এগিয়ে চলো এক্সক্লুসিভ

করোনা ভোগায়নি, ভুগিয়েছে প্যানিক অ্যাটাক

22 / 30

করোনা ভোগায়নি, ভুগিয়েছে প্যানিক অ্যাটাক

করোনা ভোগায়নি, ভুগিয়েছে প্যানিক অ্যাটাক
  • পড়তে সময় লাগবে মিনিট
  • পড়তে সময় লাগবে মিনিট

জান্নাতুল ফেরদৌস মিথিলা 

বাবা একদিন বললেন রাত হলে তাঁর নিশ্বাস নিতে হালকা কষ্ট হয়, আর বুক ভারভার লাগে। যেহেতু অফিসে নিয়মিত যাতায়াত করেন বাবা, তাই ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে ডাক্তার কোভিড সাসপেক্টেড বলে টেস্ট করার পরামর্শ দেন। কিন্তু আর কোনো উপসর্গ না থাকায় বাবা রাজি হলেন না টেস্ট করাতে। 

৩-৪ দিন পর, জুনের ২৪ তারিখ আমার হালকা জ্বর এল, জ্বর একদমই অল্প ছিল, চলেও গেল। কিন্তু ঘুম থেকে উঠার পর হুট করে শরীর ভীষণ দুর্বল লাগা শুরু হয়। আমি বুঝতে পারছিলাম না হঠাৎ করে শরীর এত দুর্বল লাগবে কেন! খাওয়া-দাওয়া তো ঠিকঠাকমতো করেছি। পরদিন মুখের স্বাদ চলে গেল৷ যাই খাচ্ছি, কোনো ঘ্রাণ পাচ্ছি না। মেডিকেল কলেজ বন্ধ হওয়ার পর থেকে বাসায়ই ছিলাম, তাই করোনা পজিটিভ হওয়ার কথা মাথায় আসেনি শুরুতে। আমি এজমার রোগী, আর শুকনা আবহাওয়ায় এজমা রোগীদের ব্রিদিং সমস্যা, ঘ্রাণ না পাওয়া এসব হয় টুকটাক, তাই ভেবেছিলাম নরমালই হয়তো। এজমার কারণে যেসব ওষুধ খাওয়া হয় আমার, সেগুলো চালিয়ে যাচ্ছিলাম। এভাবে গেল ৩দিন। কিন্তু ঘ্রাণশক্তি ফিরে না পাওয়ায় কোভিড টেস্ট করার সিদ্ধান্ত নিলাম। বাসায় ভাইয়ের ছোট বাচ্চা আছে, ডায়েবেটিস রোগী বাবা আছে, রিস্ক নেওয়া যাবে না। 

সাথে রাখুন সেপনিল হ্যান্ড হ্যানিটাইজার  

২৮ তারিখ বাসায় এসে নমুণা নিয়ে গেল, ৩০ তারিখ রিপোর্ট এলো- পজিটিভ! আমার রিপোর্ট দেখে বাসার অন্যান্যরাও টেস্ট করালো এবং বাবা আর ভাবীরও রিপোর্ট পজিটিভ এলো। একদমই পেরাশান না হয়ে তিন জন আলাদা রুমে আইসোলেটেড হয়ে গেলাম। মা এসে রুমের সামনে খাবার দিয়ে যায়, খেয়ে বাটি পরিষ্কার করে রেখে দেই, মা এসে নিয়ে যায় আবার। শুরুর ২ দিন কোনোরকম কোনো সমস্যা ছাড়াই কাটিয়ে দিলাম। শুধু বাবার জন্য দুশ্চিন্তা হতো, যেহেতু বাবা ডায়েবেটিস রোগী।

জুলাইয়ের ৩ তারিখ আমার জন্মদিন ছিল, জন্মদিনের দিন পরিবার পরিজন-বন্ধু বান্ধব থেকে দূরে একা থাকাটা খুব পীড়া দিচ্ছিল, যতবারই কেউ উইশ করার জন্য ফোন করছে, ততবারই কান্নাকাটি করছি। খুব বেশি মন খারাপ হচ্ছিল। শুরুর দুইদিন মানসিকভাবে শক্ত থাকলেও আর শক্ত থাকতে পারছিলাম না। সারাদিন বিভিন্ন দুশ্চিন্তা আর কান্নাকাটি করার কারণে রাতে প্যানিক করলাম। মনে হতে লাগলো আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, ইনহেলারেও কাজ হচ্ছে না। অতএব হাসপাতালে ভর্তি করা হলো আমাকে। হাসপাতালে নিয়ে স্যাচুরেশন সহ সব চেকটেক করে দেখে সব নরমালই আছে, প্যানিক অ্যাটাকের কারণে এমনটা মনে হয়েছে আমার। পরদিন ডাক্তারের সাথে কথা হলো, দুশ্চিন্তা যাতে না করি তাই ঘুমের ওষুধ প্রেসক্রাইব করে দিল ডাক্তার, সাথে আমার নিয়মিত ওষুধপত্র তো ছিলই। রিলিজ নিয়ে বাসায় চলে এলাম। 

কিন্তু বাসায় আসার পর ঐ একই কাহিনী! ঘুমের ওষুধ খেয়েও সারারাত ঘুম হয় না, প্রচন্ড ভয় লাগে। ভোরে আজানের ডাক শুনে ঘুমুতে যাই, কিন্তু পরিপূর্ণ ঘুম হয় না, ঘুম ভেঙে যায়। আর মনে হয় ব্রিদিংয়ে সমস্যা হচ্ছে, দম আঁটকে যাচ্ছে... কী যে বিচ্ছিরি এক অনুভূতি! 

