গত ১১ই মে ২০২০, ১৭ তম রোজার সেহেরী করতে উঠি। আম্মু বললো আব্বুর জ্বর, সেহেরী করবে না। আমি ভাত খেয়ে ডাবল মাস্ক, গ্লাভস আর চশমা পরে আব্বুর রুমে গেলাম, সাথে একটা থার্মোমিটার নিলাম। আব্বুর জ্বর মেপে দেখি ১০১° ফারেনহাইট। সেই মুহূর্তে মাথায় অনেককিছু ঘুরতে শুরু করে। আব্বু দুইদিন আগে অফিস থেকে আম্মুকে কল দিয়ে বলেছিলো গলাব্যথা করছে, গরম পানি দিয়ে রাখো। আব্বুর শুকনো কশিও ছিলো, যেটা এই ঠান্ডা-গরম সিজনের শুরু থেকে হওয়ার কারণে প্রথমে এত গুরুত্ব দেওয়া হয় নি। কিন্তু, এবার জ্বর ওঠার পর কেমন যেনো কেভিড-১৯ সাসপেক্ট করতে থাকলাম। শুরু থেকে আব্বুর উপসর্গ বলতে শুধু জ্বর ১০০° ফারেনহাইট, সঙ্গে কাশি ছিলো। ৪-৫ম দিনে ২-৩ বার পাতলা পায়খানা হয়। তবে পরে আর সমস্যা হয় নি, নিজ থেকেই ঠিক হয়ে যায়।
সেদিনই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আব্বুর নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এরপর শুরু হয় আল্লাহর কাছে দুই হাত তুলে শুধু একটা নেগেটিভ রিপোর্ট চাওয়ার পালা। আব্বুকে বাসায় এটাচড-বাথ সহ বেডরুমটায় আইসোলেশনে রাখা হলো। আর আব্বু এর আগে যে রুমে ছিল, মাস্ক-গ্লাভস পরে সেই রুমের সব ফার্নিচার ডিসইনফেক্টেড করা হলো, চাদর, বালিশের কভার সব ধুয়ে শুকাতে দেয়া হলো। আম্মু আর ভাইকে আব্বুর রুমে যেতে মানা করে দিলাম। আব্বুকে খাবার-দাবার আমি দিতাম। রুম মুছে ডিসইনফেক্টেন্ট স্প্রে করতাম সবকিছুতে। প্রতিবার ডাবল মাস্ক গ্লাভস পরে যেতাম। সেসময় আব্বুও মাস্ক পরে থাকতো। খাবার নেওয়ার সময়, আমাদের সাথে কথা বলার জন্য দরজার কাছে এলে, আর কাশি হলে আব্বু রুমে মাস্ক পরে থাকতো প্রায় সবসময়ই।
যেহেতু আমি আব্বুর কন্টাক্টে যাচ্ছি সেজন্য আমিও আইসোলেটেড হয়ে গেলাম। নিজেকে আম্মু আর ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে দূরে রাখতাম। প্রতিবার মাস্ক পরে রুম থেকে বের হতাম। নিজের সব ব্যবহারের জিনিস আলাদা করে রুমে রাখলাম। আমার রুমে আসা বা আমার কোনো জিনিস কেউ যাতে স্পর্শ না করে সেটা বলে দিলাম। আমিও আমার রুমের বাহিরের কোনো কিছু স্পর্শ করতাম না। করা লাগলেও হ্যান্ড স্যানিটাইজ করে গ্লাভস পরতাম, নাহয় ২০ সেকেন্ড ধরে সাবান পানি দিয়ে হাত ধুয়ে হ্যান্ডরাব ইউজ করতাম। আর এরপর যে জিনিসটা আমি টাচ করেছি সেটা ডিসইনফেক্টেড করে ফেলতাম সঙ্গে সঙ্গে।
একটু পরপর গরম পানি পান করা, ৩-৪বার লেবু-আদা চা খাওয়া,লবণ গরম পানির গার্গল করা,গরম পানির ভাপ নেয়া এসবও চলতে থাকলো। ভিটা সি যুক্ত ফল,স্যুপ,বেশি বেশি প্রোটিন যুক্ত খাবার দেওয়া হলো আব্বুকে। ১৩ই মে, ২০২০ রিপোর্ট এলো, পজিটিভ। মুহূর্তের মধ্যে সব এলোমেলো হয়ে গেলো। উঠে মুখে পানি দিলাম। আম্মুদের কিভাবে বলবো কিছুই মাথায় আসে না তখন। কিছুক্ষণ পরে আব্বুও ফোন পেলো, জানলো সবাই। আমি কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না তখন। সে রাতে আর কেউ ঠিকমত সেহেরি করতে পারিনি।
