এগিয়ে চলো এক্সক্লুসিভ

করোনা আমাদের আপন-পর চিনিয়েছে...

16 / 30

করোনা আমাদের আপন-পর চিনিয়েছে...

করোনা আমাদের আপন-পর চিনিয়েছে...
  • পড়তে সময় লাগবে মিনিট
  • পড়তে সময় লাগবে মিনিট

মাহমুদুর রহমান নিশাত

বাবা-মা আর দুই ভাই আমরা, চারজনের সুখী পরিবার। ভাইয়ার বিয়ের কারণে কিছুদিন আগেই সেই পরিবারে ভাবীও যুক্ত হয়েছেন। সংসারে সুখ ঢলে পড়ার কথা ছিল, অথচ সুখের পরিবর্তে অসীম শূন্যতাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে হচ্ছে আমাদের। করোনার ভয়াল থাবার সময়টায় পরিবারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষটা আমাদের ছেড়ে চলে চলে গেছেন, আমরা তাকে বাঁচাতে পারিনি, বাঁচানোর চেষ্টাটাও করতে পারিনি পুরোপুরি। গত দেড় মাস ধরে ধৈর্য্যের পরীক্ষা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে খুব কাছের কিছু মানুষের এত কদর্য চেহারা দেখেছি যে, মনুষ্যত্ব ব্যাপারটার ওপর থেকেই ভরসা উঠে গেছে। 

গল্পটা শুরু থেকেই বলি। মে মাসের বিশ তারিখ, রোজা শেষ হয়ে আসছে, কয়েকদিন পরেই ঈদ। বাবার শরীরটা হঠাৎ খারাপ হতে শুরু করলো, গায়ে জ্বর, গলা ব্যথা, শরীরেও ব্যথা। শুরুতে সিজনাল জ্বর হিসেবে পাত্তা দিলাম না সেভাবে, কিন্ত চারদিনেও জ্বর না কমায় ২৪ তারিখে ফৌজদারহাট গিয়ে করোনা টেস্টের জন্য স্যাম্পল দিয়ে এলেন বাবা। ঈদের দিনটা খুব সাদামাটাভাবে কাটলো, সেদিন থেকে আম্মাও অসুস্থ। দুজনেরই জ্বর বাড়ে, কমে, এভাবে চলছিল। বাবাকে আমরা একটা রুমে আলাদা করে ফেলেছিলাম এরই মধ্যে। 

ব্যবহার করুন সেপনিল হ্যান্ড স্যানিটাইজার

২৯ তারিখে ভাইয়ার নাম্বারে একটা ফোন এলো, থানা থেকে এক অফিসার জানালেন, বাবার করোনা টেস্টের রেজাল্ট পজিটিভ এসেছে। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো সবার। নিউ মনসুরাবাদের যে এলাকাটায় আমরা থাকি, এখানে প্রায় ষোলো বছর ধরে আমাদের বাস। শৈশব-কৈশোর থেকে জীবনের বেশিরভাগ সময়ই কাটিয়েছি এখানে। অথচ আমাদের বাসায় করোনারোগী আছে- এটা জানার পরে এলাকার লোকজনের কাছ থেকে যে ব্যবহার‍টা আমরা পেয়েছি, সেটা শত্রুর সাথেও মানুষ করে না বোধহয়। 

পুলিশ এসে বিল্ডিং লকডাউন করে দিয়ে গেল, বাইরে বেরুনো বন্ধ। প্রয়োজনীয় জিনিস আনা বা বাসার ময়লাটা ফেলার কোন ব্যবস্থাও ছিল না। এলাকার লোকজনের বাজে ব্যবহার তো ছিলই। এরইমধ্যে আম্মার অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছিল, আমাদেরও তখন টেস্ট করানো দরকার, নইলে তো জানা যাবে না আমরাও করোনায় আক্রান্ত হয়েছি কিনা। কিন্ত এলাকার লোকজন আমাদের টেস্ট করাতেও যেতে দেবে না! তাদের সাথে রীতিমতো যুদ্ধ করে আমি, ভাইয়া, ভাবী আর আম্মু স্যাম্পল দিয়ে এলাম। 

