এগিয়ে চলো এক্সক্লুসিভ

১২১৫ নম্বর কেবিনটা আমাকে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছে

5 / 30

১২১৫ নম্বর কেবিনটা আমাকে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছে

১২১৫ নম্বর কেবিনটা আমাকে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছে
  • পড়তে সময় লাগবে মিনিট
  • পড়তে সময় লাগবে মিনিট

আশিকুর রহমান মজুমদার 

করোনাভাইরাস। কতো ছোট্ট একটা ভাইরাস। অথচ কী বিশাল তার  ব্যাপ্তি। পুরো দুনিয়াটাতেই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এই হতচ্ছাড়া জীবাণুটা। আসলে আমি যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারি এটা ভাবতেও পারিনি। কোথা থেকে যে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলাম নিজেও জানি না। 

আমি দর্শণ ভালোবাসি। জীবনবোধ নিয়ে নানা বিষয় আমাকে ভাবায়। এই বিষয়ে একটু আকটু পড়াশোনা করার চেষ্টা করি অবসর পেলেই। আমি সব সময় স্বামী বিবেকানন্দের দর্শন পড়ি। জীবে দয়া করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর- এই দার্শনিক বাণীতে উদ্বুদ্ধ হয়ে মানুষের সেবায় লিপ্ত হয়েছিলাম। 

আমি যেখানে থাকি দেখলাম পাশের গলিতে মানুষ খুব কষ্টে আছে। এক দিন এক নারী কান্না করে বলছিলেন, দুই কেজি ত্রাণের চাল বিক্রি করবেন ছেলের চিকিৎসার টাকা জোগাড় করতে। ঘটনাটা আমার মনকে খুব নাড়া দেয়। আমি তখনই সিদ্ধান্ত নিই যে আমাকে তাদের জন্য কিছু করতে হবে।

সাথে রাখুন সেপনিল হ্যান্ড স্যানিটাইজার

পরিবারকে জানাই আমি সশরীরে মানুষের সেবা করবো। এটা শুনে প্রথমেই আমার স্ত্রী সরাসরি নিষেধ করেছিলো। সে আমাকে কোনোভাবেই এই পথে এগুতে দিতে চাচ্ছিলো না। তখন তাকে বুঝিয়ে বলেছিলাম, সবাই ঘরে বসে থাকলে, মানুষের পাশে থাকবে কে। সবাই তো ফোনে ফোনে কাজ সারে, আমি সরাসরি মানুষের পাশে থাকতে চাই। সেই থেকে মানুষের বাসায় বাসায় গিয়ে খাদ্য পৌঁছে দিতাম। নিজের সাধ্যমত মানুষকে সাহায্য করার চেষ্টা করতাম। এলাকার অভুক্ত বোবা প্রাণীদেরকেও খাওয়াতাম।     

গত ১২ই মে হঠাৎ করে জ্বর আসে আমার। বুঝতে বাকি রইলো না যে ঐ মরণঘাতী হয়তো আমার শরীরেও বাসা বেঁধে ফেলেছে এতোদিনে। তাই জ্বর না মেপে সেদিনই সোজা হাসপাতালে পরীক্ষা করাতে যাই। মনে মনে প্রার্থনা করছিলাম যেন রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। ১৫ তারিখে যখন ‘রিপোর্ট পজিটিভ’ এলো, তখনও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।

চোখের সামনে ভেসে উঠলো স্ত্রী ও দুই সন্তানের চেহারা। কান্না পাচ্ছিলো এটা ভেবে যে- আমি মরে গেলে ওদের কী হবে! তখন আমার স্ত্রী যে কিনা নিজেই ভয় পেয়ে আমাকে এসব করতে নিষেধ করেছিলো, সে-ই খুব সাহস দিয়ে বললো, 'আমরা সাহস রাখছি, তুমিও সাহস রাখো।' ক্রিকেট খেলতাম একসময়। এখন পেশায় বিসিবির বোলিং কোচ। খেলোয়াড়ি জীবনে কতজনকে আউট করেছি, কোচিং ক্যারিয়ারেও অন্যদের শিখিয়েছি কিভাবে জিততে হয়। এবার ছিলো নিজের ঘুরে দাঁড়াবার পালা, করোনাকে জয় করবার মিশন।

