পাশাপাশি দুই ফ্ল্যাট মিলিয়ে ৯ সদস্যের পরিবার আমার। করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার প্রথম থেকেই সবাই অনেক সচেতন ছিলাম, ঘরবন্দী ছিলাম। বিজনেসের জন্য খুব প্রয়োজন হলে মাঝে মাঝে শ্বশুর, ভাসুর আর আমার হাজব্যান্ড অফিসে যেত, তবুও সর্বোচ্চ সতর্কতা মেইনটেইন করেই। বাইরে গেলে পিপিই-হ্যান্ড গ্লাভস, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, ঘরের ভেতরে ডিসইনফেকট্যান্ট স্প্রে দিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, কোনো কিছুরই বাদ রাখিনি আমরা। তবুও রক্ষা পাইনি।
শুরুতে জ্বর এলো আমার শ্বাশুড়ির, এরপর ধীরে ধীরে বাড়ির প্রত্যেকে জ্বরে আক্রান্ত হলাম। কারোরই জ্বর খুব বেশি ছিল না যদিও, তবুও আমরা সবাই জুনের ১৪ তারিখ করোনা স্যাম্পল দিলাম। রিপোর্ট এলো- প্রত্যেকেই পজিটিভ!
আমাদের প্রত্যেকের মাইল্ড জ্বর ছিল, আর তেমন কোনো সিম্পটম ছিল না কারও মধ্যে। কিন্তু দিন যত যেতে লাগলো আমার হাজব্যান্ডের শ্বাসকষ্ট হতে থাকে। শুরু থেকেই আমি একাধিক ডাক্তারের সাথে কনসাল্ট করেছি। কিন্তু ট্রিটমেন্ট নেই একজন নিউমোলোজিস্ট, তথা ফুসফুস চিকিৎসায় বিশেষজ্ঞ যিনি, তার কাছ থেকে। আমার এ সিদ্ধান্তের জন্য আমি নিজেকে নিজেই ধন্যবাদ দেই বারবার, কারণ এ সিদ্ধান্তের জন্যই হয়তো আমরা এখনো শ্বাস নিচ্ছি।
করোনা পজিটিভ হওয়ার পর অনেকেই র্যান্ডম যেকোনো ডাক্তারের কাছে ট্রিটমেন্ট নেন, যেহেতু করোনা সাধারণ ফ্লুয়ের সব সিম্পটমই ক্যারি করে। কিন্তু বেশীরভাগ ডাক্তাররাই মেডিকেশনের পাশাপাশি লাংস এক্সরে করতে দেন না, যেটা আপনার ফুসফুস ইনফেক্টেড হওয়ার চান্স অনেক বাড়িয়ে দেয়। আপনার ফুসফুস ইনফেক্টেড হয়েছে, কি হয়নি তা বোঝার একমাত্র উপায়ই হলো লাংস এক্সরে। কোনো উপসর্গ দেখানো ছাড়াই আপনার ফুসফুসটি পুরোপুরি ইনফেক্টেড হয়ে যেতে পারে।
আমাদের ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে তা হলো আমার হাজব্যান্ডের শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়ার সাথে সাথে ডাক্তার আমাদের লাংস এক্সরে করার পরামর্শ দেন। পরামর্শমতো আমরা এক্সরে করে দেখি আমার লাংস পুরোপুরি ঠিক থাকলেও হাজব্যান্ডের লাংস কিছুটা ইনফেক্টেড হয়ে গেছে। পরে সে অনুযায়ী ডাক্তার আমার হাজব্যান্ডকে ট্রিটমেন্ট করেন। আমার মনে হয়েছে সঠিক সময়ে আমার হাজব্যান্ডের লাংস এক্সরে করানোটা ভীষণ জরুরি ছিল। তখন এক্স-রেটা না করালে হয়তো বড় সমস্যায় পড়ে যেতাম।