মাথার ভেতর তখন অজস্র চিন্তা। আব্বুকে কি হাসপাতালে ভর্তি করাব? আমরা নিজেরা টেস্ট করাব কি? টেস্ট করানোর জন্যে আম্মুকে বাইরে নেয়াটা সেফ হবে কিনা? বাসায় পুরোপুরি আইসোলেশন নিশ্চিত করতে পারব? আম্মু আব্বুকে হাসপাতালে পাঠাতে নারাজ আর আব্বুও বাসায় থাকতে চায়। তারওপর আব্বুর আল্লাহর রহমতে মাইল্ড সিম্পটমস ছিলো, তাই সাহস করে সিন্ধান্ত নিয়ে ফেললাম আব্বু কে বাসায় রেখে ট্রিটমেন্ট করাব।
শেষে জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডাঃ আব্দুর রব স্যারের সাথে ফোনে কথা বলি। স্যারকে সব জানাই। বলি বাসায় রেখে ট্রিটমেন্ট করতে চাই। আব্বুও স্যারের সাথে কথা বলে নিজের ফোন থেকে, সিম্পটমগুলো জানায়। স্যার আব্বুকে প্রেসক্রিপশন মেসেজ করে দেন। আর আমরা বাসার বাকি সদস্যরা টেস্ট করবো কি না জানতে স্যার বলেন ১৪দিন কোয়ারেন্টিনে থেকে কোনো প্রকার সিম্পটম এরাইজ করে কি না খেয়াল রাখতে। সিম্পটম এরাইজ করা ছাড়া টেস্ট করতে না যেতে, এতে ফলস নেগেটিভ রিপোর্টের সম্ভাবনা থাকে আর হাসপাতাল থেকেই ইনফেক্টেড হওয়ার একটা চান্স থাকে সাথে ভোগান্তি তো আছেই।
আমরা সবাই বাসায় মাস্ক পরতাম। শুধু মাত্র নিজের রুমে থাকলে তখন মাস্ক পরতাম না। ছোট ভাইকে সামনের রুম থেকে মাঝের রুমে নিয়ে আসা হলো। এতদিন আব্বুর প্লেট-মগ আমি ধুয়ে আলাদা করে রাখতাম। এখন থেকে সিদ্ধান্ত হলো আব্বুর জিনিসপত্র, রুম, কাপড় সব আব্বুই পরিষ্কার করবে। আমরা কেউই সে রুমে যাবো না আর সম্পূর্ণ নন-টাচ টেকনিকে আব্বুকে খাবার-দাবার দেয়া হবে।
আইসোলেশনের সময়টাতে আব্বু যেসব দিকনির্দেশনা মেনে চলেছেন, সেগুলো হচ্ছে-
১. দিনে তিনবার শরীরের তাপমাত্রা মেপে রিডিং আমাকে জানাতে হবে আর আমি সেটি নোট করতে থাকি।
২. দিনে ৩-৪বার ব্রিদিং এক্সারসাইজ করতে হবে। ব্রিদিং এক্সারসাইজ বলতে, আলো বাতাস পূর্ণ জায়গা,যেমন জানালার পাশে চেয়ারে বসতে হবে সোজা হয়ে। এরপর ধীরে ধীরে বুক ভরে নিশ্বাস নেওয়া, যেটাকে মেডিকেলের ভাষায় deep inspiration বলে। এরপর ৩-৫ সেকেন্ড নিশ্বাস আটকে রেখে (breathe hold) ধীরে ধীরে নিশ্বাস টা ছেড়ে দেওয়া। এভাবে ৫-১০বার করার পর একটা কাশি দেওয়া আর খেয়াল রাখা আশেপাশে যাতে কেউ না থাকে আর হাতে টিস্যু থাকে। (YouTube এ এই বিষয়ে অনেক স্পেশালিষ্টদের ভিডিও আছে)
৩. প্রতিবার শোয়ার সময় অন্তত ১০-১৫ মিনিট উপুড় হয়ে শোয়া (prone position), বাম কাত হয়ে শোয়া (left lateral), ডান কাত হয়ে শোয়া (right lateral) আর ঘুমানোর সময় উঁচু বালিশ ব্যবহার করা।
৪. সবসময় শরীরের যেকোনো রকম পরিবর্তন, যেকোনো রকম সিম্পটম খেয়ালে রাখা আর আমাকে টাইম টু টাইম সব জানানো। কোনোরকম শ্বাসকষ্ট, বুক ব্যথা হয় কি না খেয়াল রাখা। নিশ্বাস নিতে কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না খেয়াল রাখা।
