সদ্যই তখন ওয়ারিতে আমাদের সামনের বিল্ডিংয়েই করোনা পজিটিভ হয়ে মারা গেছেন একজন। পুরো এলাকায় কড়াকড়ি লক ডাউন চলছে, খুব বেশি দরকার ছাড়া বাইরে বের হতো না কেউ। আমাদের বাসায়ও সবাই বাসায়ই থাকতাম। টুকটাক বাজারের উদ্দেশ্যেই কেবল বাইরে বের হতেন বাবা। এমনই একদিন, মনে আছে ১৬ রোজা ছিল সেদিন, বাজার থেকে আসার পর বাবার জ্বর চলে আসে।
আমার বাবা অ্যাজমা রোগী, সারা বছরই ঠান্ডা লেগে থাকে। তাই আব্বুর কাছে জ্বরটা নরমালই লাগছিল শুরুতে। কিন্তু ২ দিন পরই জ্বরের পাশাপাশি বাবার শুকনা কাশি, গলা ব্যথা, শ্বাস কষ্টও হতে লাগলো। এদিকে বাবার জ্বরের ৫ দিন পর মায়েরও জ্বর এলো। সবার শেষে এলো আমার জ্বর। আমার আর মায়ের জ্বর খুব বেশি ছিল না, ১০০-১০১ এর মতো। আমার দুইদিন জ্বর থেকে চলেও যায়। কিন্ত বাবার জ্বর অনেক বেশি ছিল, প্রায় ১০৪ এর মতো।
মায়ের জ্বর আসার ২-৩ দিন পর মুখের টেস্ট চলে যায়। এছাড়া শুকনা কাশি ছিল তার। আর আমি শুরু থেকেই কোনো সিম্পটম টের পাইনি, কেবল দুর্বলতা আর শরীর ব্যথা ছাড়া। আমার শরীর ভয়ানক দুর্বল লাগতো। আর শরীরে এত ব্যথা ছিল, মেরুদন্ড থেকে শুরু করে প্রতিটা হাড়ে যেন ব্যথা টের পেতাম।
আমাদের বাসা থেকে ৫ মিনিট দূরত্বে আমার মামার বাসা। মামাতো বোন আবার ঢাকা মেডিকেলের ডাক্তার। তো সবার জ্বর আসার পর মামাতো বোন আমাদের কোভিড সাসপেক্টেড ধরে নিয়ে টেস্ট করতে বলে সবাইকে। বাসায় তখন ছোট বাচ্চাসহ আপুও ছিল, তাই রিস্ক না নিয়ে শুরুতেই আপুকে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দেই।
এদিকে করোনার জন্য টেস্টও করাতে পারছিলাম না, কারণ বাবা-মা অল্পতেই অনেক বেশি ঘাবড়ে যান। করোনা পজিটিভ হওয়ার আগে তারা আতঙ্কেই কাবু হয়ে পড়বেন জানি। এদিকে দিনদিন বাবার শ্বাসকষ্টের সমস্যা বেড়ে যাচ্ছিল। হাসপাতালে ভর্তি করতে হলেও তো করোনা টেস্ট করানো লাগবে। টেস্ট রিপোর্ট ছাড়া তো ভর্তি নিবে না কোথাও।
তাই সিদ্ধান্ত নেই টেস্ট করাব, এরপর পজিটিভ যদি এসেও থাকে তাহলে বাবা-মা'র কাছে মিথ্যা বলবো। কারণ আমি জানতাম আমার বাবা-মাকে। পজিটিভ হয়েছেন শুনলে মানসিকভাবে খুব বেশি ভেঙে পড়বেন, কেননা তখন চারদিকে শুধুই আতঙ্ক আর আতঙ্ক। কোভিড পজিটিভ মানেই মৃত্যু- এমন ধারণাই পোষণ করে রেখেছিলেন তারা।
তো মামাতো বোনের সহযোগিতায় প্রাইভেটলি বাসায় নমুণা দেই আমরা। রিপোর্ট পাই- পজিটিভ। আমি আর মা সম্পূর্ণ সুস্থ ছিলাম, দুর্বলতা ছাড়া আর কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু বাবা যেহেতু ডায়াবেটিস রোগী, তাই তার জন্যই ভীষণ চিন্তিত হয়ে গেলাম। প্ল্যানমতোই বাবা-মা কাউকে জানাইনি পজিটিভ রিপোর্টের কথা, শুধু আমি, আমার বোন আর মামা বাড়ির সবাই জানতো। বাবা-মাকে বলেছি বাবার ম্যালেরিয়া হয়েছে।
যাহোক, মামাতো বোনের কথামতো আমরা বাবাকে ট্রিটমেন্ট করিয়ে যাচ্ছিলাম। তার রেগ্যুলার ওষুধ-পত্র তো চলছিলোই, সাথে সবাই গরম চা খেয়েছি প্রচুর, প্রতিদিন সকালে খালি পেটে গরম পানির সাথে লেবু মিশিয়ে খেয়েছি। অনেকে চিনি মিক্স করে খান, কিন্তু মামাতো বোন নিষেধ করেছিল চিনি মেশাতে। আর যেটা এক্সট্রা করেছি তা হলো গরম পানি দিয়ে কুলকুচি করেছি বারবার। বাবার শ্বাসকষ্টের সমস্যা হলে মেনথলের ভাঁপ নিয়েছে, এটা কাজে দিয়েছে অনেক।
