গত ১লা মে ভোরবেলায় প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে উঠেছিলাম। অভ্যেস বশত মোবাইলটায় চোখ দিলাম। দেখি আইইডিসিআরের একটা মেইল। সংক্ষিপ্ত করে লেখা: কোভিড-১৯ পজিটিভ। তারপর একটা যুদ্ধ শুরু হলো, নিজেকে একদম বিচ্ছিন্ন করে ফেলা, ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলা, অদৃশ্য এক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অন্যরকম একটা দ্বৈরথে নামা, যেখানে হেরে যাওয়া মানেই চিরবিদায়!
আক্রান্ত প্রত্যেক রোগীর লড়াইটা শুরু হয় রিপোর্ট পাওয়া মাত্র। এটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে ওঠে- এখন আমি কী করব! আমার এখন কী হবে? এটা যতো না শরীরের সাথে লড়াই, তার চেয়ে অনেক বেশী মনের লড়াই। একটা জিনিস মনে রাখবেন, করোনাভাইরাস খুব অল্প লোককেই হাসপাতালে নিতে পারে। বিশ্বাস রাখুন, আপনি সেই ১০ শতাংশের একজন হবেন না। ৯০ শতাংশের মতোই বাসায় নিরাপদে থাকুন। আমি চিকিৎসক নই, মনোবিদও নই। ফলে আমার কোনো পরামর্শকে 'বিশেষজ্ঞের উপদেশ' বলে ধরে নেবেন না। স্রেফ আমার অভিজ্ঞতাটা সবাইকে জানাচ্ছি। আমি প্রায় উপসর্গহীন ছিলাম। এখন সারা বিশ্বে বেশিরভাগই উপসর্গহীন করোনা রোগী। তাই আমার অভিজ্ঞতা কারো কাজে লাগলেও লাগতে পারে।
তার আগে একটু বলে নিই, ২৮ এপ্রিল সন্ধায় আমার প্রথম একটু জ্বর জ্বর লাগছিলো। পরে রাতে জ্বর বাড়লো। ১০১ ডিগ্রি হলো। ১০২.৫ ডিগ্রি উঠেছিলো ভোররাতে। নাপা খেলাম। দুপুর পর্যন্ত জ্বর যাচ্ছিল, আসছিল। এরপর থেকে আর জ্বর ছিলো না। তখন আইইডিসিআর বাড়ি থেকে স্যাম্পল কালেকশন করতো। যোগাযোগ করলাম, পরদিন বিকালে ওরা স্যাম্পল নিতে এলো। সেটা ছিলো ৩০ এপ্রিল। তারপরের রাতের শেষে ভোরে আমি মেইলে রিপোর্ট পাই- রেজাল্ট পজিটিভ।
• রিপোর্ট পাওয়ার সাথে সাথে পরিবারের সবার থেকে নিজেকে আলাদা করে ফেলেছি। একটা আলাদা রুমে থেকেছি পরের রিপোর্ট নেগেটিভ না হওয়া অবধি। কতোদিন আলাদা থাকবেন, এ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত আছে। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুসরণ করবেন।
• রুম থেকে বের হইনি। আমার রুমের সাথেই বাথরুম ছিল। সেই বাথরুমে নিজের জন্য আলাদা সাবান, পেস্ট- সবকিছু আলাদা করে নিয়েছিলাম।
• রুমের বাইরে একটা টেবিল রাখা ছিল। সেখানে আমার পরিষ্কার করা প্লেট, বাটি রাখা থাকতো। স্ত্রী এসে সেখানে খাবার দিয়ে যেতো। আমি ওটা ভেতরে নিয়ে নিতাম। আবার খাওয়া শেষে নিজে সাবান দিয়ে পরিষ্কার করে ওখানে রেখে দিতাম।
• সময় কাটানোর জন্য প্রতিদিন সকালে উঠে কম্পিউটারে কিছু গান শুনতাম। দুপুরের আগে চেষ্টা করতাম একটা সিনেমা দেখার। আবার বিকেলে একটা সিনেমা দেখতাম।
• দিনে একটা করে সিভিট ট্যাবলেট, একটা জিংক ট্যাবলেট খেয়েছি এবং একটা কাশির সিরাপ তিন বার খেয়েছি প্রতিদিন। সপ্তাহে একটা ভিটামিন ‘ডি’ ট্যাবলেট খেয়েছি। ওষুধ কোনোক্রমেই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া খাবেন না।
• প্রচুর চা খেয়েছি; আদা দেওয়া। এ ছাড়া গরম পানি, আদা জ্বাল দেওয়া পানি এবং লবঙ্গ-এলাচ জ্বাল দেওয়া হালকা গরম পানিও খেয়েছি। প্রচুর গার্গল করেছি। এসব জ্বাল দেওয়া পানির ধোঁয়া নাক দিয়ে টানার কথা বলেছিলেন অনেকে; আমি খুব একটা করতে পারিনি।
• সকাল ও বিকেলে ফুসফুসের কিছু ব্যায়াম করেছি। ইউটিউবে সুন্দর সুন্দর ব্যায়াম পাওয়া যায়। দেখে দেখে করতে পারেন। সময়ও ভালো কাটে।
• শেষ ক'টা দিন আমার খুব মানসিক অস্থিরতা ছিল। একটা দুটো প্যানিক অ্যাটাকও হয়েছে। একজন বিশেষজ্ঞ মনের ডাক্তার আমার পরিচিত। উনার পরামর্শ নিয়েছি ফোনে। কিছু ট্রিকস বলেছেন। খুব কাজে দিয়েছে।