এছাড়াও বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে বয়স্ক যারা ছিল, তাদের একটু বিশেষ খেয়াল রাখছিলাম সবাই। বয়স আর মানুষভেদে ডাক্তারের ট্রিটমেন্টও ভ্যারি করছিল৷ যেমন- বয়স্ক ৩ জনকে বিভিন্ন সময়ে ইঞ্জেকশন পুশ করা হয়েছে, যা বাড়ির অন্যান্য কাউকে করা হয়নি।
করোনা পজিটিভ রিপোর্ট পাওয়ার পর থেকে বাসার প্রত্যেকেই প্রতিদিন গরম পানি দিয়ে গার্গল করেছি, ১ ঘন্টা পরপর আদা চা খেয়েছি৷ দিনে অন্তত ৫ বার নাক-মুখ দিয়ে গরম পানির ভাঁপ নিয়েছি। শরীর দুর্বল লাগতো যেহেতু, তাই সবাই প্রোটিন বেশি খাওয়ার চেষ্টা করেছি। চিনি, বা চিনিজাতীয় খাবার এড়িয়ে চলেছি। এক কথায় খাওয়া-দাওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের লক্ষ্য ছিল একটাই- শরীরের ইম্যিউনিটি যাতে স্ট্রং থাকে সবার। এছাড়া ডাক্তারের পরামর্শমতো ভিটামিন, জিংক ট্যাবলেট প্রতিদিন নিয়ম করে খেয়েছি। পাশাপাশি লাংস এক্সারসাইজ করতাম সবাই, এটাও কাজে দিয়েছে। আর শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক রাখতে ডাক্তার আমাদের বলেছিলেন ঘুমানোর সময় সোজা হয়ে শোয়ার জন্য। এটাও মেইনটেইন করেছি।
পজিটিভ হওয়ার দুই সপ্তাহ পর আমরা পুনরায় টেস্ট করতে দেই এবং আমার হাজব্যান্ড ছাড়া বাকিদের নেগেটিভ রিপোর্ট আসে। কিন্তু পরবর্তীতে আর কোনো ডিফিকাল্টিজও ফেইস করিনি আমরা, আমাদের নেগেটিভ রিপোর্ট পাওয়ার দুই সপ্তাহ পর পুনরায় টেস্ট করে আমার হাজব্যান্ডেরও নেগেটিভ রিপোর্ট পাই৷
ভীষণ ভয় পেয়ে গেছিলাম সবাই, কান্নাকাটিও করেছি অনেক৷ আমার অবস্থা শুনে আব্বু-আম্মুও অসুস্থ হয়ে গেছিল। কিন্তু এটা আমার জন্য একটা ব্লেসিং যে আমার পরিবারটা অনেক বড় আর সবাই একসাথে থাকি। যখনই কেউ মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে গেছে, তখনই অন্য আরেকজন তাকে সাপোর্ট দিয়েছে এটা বলে যে, না সব ঠিক হয়ে যাবে। এত টেনশন না করতে। অথচ সে নিজেও কিন্তু কোভিড পজিটিভ হয়ে আছে। এভাবে কানেক্টেড থাকাটা আমাদের মনোবল ভাঙতে দেয়নি। এছাড়াও কিছু মানুষ যাদের কথা না বললেই নয়, তাদের মধ্যে আমার আর আমার হাজব্যান্ডের কিছু কমন ফ্রেন্ডস। ওরা আমাদের সাথে লকডাউনের পুরো সময়টাতেই কানেক্টেড থেকেছে, অনেক সময় দিয়েছে ভিডিও-কলে, ফোনে। ওদের সাথে কানেক্টিভিটিটাই আমাদের মানসিকভাবে প্রফুল্ল রেখেছে অনেকটা।
করোনয়াজয়ী হিসেবে বলতে চাই- করোনা পজিটিভ হলে ডাক্তার সাজেস্ট করুক বা না করুক, অবশ্যই লাংস এক্সরে করিয়ে ফেলবেন। কোভিডকে অবহেলা করবেন না। ওভার কনফিডেন্ট না হয়ে সময়মতো সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিত করতে পারলে করোনা কোনো অসুখই নয়।