যুদ্ধটা ছিল কোভিড-১৯ আর আম্মুর মধ্যে। কোভিডের সাথে ছিল ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, আর আম্মুর সাথে ছিল আল্লাহর রহমত, সবার দোয়া আর একদল সহযোদ্ধা...
করোনা মহামারী আসার পর থেকে নেগেটিভ সব নিউজ এর জন্য ফেসবুকে ঢোকার সাহস হয় না অনেকের। ঈদের পর থেকে চট্টগ্রামে শুরু হয় মৃত্যুর মিছিল। সবকিছু লন্ডভন্ড। কিন্তু এর মধ্যেও মানুষ জিতে ফিরছে। সবাই শুধু হেরে যাওয়া আর হারিয়ে ফেলার গল্পটাই প্রচার করে। যেসব দেখে মানুষের মানসিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে, হচ্ছে নানা মানসিক, শারীরিক সমস্যা।কমে যাচ্ছে মনোবল। এই টিকে থাকার লড়াইয়ে যেটা সবচেয়ে বেশি দরকার। আমাকে অনেকেই ফোনে, ইনবক্সে আম্মুর সিম্পটম, ট্রিটমেন্ট সম্পর্কে জানতে চেয়েছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ মাইক্রোবায়োলজী অধ্যাপক ডাঃ শাকিল আহমেদ স্যার এবং আমার ক্যাম্পাসের জুনিয়র রিমির বাবার কোভিড জয়ের গল্প পড়ে আমি সাহস পাই। তাই আমি ভাবলাম আম্মুর জিতে ফেরার গল্পটা আমি লিখব। যেটা পড়ে মানুষ কিছুটা হলেও সাহস পাবে।
শুরুতেই বলি এই যুদ্ধে পদে পদে অনেক প্রতিবন্ধকতা, অনেক নেগেটিভিটি ছিল, আল্লাহর রহমত আর মনোবল থাকলে সব পিছনে ফেলে জয়ী হওয়া যায়।
৬ জুন দুপুর থেকে আম্মুর জ্বর আসে। রাতে মেডিসিন নিয়ে ঘুমায়। পরদিন সকাল থকে জ্বর বাড়তে থাকে সাথে সর্দি কাশি। দুপুর থেকে ডায়রিয়া। পরদিন সিএমসি তে টেস্ট করাতে চাই। এরমধ্যে আম্মুর জ্বর কাশি বাড়তে থাকলো।সাথে অল্প গলা ব্যথা। ৮ তারিখ থেকে আব্বুকে পুরোপুরি আম্মু থেকে আইসোলেটেড করি। আমিও কিছুটা চেষ্টা করি। যদিও পরে আর সম্ভব হয়নি।
এদিকে আম্মুর জ্বর দিনে ১০০ আর সন্ধ্যার পর থেকে ১০১ ডিগ্রি হয়। কাশি বাড়ে। এর মধ্যে আমরা কোভিড টেস্টের রিপোর্ট এর জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। সাপোসিটার দিয়েও জ্বর কমে না। এরপর শুরু হল বমি। খাওয়ার অরুচি। আম্মুর CBG তখন 33... কন্ট্রোলে আসে না। ইনসুলিন বাড়ানো হয় gradually..
