লকডাউনের শুরু থেকে বাসায়ই ছিলাম সবাই। টুকটাক বাজার করার জন্যই শুধু মাঝেমধ্যে বাবা বাইরে যেত। আমাদের বিল্ডিংয়ে আমরা ছাড়া শুধু আরেকটা ফ্ল্যাটে মানুষ ছিল, বাকি ফ্ল্যাটগুলো খালিই ছিল। ঐ ফ্ল্যাটের আংকেলের সাথে বাবার ঘনিষ্ঠতা খুব, যতবার বাজারে যেতে হতো, সেই আংকেলের সাথেই যেত বাবা। গাড়িতে যাওয়া আসা করতো, সাথে মাস্ক-হ্যান্ড গ্লাভসও পরে যেত। সচেতনতায় কোথাও কোনো ফাঁকি রাখা হয়নি, তবুও আমরা আক্রান্ত হলাম!
শুরুতে সেই আংকেলের জ্বর এলো। দুইদিন জ্বর থেকে ভালোও হয়ে গেলেন তিনি, আর কোনো সমস্যার মুখোমুখি হননি। তার ঠিক চারদিন পর, জুলাইয়ের ১ তারিখে এলো বাবার জ্বর। জ্বর মানে প্রচন্ড জ্বর, ১০৩-১০৪ এর নিচে নামে না। বাবার জ্বরের একদিন পর আম্মুর জ্বর, তারও দুইদিন পর ভাইয়ার জ্বর, এরপর সবার শেষে এলো আমার জ্বর!
শুরুতে কোভিড টেস্ট না করলেও পরে সবাই টেস্ট করাই এবং টেস্ট করার ৩ দিন পর রিপোর্ট পাই- সবাই পজিটিভ! প্যানিকড না হয়ে বাসায় অক্সিমিটার কিনে আনলাম, প্রতিদিন কয়েকবার করে চেক করতাম বাবা-মা'র অক্সিজেন স্যাচুরেশন। চেক করে দেখলাম যে দিন দিন স্যাচুরেশন কমে যাচ্ছে আব্বুর, সাথে প্রচুর কাশি তো ছিলই। আমাদের প্রত্যেকেরই প্রচন্ড কাশি ছিল, কাশতে কাশতে সবার এমন অবস্থা হয়েছিল যে কথাই বলতে পারতাম না। এ ছাড়া সবারই ঘ্রাণশক্তি চলে গিয়েছিল। খাবারের ঘ্রাণ-টেস্ট কিছুই পেতাম না কেউ, শুধু পেট ভরার জন্যই যেন খেতাম।
আব্বুর স্যাচুরেশন দিনদিন কমে যাচ্ছিল, আম্মু তাই ভীষণ ঘাবড়ে গেল। আম্মুর শরীর ঠিকই ছিল, কিন্তু ঘাবড়ে যাওয়ার কারণে শরীর খারাপ হয়ে গেল। ফলে দুইজনকেই ভর্তি করা হলো হাসপাতালে। আমি আর ভাইয়া দুইজনই যেহেতু পজিটিভ ছিলাম, আমাদেরও রুমবন্দী অবস্থায় থাকতে হচ্ছিল। এ ক্ষেত্রে আব্বু-আম্মুকে হাসপাতালে ভর্তি থেকে শুরু করে যাবতীয় দরকারে পাশে ছিল ভাইয়ার একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু, যিনি আবার কয়দিন আগে কোভিড পজিটিভ থেকে নেগেটিভ হয়েছেন।
পজিটিভ রিপোর্ট পাওয়ার দশ দিন পর আব্বু-আম্মুকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলো, এক সপ্তাহ তারা ভর্তি ছিল হাসপাতালে। এরপর পুনরায় কোভিড টেস্ট করে রেজাল্ট নেগেটিভ আসার পর রিলিজ নিয়ে তারা বাসায় আসেন। এই এক সপ্তাহ তারা হাসপাতালের খাবারই খেয়েছেন, যেহেতু করোনা ইউনিটে কারও প্রবেশাধিকার নেই, তাই তাদের সাথে কে থাকবে না থাকবে সে নিয়ে চিন্তা করতে হয়নি আমাদের।
আমি আর ভাইয়া এই ১৭ দিন বাসায়ই ছিলাম। কাছাকাছি আমাদের আত্মীয় যারা আছেন, তারা এসে বাসার নিচে খাবার দিয়ে যেতেন, আবার অনলাইনে অর্ডার করেও খাবার খেয়েছি। খাবারের মধ্যে স্পেশাল কোনো খাবার বলতে প্রচুর ভিটামিন সি খেয়েছি। শরীর অনেক বেশি দুর্বল লাগতো, তাই প্রোটিন খাওয়া হয়েছে সবচেয়ে বেশি। মাল্টা, সিভিট, লেবু, গরম চা খেয়েছি প্রচুর৷ ডাক্তার কিছু ওষুধ সাজেস্ট করেছিলেন, ভাইয়া সেসব কন্টিনিউ করলেও আমি কোনো ওষুধই খাইনি। আর যেটা করেছি, তা হলো গরম পানির ভাপ নিয়েছি ঘনঘন।
আব্বু-আম্মু হাসপাতালে ভর্তির পর ভাইয়া মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়েছিল, আমি শুরু থেকেই খুব পজিটিভ ছিলাম। আমি ছোট বোন হয়ে উল্টা ভাইয়াকে সাহস জুগিয়েছি৷ আমার কাছে মনে হয় এই সাহসটা, পজিটিভিটিটা আমি গত ৪ মাসে অর্জন করেছি। ভার্সিটি বন্ধ হওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন ইসলামিক বই-পত্র পড়া শুরু করি, নিজ ধর্মের প্রতি এক অন্যরকম টান অনুভব করা শুরু করি তখন থেকেই। ভেতর থেকেই মনে হতো, যা কিছু হচ্ছে, হবে, সব আল্লাহর হুকুমেই হবে, ভালোর জন্যই হবে। তাই আমার ভেতরে সবসময় একটা পজিটিভিটি কাজ করতো। এই কারণেই আমার মনে হয় আমি মানসিকভাবে শক্ত থাকতে পেরেছি। এছাড়া আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধবরাও আমাদের মানসিকভাবে অনেক সাহস জুগিয়েছে।
তবে করোনা নেগেটিভ হওয়ার পরেও আমরা সবাই শারীরিকভাবে অনেক দুর্বল ছিলাম। আমার যে সমস্যাটা হতো তা হলো, আমি প্রচুর ঘামতাম। এ ছাড়া পরবর্তীতে আর কোনো সমস্যা হয়নি। নিজ থেকেই আমরা তৈলাক্ত খাবার এড়িয়ে চলেছি, স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার চেষ্টা করেছি।
এই লেখা যারা পড়ছেন, তাঁদের প্রতি অনুরোধ থাকবে, করোনা হলে কোনোভাবেই দুশ্চিন্তা করবেন না প্লিজ। মনকে অশান্ত করবেন না। নিজ নিজ ধর্মের প্রতি মনোযোগী হলে অনেক সাহস পাওয়া যায়, আমি অন্তত পেয়েছি। করোনা একটি সাধারণ অসুখ, বাড়তি চিন্তা করে এই অসুখকে প্রশ্রয় দিবেন না।