বাসায় এসেই আম্মু বিছানায় পড়ে গেলেন, শোয়া থেকেই উঠতে পারেন না, এমন অবস্থা। জ্বরের সাথে সাথে ডিসেন্ট্রি, পাশাপাশি ডায়বেটিস ফল করেছে। আমরা হাসপাতালে ভর্তি করতে চাইলাম তাকে, কিন্ত করোনা টেস্টের নেগেটিভ রেজাল্ট ছাড়া কোন হাসপাতালই ভর্তি নেবে না! চট্টগ্রামে এমনিতেই টেস্টের রেজাল্ট পেতে সময় বেশি লাগছিল। চার তারিখে আম্মার অবস্থা খুবই খারাপ, এরমধ্যে ফোন করে জানতে পারলাম, আম্মার করোনা রেজাল্ট নেগেটিভ এসেছে। আমি আর ভাইয়া পজিটিভ। মুসা নামের পরিচিত এক ছেলেকে পাঠিয়ে রেজাল্টের হার্ডকপিটা আনালাম, আমার এই গল্পে মুসা খুব উল্লেখযোগ্য একটা চরিত্র, তার কথায় পরে আসছি। 

হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্সের জন্য ফোন দিলাম, অ্যাম্বুলেন্স এলো দেড়-দুই ঘন্টা দেরী করে। তারা বাসায়ও উঠবে না রোগীকে নেয়ার জন্য, আমাদেরই ধরে ধরে নামাতে হবে। আমি আর ভাইয়া প্রচণ্ড কষ্ট করে আম্মাকে নামালাম, নামানোর সময় সিঁড়ির একটা জায়গায় আম্মা মাথায় আঘাত পেলেন, ওই আঘাতটা আমার কলিজায় গিয়ে লাগলো যেন। আম্মাকে ভাবীর সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দিয়ে যখন বিদায় দিচ্ছি তখনও আমরা কেউ জানিনা, তাকে আর কখনও জীবিত অবস্থায় দেখতে পাবো না আমরা। অ্যাম্বুলেন্সে অক্সিজেনের ব্যবস্থা ছিল না, আম্মা কি হাসপাতালে মারা গেছেন, নাকি অ্যাম্বুলেন্সেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন, সেটাও আমাদের জানা নেই। 

বাসার সামনে লকডাউনের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছিল পুলিশ

আম্মার লাশ নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সটা আবার বাসার নিচে এলো। আমাদের গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালী, সেখানেই লাশ দাফন করা হবে- এরকম সিদ্ধান্ত আমাদের। কিন্ত বেঁকে বসলো আমাদের বাড়ির লোকজন, আমাদের পরিবারের সদস্যরাই। আম্মার করোনা নেগেটিভ অবস্থায় মারা গেছেন, এটা জেনেও তারা বলে দিলেন, আম্মার লাশ নাকি তারা এলাকায় দাফন করতে দেবেন না! যে পরিবারের জন্য আমার আম্মা এতকিছু করেছেন, সেই পরিবারের লোকেরা এই কথাগুলো বললো। যে মসজিদের জন্য আমার আম্মা নিজে দান করেছেন, তার প্রবাসী ভাই বা আত্মীয়দের বলে ডোনেশন আনার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, সেই মসজিদের খাটিয়ায় নাকি আম্মার লাশটা রাখতে দেয়া হবে না! 

চাইলে আমরা স্থানীয় প্রশাসনকে বলে আম্মার লাশ দাফনের ব্যবস্থা করতে পারতাম। কিন্ত তখন এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো অবস্থা ছিল না। একে তো আম্মাকে হারানোর যন্ত্রণা, তার ওপর চারপাশের মানুষজনের এমন নির্মম আচরণে আমাদের অবস্থা হয়েছিল অধিক শোকে পাথরের মতো। শরীরের সবটুকু শক্তি সঞ্চয় করে, করোনা পজিটিভ অবস্থাতেই যথাযথ প্রোটেকশন নিয়ে আম্মার লাশের সাথে অ্যাম্বুলেন্সে উঠে বসলাম, লাশ নিয়ে যাব পটুয়াখালী, আমার নানাবাড়িতে, সেখানেই দাফন করব আম্মাকে। 