প্রচণ্ড মানসিক জোর, সাথে খাদ্য শৃঙ্খলা- সবকিছু মিলিয়েই যুদ্ধটা চালিয়ে যেতে হয়েছে আমাকে। শুরুটা ছিলো ১৫ই মে। সেদিন মুগদা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হই। ১২১৫ নম্বর কেবিন দেওয়া হয় আমাকে। এই নাম্বারটা কখনোই ভুলতে পারবো না আমি। এক দুই এক পাঁচ, জীবনের সাথে মিশে যাওয়া চারটা সংখ্যা। যা জীবনকে নতুনভাবে চিনিয়েছে।

খুবই নিঃসঙ্গ, দারুণ একা মনে হচ্ছিলো নিজেকে। শুরুতে সবকিছু এলোমেলো লাগছিলো।  স্বামী বিবেকানন্দের বই পড়ে আর ধ্যান করে সময় কাটাতে শুরু করলাম। চেষ্টা করলাম মানসিক শান্তি ফিরিয়ে ফিরিয়ে আনার। সেটাই মূল লক্ষ্য ছিলো প্রথমে। গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা কাজে দিয়েছে আমার। সেই অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি অসুখের সময় ধ্যান খুব কাজে দেয়।  করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর সেটা আরও বুঝলাম।

১২১৫ নম্বর কেবিনের দিনগুলো আমার জীবনের জন্য দারুণ এক শিক্ষা। কাজকর্ম না করায় সুগার লেভেল ও কোলেস্টেরল বেড়ে গিয়েছিলো। বাঁচার জন্য তীব্র সংগ্রামে লিপ্ত হই। পরিবারের পাশাপাশি, এই পুরো সংগ্রামের সময়টাতে আমাকে ছায়া দিয়ে আগলে রেখেছে বিসিবি, কোয়াব থেকে শুরু করে আমার প্রিয় কলিগ, শ্রুদ্ধেয় অগ্রজ এবং স্নেহের অনুজেরা। আর আমার বন্ধুবান্ধবের কথা বিশেষ করে উল্লেখ না করলেই নয়। আমি তাদের সবার কাছেই আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো। এবং সবসময় তাদের জন্য দোয়া করবো। 

আমাদের ওয়ার্ডের সভাপতি মাসুদ হাসান শামীম ভাই আমাকে ও আমার পুরো পরিবারকে সর্বাত্মক সাহায্য-সহযোগীতা করেছেন। হাসপাতালে বিশেষ খাবার সরবরাহ করেছেন মুগদা থানার সেক্রেটারি রাজা ভাই। ৪ নং ওয়ার্ডের কমিশনার জাহাঙ্গীর হোসেন ভাই, ৫ নং ওয়ার্ডের কমিশনার চিত্ত রঞ্জন দাস দাদা আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন। 

আমার সাথে নিঃস্বার্থভাবে ত্রাণের কাজ করেছে ফয়সাল, সুমন, সাজ্জাদ। ওরা যেভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে, তাতে মনে হয়েছে ওরাও করোনাযোদ্ধা। সিলেক্টার শিপন ভাই, শান্ত ভাই, হান্নান সরকার এর কাছে আমি কৃতজ্ঞ। যার হাত ধরে কোচিং এর জগতে প্রবেশ করেছি আমি, সেই জুয়েল ভাই অনেক করেছেন আমার জন্য। কোচ এহসান স্যার, ওয়াহিদ স্যার, ইমরান স্যার, ফাহিম স্যার, বুলবুল স্যার, অপি স্যার, সোহেল স্যার, মোর্তুজা স্যার অনেক মোটিভেট করেছেন আমাকে। 