১১ তারিখ দুপুরের দিকে হঠাৎ শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। আমার পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে আমি ঘাবড়ে যাই। ডাক্তার বলছে হাসপাতালে ভর্তি করতে, অথচ আম্মু কোন ভাবেই বাসার বাইরে যাবেন না। সাসপেক্টেড উনি, কমফার্ম না। সো কনফার্ম কোভিডদের সাথে মেডিকেল ক্লিনিক কোথাও থাকতে যাবেন না। এরপর একটু স্ট্যাবল হলে আমরা যাওয়ার সিদ্ধান্ত আপাতত বাদ দেই।মাঝের এই দিনগুলো কি পরিমাণ অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে এখন ভাবলে নিজে নিজেই ভয় পেয়ে উঠি। কোন ক্লিনিক সাসপেক্টেড কেইস নেবে না। সিট খালি নেই বলে উনারা ইনডিরেক্টলি এইটাই মিন করেন।
১৩ তারিখ সকালে ডা. কায়সার ভাইয়া সব আপডেট শুনে নিউমোনিয়া সাসপেক্ট করে। তারপর আমাকে বলে প্রতিটা ডাক্তারের বাসা ই এক একটা ক্লিনিক। কোথাও ভর্তি নিচ্ছেনা বলে আমরা বসে থাকতে পারব না। আমরা বাসাটাকেই ক্লিনিক বানাব আজ থেকেই ইনজেক্টেবল এন্টিবায়োটিক শুরু করব। ডাক্তার কিছু রুটিন টেস্ট দেন।
ক্যানুলা, সিরিঞ্জ, স্যালাইন সেট যা যা লাগবে সব নিয়ে আসি। এর মধ্যে সিএসটিসি তে একটা কেবিন ম্যানেজ করা গেল। আমরা আম্মুকে নিয়ে ক্লিনিকে গেলাম। তারপর শুরু হলো কোভিডের সাথে আমার একই রুমে বসবাস। আমার জীবনের সবচেয়ে শিক্ষনীয় ৩ টা দিন।
অক্সিজেন আর ইনজেক্টেবল এন্টিবায়োটিক শুরু হল। রাতে আম্মুর পজিটিভ রেজাল্ট এলো।আমার মাথা তখন পুরোপুরি ব্ল্যাঙ্ক। কায়সার ভাইয়া ফোনে জানাল A+ plasma donor রেডি রাখতে। কালকের জন্য অপশন এইটাই থাকুক।
আমি আমার বন্ধু কাজিনদের ম্যাসেঞ্জারে জানালে ফোন আসে অনেকের। পরে আনিকা ফোন দিয়ে আমাকে শাহেদ ভাই এর নাম্বার দেয় যিনি আমাকে ডোনার কনফার্ম করেন আমার সব বন্ধু-কাজিনরা আপ্রান চেষ্টা করে যেটার জন্য। সেই রাতে শুধু আম্মুর দিকে তাকিয়ে বসেছিলাম।আমার জীবনের সবথেকে দামী মানুষটা অক্সিজেন মাস্কের ভিতর কেমন কেঁপে কেঁপে শ্বাস নিচ্ছিল। আল্লাহর কাছে আরো একবার আমার মেয়েটাকে ফেরত চাইলাম।
পরদিন সকালে আম্মুর জ্বর ১০১ হয়। একটু উঠে বসতে পারলে কায়সার ভাইয়া এসে টেস্ট করাতে নিয়ে যায় আমরা। আমরা টেস্ট করতে করতে ভাইয়া গিয়ে কোভিড রিপোর্ট এর হার্ড কপি নিয়ে আসে সিএমসি ল্যাব থেকে ঐদিন বিকেলে CBC xray আরো অন্যসব টেস্ট থেকে নিউমোনিয়া কনফার্ম হয়। ভাইয়া গিয়ে ডিউটি ডক্টরকে পরিচয় দিয়ে ফাইলে ড্রাগ এড করেন। আম্মুর অবস্থা ইম্প্রুভ হতে থাকে আল্লাহর রহমতে। বাড়তে থাকে বাসায় আসার জন্য আম্মুর অস্থিরতা। আমি আর ভাইয়া অনেক বুঝিয়েও ১৬ তারিখের পর আর রাখা সম্ভব হচ্ছিল না। কিন্তু উনারা কোভিড পজিটিভকে এত তাড়াতাড়ি বাসায় ডিসচার্জ দিতে পারবেন না। জেনারেল হসপিটাল/ সিএমসি তে রেফার করতে পারবেন। আমি মেইনটেইন করতে পারব, বাসায় অক্সিজেন আছে বলার পরও। এরপর ডিসচার্জ নিয়ে হেল্প করেন হাবীব আর ফয়েজ ভাই।
