যাগ করে মানবিক হোন। আত্মকেন্দ্রিকতা থেকে বেরিয়ে যথাসাধ্য মানুষের পাশে দাঁড়ান। নিশ্চিতভাবেই সৃষ্টিকর্তা সকলের সহায় হবেন।