৫. আধ ঘন্টা পরপর গরম পানি খাওয়া। ২টা কারণে,এক. যাতে ডিহাইড্রেশন না হয় কোনোভাবে, দুই. গলা ভেজা থাকলে গলায় খুশখুশ কম হয়, কাশিটা কমে আর আরাম লাগে।
ডাঃ রব স্যারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী কিছু ওষুধ দিলাম আব্বুকে। ২ ঘন্টা পরপর কম কম পরিমাণে খাবার দিতে থাকি। জ্বরের কারণে খাবারে অরুচি ছিল। মাল্টা, স্যুপ, ডিম, দুধ, মাংস, বিভিন্নরকম তরি-তরকারি, ভাত, সুজি, বিভিন্নপ্রকার ফল এসব দেওয়া হয়। আব্বুর সাথে সাথে আমরাও জিংক, সিভিট নেয়া শুরু করলাম। গরম পানি খাওয়া, লেবু আদা চা খাওয়া, গরম পানির গার্গল করা, ভাপ নেয়া এসব আমরাও শুরু করি। ভিটামিন-সি যুক্ত খাবার, দুধ, ডিম, মাংস, বেশি বেশি পানি খাওয়া এসব চলতে থাকে আমাদের ক্ষেত্রেও।
২১শে মে থেকে অর্থাৎ ১১তম দিন থেকে আব্বুর জ্বর নেমে যায়, টেম্পারেচার ৯৭-৯৮° ফারেনহাইটে চলে আসে। নাপা খাওয়ানো বন্ধ করলাম। আল্লাহর রহমতে আগের থেকে তখন আব্বু সুস্থ অনেক। আর আমাদের তিনজনেরও এই ১২দিনে কোনোরকমের সিম্পটম দেখা দেয় নি। সবাই সুস্থ আল্লাহর রহমতে। তবে দূরত্ব মেইনটেইন করে চলি সবাই। আমি আইসোলেটেড থাকি। ১৪তম দিনে আব্বুর সব সিম্পটম রিজলভ করে ফেলে প্রায়। ওষুধ বন্ধ করার পর জ্বর আর ওঠে নি লাস্ট ৪দিন ধরে। বাসার বাকি সবাইও সুস্থ। ২৭শে মে ফিরতি টেস্ট করা হয়, ৩০শে মে সেটার রেজাল্ট আসে নেগেটিভ। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম যেন সবাই!
আমার কথা: করোনায় আক্রান্ত মানেই সব শেষ না। আর্লি ডায়াগনোসিস খুব প্রয়োজন এখানে। যত জলদি আপনি রোগ শনাক্ত করে চিকিৎসা শুরু করে দিবেন তত তাড়াতাড়ি আপনার সুস্থতার হার বাড়বে। এরজন্য উপসর্গ গুলোকে এলার্মিং হিসেবে চিন্তা করতে হবে। আপনি টেস্ট যদি করতে না-ও পারেন, তবুও চিকিৎসা নিতে দেরি করবেন না। অবহেলা করবেন না। যেকোনো জ্বর, কাশির সমস্যায় টেলিমেডিসিন সেবা নিন। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ডিসপেনসারি থেকে যা তা ওষুধ কিনে খাবেন না। এতে ভালো কিছু পাবেন না।
আমাদের দেশে রিসোর্স কম, সেটার দোষ হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারদের না। কথায় কথায় ডাক্তারদের গালি দিবেন না। আরেকটা কাজ ভুলেও করবেন না, করোনা আক্রান্ত রোগী আর তার পরিবারকে হেয় করাটা, তাদের বিপদে ফেলবেন না। আজকের এই রোগীই সুস্থ হয়ে কিছুদিন পর প্লাজমা ডোনেশনের মাধ্যমে আপনার বা আপনার আপনজনেরই পাশে দাঁড়াবে। আপনি হলফ করে বলতে পারবেন না যে আপনি আক্রান্ত হবে না। এখন কমিউনিটি লেভেলে ট্রান্সমিশন হচ্ছে যেহেতু, যেকোনো সময় যেকেউই আক্রান্ত হতে পারে। এজন্য সহানুভব হোন। সবাই সুস্থ থাকুন, আর একে অপরের জন্য মহান আল্লাহর কাছে দোয়া চাইতে থাকুন...