আমরা আসার আগে আব্বু ১০১ জ্বর নিয়ে সবকিছু ধুয়ে মুছে রেডি করে রাখেন। বাকিটা বাসায় আমি মেইনটেইন করতে পারি। আম্মুর ১৭ দিন থেকে মোটামুটি সব নরমাল। এখন সব ড্রাগ ওরাল। জ্বর শ্বাসকষ্ট কিছুই নেই আল্লাহর রহমতে। অতিরিক্ত দুর্বল আর ওজন কমে যাওয়াটা চোখে পড়ার মতো। ডায়েটে যুক্ত হয়েছে নতুন অনেক খাবার। হালকা হাটাহাটি ব্রিদিং এক্সারসাইজ চলেছে। ইনসুলিন, ইনহেলার, ইনজেক্টেবল এন্টিবায়োটিক ছাড়া প্রতিদিন ১২ টা করে ২৪ টা ট্যাবলেট খাওয়ার ধৈর্য রাখা সহজ ছিল না। অস্থির হয়ে যেতেন অনেক সময়।
এবার আসি করোনা রোগীর মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে। করোনা পজিটিভ হলেই অথবা সিম্পটমস আসলেই তাকে আইসোলেটেড করে দেওয়া হয়। হঠাৎ কাছের মানুষদের থেকে আলাদা হয়ে যাওয়াটা তাদের মনে বাজে ভাবে প্রভাব ফেলে। তাই এই আইসোলেশন হওয়া উচিত এমন যেটা শুধু নিরাপত্তার জন্যই অবস্থান গত দূরত্ব শুধুমাত্র। আর অন্যসব কথা বলা গল্প করা দূর থেকে একসাথে খাওয়া সবই যেন আগের মতই থাকে। আমি আম্মু থেকে আলাদা ঘুমানো শুরু করলে আম্মু এক রাতে উঠে কান্না করে ভাইয়াকে ফোন দেয় আমি তখন বুঝতে পারি কতটা একাকীত্বে ভুগছিল মানুষটা। রাগ হয় নিজের উপর।
আমি যখন দূরে যেতে পারছি না, আমি আমার নাক আর মুখকেই দূরে রাখার চেষ্টা করি।তারপর আমি ঠিক করি আম্মুর পায়ের ঐপাশেই নিচে বিছানা করব মাস্ক আর ফেস শিল্ড পরব। একটু দূরে চেয়ারে বসে টিভি দেখি একসাথে। এটা আইসোলেশনের ব্যপারে ডিমোটিভেট করা হচ্ছে কিনা আমি জানি না তবে আমি ৪ টা মাস্ক না পরে কখন ও রুমে ঢুকতাম না। বেশি প্রবলেম হতো খাওয়া নিয়ে। ম্যাক্সিমাম টাইম বিস্কুট খেয়ে নিতাম। যেটা সহজ ছিল। দিন রাত ২৪ ঘন্টা ৫ টা মাস্ক পড়ে থাকা কস্টের ছিল। তবে আম্মুর শ্বাসকষ্ট থেকে বেশি কষ্টের ছিল না। আম্মুর মনোবল ঠিক রাখাটা আমার করোনা থেকে মুক্ত থাকার চেয়ে বেশি ইম্পর্টেন্ট ছিল।
আমার এভাবে এক্সপোজড হওয়া নিয়ে আমার রিলেটিভ বন্ধুবান্ধব সবাই দুশ্চিন্তায় ছিল। সত্যি বলতে একটা সময় পর মানুষ ডেসপারেট হয়ে যায়। আমার কোভিড নিয়ে কোন ভয়ই কাজ করে নাই। আল্লাহ সবাইকে সময় মত শক্তি দিয়ে দেন। আর ভাইরাস এর ভয় কখন ও আম্মুর চেয়ে বড় হতে পারেনা