পরের দেড়টা দিন কিভাবে কেটেছে আমি জানিনা। অ্যাম্বুলেন্সে আম্মাকে নিয়ে পটুয়াখালী যাওয়া, লাশ দাফন করা, আবার ফিরে আসা, ওই সময়টায় আমি নিজে নিজের মধ্যে ছিলাম না। কি করেছি, কি খেয়েছি, কার সাথে কেমন ব্যবহার করেছি কিছুই মনে নেই। শুধু মনে আছে, আম্মার কবরে তিন মুঠো মাটি দেয়ার কথা, এক মুঠো বাবার হয়ে, এক মুঠো ভাইয়ার হয়ে, আরেক মুঠো নিজের জন্য। কাউকে জড়িয়ে ধরে কান্না করার অবস্থাটাও ছিল না। আমি যখন গাড়ি নিয়ে ফিরছি, বাসায় তখন ভাইয়ার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে, আমি কিছুই জানিনা। ভাইয়া নিজেই হাসপাতালে ফোন দিয়েছে, অ্যাম্বুলেন্স এসেছে, সে একা একা হাসপাতালে চলে গেছে, ভাবীকে বাসায় থাকতে হয়েছে বাবার পাশে। 

আমি খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে গিয়েছি, ভাইয়ার ইনজেকশন দেয়া লাগবে, সেই ইনজেকশন কিনে দিয়ে বাসায় ফিরেছি। হাতে জমানো টাকা ছিল না খুব বেশি, কিভাবে কিভাবে যেন ম্যানেজ হয়েছে, আল্লাহ মিলিয়ে দিয়েছেন। চার-পাঁচটা দিন চলে গেছে হুঁশ ফিরে পেতেই। এরইমধ্যে ভাইয়া খানিকটা সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে এসেছে, ওর হার্টের সমস্যা ধরা পড়েছে বলেছেন ডাক্তার। ২০ তারিখ আমরা সবাই আবার করোনা টেস্ট করালাম, জুনের ২৮ তারিখ সেটার রেজাল্ট পেলাম, নেগেটিভ। বুক থেকে একটা পাথর নামলো, মাথা থেকে নামলো না আম্মার স্মৃতি, মন থেকে মুছতে পারলাম না আম্মাকে হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণাটা। 

মুসার গল্পটা বলি। ওর মা আমার আম্মাকে বাসার কাজে সাহায্য করতো। বিল্ডিং লকডাউনের পর পরিচিত অনেকের কাছেই সাহায্য চেয়েছি, পাইনি। মুসা তখন দেবদূত হয়ে এগিয়ে এসেছে। বাজার করে দেয়া, দরকারী জিনিস বা ঔষধ এনে দেয়া, আমার সাথে আম্মার লাশ নিয়ে পটুয়াখালি যাওয়া- সবকিছুই করেছে বছর বাইশের এই ছেলেটা। বিপদের সময় আপনজন পর হয়ে যায়, আর নিতান্তই অপরিচিত মানুষজন ভীষণ আপন হয়ে পাশে দাঁড়ায়- এই করোনাকালে নতুন করে এই অভিজ্ঞতাটা হলো আমার। 

কেউ কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করে, আইসোলেশনের দিনগুলোতে আমি কি করেছি। আমি জবাব দিতে পারি না। আম্মাকে মনে করা ছাড়া আর কীইবা করেছি? হ্যাঁ, একজন করোনারোগীর যা যা করা দরকার, সবই করেছি, গরম পানির ভাপ থেকে শুরু করে ডাক্তারের পরামর্শ মেনে ঔষধ খাওয়া- সব। ভিটামিন, মেনথল, দেশি ফল, প্রচুর খাবার খেয়েছি। কিন্ত সেসবের বেশিরভাগ স্মৃতিই ঝাপসা। কারণ আমি প্রতিটা সেকেন্ড আমি আম্মাকে মিস করেছি। নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করি আম্মার জন্য। যদি সম্ভব হয়, আপনারাও আমার আম্মার জন্য দোয়া করবেন। কারো প্রতি আমাদের কোন অভিযোগ নেই, যা অভিযোগ, যা নালিশ, আমরা সেটা পরম করুণাময়ের কাছে জানিয়ে রেখেছি, বিচার করার হলে তিনিই করবেন... 

শেয়ারঃ


করোনাজয়ী'র গল্প