* রিপোর্ট পাওয়ার পর যত দ্রুত সম্ভব একজন ডাক্তারের সাথে আলাপ করুন। পুরোটা সময় তার সাথে যোগাযোগ রাখুন। তাকে প্রতিদিনের আপডেট জানান।
* বাজারে পালস অক্সিমিটার বলে একটা যন্ত্র পাওয়া যায়। ৫০০ থেকে ৩৫০০ টাকা দামের পাওয়া যায়। করোনা সংক্রমণে বড় ভয় হলো শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়া। অনেক সময় নিজেও ধরা যায় না যে, এটা শুরু হচ্ছে। নিয়ম করে অক্সিমিটারে অক্সিজেন স্যাচুরেশন দেখুন। ৯৪-এর নিচে নামলে ডাক্তারকে জানান।
* বাসার সবার সাথে পালা করে কথা বলুন। তারা দরজার বাইরে থাকবে। আপনি একদম ঘরের আরেক প্রান্তে। এই অবস্থায় মাস্ক পরে কথা বলুন। মনে রাখবেন, চোখের দেখায় ভাইরাস ছড়াবে না। তবে বাচ্চারা যেন দৌড়ে ঢুকে না পড়ে, সে জন্য বড় কেউ সাথে থাকবে।
* একটা অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করে রাখুন। কোন হাসপাতাল কাছে, সেটা খোঁজ নিয়ে রাখবেন। দরকার হবে না হয়তো। তারপরও দরকার হলে যেন থতমত খেতে না হয়।
* যে রুমটায় থাকবেন, ওটাতে জানালা থাকলে খুব ভালো হয়। জানালা দিয়ে বিশাল দুনিয়াটা দেখুন।
* আমার মনোবিদ বলেছেন, ডোন্ট ফলো স্কোর অব করোনা। এটা ক্রিকেট নয়। ফেসবুক বা নিউজ সাইট খুলেই করোনার স্কোর, খবর দেখা বন্ধ রাখুন।
* ১৪ দিন পার হলে নেগেটিভ টেস্ট করাতে হবে। চেষ্টা করুন, এই সাথে বাসার সবার একটা টেস্ট করাতে।
করোনায় আক্রান্ত অনেকেরই স্বাদ এবং ঘ্রাণশক্তি দূর্বল হয়ে যায় বলে শুনেছি। তবে আমার ক্ষেত্রে এমন কিছু হয়নি। খাওয়ায় কোনো সমস্যা ছিল না। খেতে পেরেছি। স্বাদ-গন্ধ পাচ্ছিলাম ঠিকমতো। রুচিও ছিলো। ভিটামিন সি ট্যাবলেট খেতাম প্রতি দিন। এ ছাড়া মাল্টা, আনারস জাতীয় ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার খেতাম। শ্বাসকষ্ট হয়নি। মাঝে মাঝে প্যানিক লাগতো। মনে হতো, শ্বাসকষ্ট হবে। তখন কিছু ব্রিদিং এক্সারসাইজ করতাম। এছাড়া অক্সিমিটার ছিলো। ওটাতে দেখতাম, অক্সিজেন ঠিক আছে। তবে ভুগিয়েছে লুজ মোশন। দুই দফায় বেশ কষ্ট পেয়েছি। তাতেও ডাক্তার ঘরোয়া ট্রিটমেন্টেই জোর দিয়েছেন।
যাদের করোনায় জটিলতা হয়, তারা তো অনেক রকমের কষ্ট পান। তবে আমার মতো যাদের বাসায় বসে ট্রিটমেন্ট চলে, তাদের সবচেয়ে বড় শাস্তি হলো পরিবার থেকে দূরে থাকা। আমার জন্য এটা অসহনীয় একটা ব্যাপার ছিলো। আমার ছেলে-মেয়ে আমাকে ছেড়ে থাকতেই পারে না। ছেলেটা বড়; ও বাবার বেশী ন্যাওটা। রোজ সকালে এসে দিন গুনতো। দরজার বাইরে থেকে গল্প শুনতো। আর মেয়েটা বলতো, ‘বাবা, তোমাকে একটু জড়ায়ে ধরি?’
মে মাসের ১২ তারিখে ফিরতি টেস্ট হয়েছে। ১৪ তারিখে রিপোর্ট পেয়েছি। রিপোর্ট পাওয়া মাত্রই ছেলে এসে জড়িয়ে ধরেছে। চিৎকার শুনে মেয়ে আর বৌ ছুটে এসেছে। আমার জীবনে আমি এতো কান্নাকাটি করিনি। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলাম। মেয়ে আমাকে বলে, আর ভয় নেই; আমি আছি। করোনা নেই; ভয় নেই। এটা সম্ভবত আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আনন্দের সময় ছিল।
নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, করোনা নিয়ে অযথা ভয় বা আতঙ্কের কিছু নেই। নিয়ম মতো চললে, ডাক্তারের পরামর্শ মানলে, এবং বড় ধরণের কোন শারীরিক অসুস্থতা না থাকলে আপনাকে হাসপাতাল পর্যন্ত টেনে নেয়ার সাধ্য করোনার হবে না। করোনা থেকে পালিয়ে বাঁচার জায়গাটা আমরা পার করে এসেছি, এখন ভাইরাসটার মুখোমুখি হয়েই একে প্রতিরোধ করতে হবে। সেটার জন্যে শারীরিক এবং মানসিক- উভয় ধরনের প্রস্তুতিই এই মুহূর্তে খুব দরকারী।