এদিকে বলে রাখি, গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা ছাড়া বাবা আর ভাবীর কোনো ধরনের কোনো সমস্যাই হয়নি আর। শুধু একদিন ভাইয়ের বাচ্চাটার জ্বর এসেছিল ১০২ এর মতো, সবাই ভয় পেয়ে গেছিলাম ভীষণ। কিন্তু ডাক্তার অভয় দিয়ে বললো বাচ্চার জ্বর নরমাল, আর করোনা হয়েও থাকলে চলে গেছে ওর৷ 

ভাইয়ের বাচ্চাটার সাথে 

যাহোক, নির্ঘুম রাত পার করে বিদ্ধস্ত অবস্থায় যখন দিনানিপাত করছি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে একটা কল এলো আমার নাম্বারে। এক ডাক্তার আপু কল দিয়ে আমার অবস্থা জানতে চাইলেন, কেমন আছি, কতটুকু সুস্থ হয়েছি ইত্যাদি জিজ্ঞেস করলেন। আমি আপুকে সব ভেঙে বললাম যে শারীরিক দুর্বলতা ছাড়া সেরকম কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু ঘুম হয় না, আর অনেক দুশ্চিন্তা হয়৷ তখন সেই আপু আমার সাথে অনেকক্ষণ কথা বললেন, আমাকে মোটিভেট করার চেষ্টা করলেন আর পরামর্শ দিলেন সোশ্যাল মিডিয়া থেকে বিরতি নেওয়ার৷ কেননা যতক্ষণ আমি সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় কাটাতাম, একটার পর একটা খারাপ নিউজই দেখতাম, আর করোনার আপডেটস নিতে থাকতাম। এই ব্যাপারগুলো আমাকে মানসিকভাবে দুর্বল করে দিয়েছিল। আমি সেই আপুর কথামতো ব্রেক নিলাম, সময়মতো নামাজ পড়া, বই পড়া, মুভি দেখা - এসব কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চেষ্টা করলাম। এবং কাজেও দিল তা, এরপর আমার আর প্যানিক অ্যাটাক হয়নি। ঘুমের সমস্যার সমাধান পুরোপুরি না গেলেও শারীরিক আর কোনো সমস্যা হয়নি। 

১৪ দিন পর আমি ঘর থেকে বের হলাম৷ গোসল করে ফ্রেশ হয়ে আব্বু-আম্মুর সামনে এসে বসলাম। অনেকক্ষণ কথা বললাম তাঁদের সাথে। অশান্ত মন শান্ত হলো, সেদিন রাতে আম্মুর সাথে ঘুমালাম, এবং অনেকদিন পর আমার পরিপূর্ণ শান্তির ঘুম হলো। এরপর কয়েকদিন আম্মুর সাথেই ঘুমিয়েছি। 

যাহোক, বাবুসহ পরিবারের সবাই পুনরায় করোনা টেস্ট করতে দিলাম, এবং আল্লাহর রহমতে সবার রিপোর্ট নেগেটিভ এলো। 

সুস্থ হওয়ার পর সবাই আমাকে এক প্রকার বকাই দিল এসব বলে যে মেডিকেলের শিক্ষার্থী হয়েও আমি কেন এমন অবুঝের মতো আচরণ করলাম, এত দুশ্চিন্তা করলাম! কিন্তু আসলে একা থাকাটাই আমার জন্য ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক ছিল।

করোনার এই ২০ দিনের জার্নিতে আমার এটাই মনে হয়েছে যে শারীরিক কোনো জটিলতা না থাকলে করোনা খুবই সাধারণ অসুখ। মনের দিক থেকে যে শক্ত থাকে, এ রোগে সেই জয়ী। ভয় পাওয়া চলবে না একদমই। আর নিয়ম মানা বলতে আমি যেটা করেছি তা হলো গরম পানি-চা খেয়েছি প্রচুর, ভাপ নিয়েছি নিয়মিত, আর খাবার-দাবারের মধ্যে স্বাভাবিক খাবারই খেয়েছি, তবে দুর্বলতার কারণে প্রোটিন খেয়েছি বেশি। 

করোনা নেগেটিভ রিপোর্ট পাওয়ার পরেও অনেকদিন শরীর দুর্বল ছিল আমার, কিছুক্ষণ হাঁটলে বা টানা কথা বললেই ভীষণ হাঁপিয়ে যেতাম। ধীরে ধীরে এই সমস্যার সমাধানও হয়েছে। এখন আল্লাহর রহমতে ভাল আছি, সুস্থ আছি। 

একজন করোনাজয়ী হিসেবে সবাইকে এটাই বলবো, দুশ্চিন্তা না করে মানসিকভাবে প্রফুল্ল থাকুন। সময়ের সাথে কখন করোনাকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে দিয়েছেন, দেখবেন, টেরই পাবেন না।

শেয়ারঃ


করোনাজয়ী'র গল্প