যেহেতু মায়ের নিজেরও শরীর ভীষণ দুর্বল ছিল, আবার বাবার টেক কেয়ার মাকেই করতে হতো, তাই রান্না-বান্নার সুযোগ তেমন ছিল না। মামা বাসা থেকেই খাবার পাঠানো হতো বেশীরভাগ সময়, আবার আমিও টুকটাক যা পেরেছি, রান্না করেছি।
সব রকম পরিস্থিতির জন্য আমি নিজেকে প্রস্তুত রাখার চেষ্টা করি, মানসিকভাবে শক্ত থাকি। বাবা-মাকে সাহস দিয়ে যাচ্ছিলাম শুরু থেকে, কিন্তু একটা পর্যায়ে আমি নিজেই আর শক্ত থাকতে পারিনি। রুমের দরজা আটকিয়ে কেঁদেছি পর্যন্ত।
আমি পুরান ঢাকায় বড় হয়েছি। বন্ধু-বান্ধব, খাওয়া-দাওয়া, হৈ-হুল্লোড়ে মেতে থেকেই অভ্যস্ত আমি। আর ঈদ মানে তো আমার কাছে বিশেষ কিছু। ইফতারের হাট, চাচাতো-মামাতো ভাইবোন একত্রে হওয়া, সালামী, জম্পেশ খাওয়া-দাওয়া, বাইকে করে ঘুরতে যাওয়া, বন্ধুর বাসার ছাদে পার্টি.. আনন্দের-উৎসবের কমতি নেই। কিন্তু আমার ২৩ বছরের জীবনে এই ঈদটা ছিল একটা অভিশপ্ত ঈদ। প্রতি ঈদেই আব্বু ঘুম থেকে তুলে ঈদের নামাজ পড়তে নিয়ে যেত। এই একমাত্র ঈদ, যেদিন আব্বু আমাকে ডেকে তুলেনি, আমরা বাপ-ব্যাটা একসাথে নামাজ পড়তে যাইনি, বন্ধু-বান্ধবের সাথে নামাজ শেষে কোলাকুলি করিনি। এরকম ঈদ যেন কারও জীবনে কোনোদিন না আসে।
এই ঈদের নামাজ আমরা ঘরে পড়েছি, ছাদে গিয়ে এক ছাদ থেকে আরেক ছাদে বন্ধুদের সাথে হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জারে কোলাকুলি করেছি। বাসায় সেমাই পর্যন্ত রান্না করেনি আম্মু, মামা বাসা থেকে মামী সেমাইসহ অন্যান্য খাবার পাঠিয়েছে, সেই খাবার খেয়ে ঈদ উদযাপন করেছি। হৈ-হুল্লোড় ছাড়া, আনন্দ ছাড়া, নিভৃতে, একা। কতটা বিপর্যস্ত লেগেছিল সে সময়টায়, বলে বা লিখে বোঝানো সম্ভব নয়। তবে মামাতো বোন, বন্ধু-বান্ধব অনেক সাহস যোগানোর চেষ্টা করেছে এটা বলতেই হবে৷
যাই হোক, ধীরে ধীরে আব্বুর অবস্থার উন্নতি হয়। যেহেতু মামাতো বোনের সাথে সমসময় কনসাল্ট করছিলাম, তাই সে যখন বললো পুনরায় টেস্ট করতে, তখন আবার সবাই টেস্ট করি এবং আল্লাহর রহমতে নেগেটিভ হই। এই বিপর্যস্ত দিনগুলোতে আমাকে আরও বেশি অসহায় করে দিচ্ছিল নেগেটিভ নিউজগুলো। যখন বুঝতে পেরেছি সোশ্যাল মিডিয়ায় কানেক্টেড থেকে চারপাশের খবরগুলো শুনে-পড়ে মানসিকভাবে আরও দুর্বল হয়ে যাচ্ছি, তখন ফেসবুক, মেসেঞ্জার, টিভি- সব কিছু থেকে ব্রেক নেই, ডিসকানেকটেড হয়ে যাই। মানসিক প্রশান্তির জন্য নামাজ পরতাম আর আল্লাহকে বলতাম যাতে আব্বাকে সুস্থ করে দেন।
একজন করোনাজয়ী হিসেবে সবাইকে বলতে চাই, করোনা প্রায় পুরোটাই স্বাভাবিক ফ্লু'র মতো। আমার যে মামাতো বোনের কথা বললাম, যে এখনও ঢাকা মেডিকেলে ফ্রন্ট লাইনে চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছে, তার নিজেরই ৪ বার কোভিড পজিটিভ এসেছে, কিন্তু কোনো সিম্পটম ছিল না। তাই কোভিডকে বড় করে না দেখে সচেতনতার সাথে, সাহসের সাথে মোকাবিলা করুন। করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রধান অস্ত্র মনোবল, এটাকে কোনোভাবেই ভাঙতে দিবেন না, ভয় পাবেন না। খুব বেশি জটিলতা না থাকলে আপনিও অবশ্যই জয়ী হবেন।