আমি প্রতিদিন সকালে নিজেকে কাউন্সিলিং করতাম যত বেশি পজিটিভ ভেবে যত শক্ত থাকা যায়। আল্লাহ আমাদেরকে ঠিক ততটুকু কষ্ট দেন যতটুকু আমরা নিতে পারি। তার চেয়ে একটু বেশিও দেন না। আল্লাহর রহমতে এখন ও সুস্থ আছি। কোন সিম্পটম এখনও পর্যন্ত নেই। জানিনা এসিম্পটমেটিক ক্যারিয়ার কিনা। তবে আল্লাহ জানেন আমি অসুস্থ হলে আম্মু আব্বুকে কে দেখবে, তাই আমাকে অসুস্থ করবেন না। আমার সব বন্ধু বান্ধব কাজিন রিলেটিভ সবাই আমাকে অনেক মেন্টাল সাপোর্ট টা দিয়েছে।
একটা ছোট ভাইরাস এর কাছে আমার পাঁচ বছরের কষ্ট হেরে যায় কিভাবে? পুরো গল্পটা জুড়ে যাদের নাম উঠে এসেছে তারা সবাই আমাকে সহায়তা করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। এই চেস্টা বৃথা যায় কিভাবে? আমার বন্ধু, সিনিয়র, জুনিয়র আমার ডক্টরস কমিউনিটি- আমাকে ফিরিয়ে দেয়নি। এই প্রথম মনে হয়' চমেক ৫৭' পরিচয়টা এত বেশি বার ব্যবহার করেছি।
আমার রিলেটিভদের ফোন। করোনা না আসলে জানতাম না আম্মুকে কতটা ভালবাসে সবাই। কথা বলা হয় নাই কারো সাথেই। শুধু দোয়া চেয়েছি। সবাই এত দোয়া করেছে যে আমার আম্মু আমার কাছেই আছে। দুশ্চিন্তা থেকে সবাই আপডেট জানতে চাইতো। মিনিটের মধ্যে যে saturation fall করে তার আপডেট আল্লাহ ছাড়া কেউ জানতেন না। চট্টগ্রামের এই ভেঙ্গেচুরে যাওয়া স্বাস্থ ব্যবস্থায় আমার আম্মু বেঁচে ফিরেছে। সবার এত এত সহযোগীতা, এত এত দোয়া আমি আর ভাইয়া আজীবন মনে রাখব।
আরেকটা জিনিস ঠিক করলাম। জীবনে যখন যেখানে পারি সাধ্যের মধ্যে অন্যের বিপদে আল্লাহর দেওয়া উসিলা হওয়ার চেষ্টা করব। নিজের বিপদে আল্লাহ ঠিক কোন না কোন ভাবে কাউকে না কাউকে মিলিয়ে দিবেন।
এবার আসি কিছু দরকারী কথায়। চট্টগ্রামের যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এখন প্রতি টা ঘরেই অক্সিমিটার রাখা উচিত। আর ডায়াবেটিক থাকলে অবশ্যই গ্লুকোমিটার। কারণ বুঝতেই পারবেন না কাছের মানুষটির স্যাচুরেশন কমে গিয়েছে কিংবা হাইপোগ্লাইসেমিক শকে চলে গেছেন। আমরা চট্টগ্রামের মানুষরা দাওয়াতে হাজার টাকা খরচ করি কিন্তু এসব ব্যপারে উদাসীন। প্রাথমিক চিকিৎসাটা আগে ঘর থেকেই শুরু হোক। প্রতিটা ছেলে মেয়েই বাবা মায়ের হাতের কাছে পাওয়া প্রথম ডাক্তার। উনারা ভিক্টিম হলে আমরা যোদ্ধা। ভাইরাস ঠিকই হেরে যাবে একদিন, জয় মানুষেরই হবে। আল্লাহর রহমত আর মনোবল দরকার। ফেসবুকে আরো কোভিড জয়ের গল্প আসুক। যেগুলা পড়ে আমাদের মনোবল আরো বাড়বে। একদিন উহানের মত আমরাও করোনা মুক্ত হওয়ার আনন্দ উপভোগ করব ইনশাআল্লাহ।
সবশেষে, ডা. কায়সার উদ্দীন ভাইয়া, বলেছিলেন আপনাকে বাদ দিয়ে গল্প লিখতে। আমি জানি না অন্যতম প্রধান যোদ্ধাকে বাদ দিয়ে কিভাবে যুদ্ধের গল্প লিখা যায়। এই নীল জগত বিমুখ আপনাকে নিয়ে এখানে আর কিছু না ই বলি। আপনি আজীবন আম্মুর দোয়াতেই থাকুন...