ক্রিড়া সংগঠক সাইফুল ভাইকে পাশে পেয়েছি সবসময়। ক্রিকেটার ইমরুল কায়েস, মোহাম্মদ মিঠুন, মমিনুল হক, আনামুল হক বিজয়, মাহিদুল ইসলাম অংকন আমার খোজ-খবর নিয়েছে নিয়মিত। ট্রেনার সিজার, তুষার, ডালিম এবং জিএম ডেভেলপমেন্টের কাওসার ভাই, রাশেদ ভাই, শহীদ ভাই, কামরুল ভাই, সাফাত ভাই, সাফা ভাইদের পাশে পেয়েছি সবসময়। 

আমি কৃতজ্ঞতা জানাই, বিসিবির সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন ভাইকে। নিজামুদ্দিন, সুজন স্যারেরা আমাকে দেখে রেখেছেন অভিভাবকের মতো করে। বিসিবির সাবেক সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী, যিনি না থাকলে আমার পক্ষে এ পথ পাড়ি দেয়া সম্ভব হতোই না। 

কোয়াবের পক্ষ থেকে আমির আমাকে কেটলি ও কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে দেয়। কেটলিতে গরম পানি করতাম, ভেষজ সিদ্ধ করে খেতাম চার বেলা। গারগল করতাম নিয়মিত। ক্রিকেট বোর্ডের আমির খুব সাহায্য করেছে। কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে তাকে ফোন দিতাম। সে আমাকে এবং আমার পরিবারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছে। তাকে দেখে আমার মনে হয়েছে যে সেও একজন করোনা ফাইটার।

মাগরিবের নামাজ পড়ে ইয়োগা, ধ্যান ও শ্বাসের ব্যায়াম করতাম। এক দিন স্বামীজির কথা মনে পড়ে গেলো, চিন্তা করলাম হাসপাতালেও মানুষের সেবা করতে হবে। চিকিৎসক ও হাসপাতালের চেয়ারম্যান সাবের হোসেন চৌধুরী ভাইয়ের অনুমতি নিয়ে রোগীদের শ্বাসের ব্যায়াম ও ধ্যান করাতে শুরু করি। রোগীরা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার আগে আমার সঙ্গে দেখা করে ধন্যবাদ দিয়ে যেত। অসুখের দিনগুলোতেও মানুষের জন্য কিছু করতে পেরে ভালো লাগছিলো।

একটা বড় অভিজ্ঞতা হয়েছে হাসপাতালে- রোগীদের সঙ্গে আক্রান্ত নন এমন আত্মীয়স্বজনও থাকতেন। ভাইরাস আক্রান্ত মামার সেবা করতে দেখেছি ভাগ্নিকে। স্বামীর পাশে দেখেছি স্ত্রীকে। এই মানুষগুলো জানে তারা আক্রান্ত হতে পারে, তবুও প্রিয়জনের সেবা করে গেছে। কৌতূহল থেকে সুস্থ দু'জন নারীর কাছে জানতে চাই তারা কেন এভাবে ঝুঁকি নিয়ে রোগীর সেবা করছেন। তারা বলেছিলেন, কেউ রোগীকে দেখার নেই। তাই তারা সেবা করছেন। 

বিসিবির বোলিং কোচ আশিকুর রহমান মজুমদার। একজন করোনাজয়ী। 

বুঝলাম মনের জোরই আসল। তবে হাসপাতালের ১৬ দিন ক্লিনারদের দেখে খুব খারাপ লাগতো। তারা পরিবারের কাছে যেত পারতো না। কিছু জিজ্ঞেস করলেই কেঁদে দিত। বিসিবির কাছে আমি অনেক কৃতজ্ঞ। সিইও সুজন স্যার অনেক সাপোর্ট দিয়ে গেছেন। দুর্জয় ভাই, সুজন ভাই, দেবু দা সাপোর্ট দিয়েছেন কোয়াবের পক্ষ থেকে। আমির ছিলো আমার অবলম্বন। এই করোনাভাইরাসের মধ্যেও ক্রিকেটার আশরাফুল দেখা করতে চেয়েছে, আমি নিষেধ করেছি আসতে। এ সময় করোনা রোগী দেখতে যাওয়া মানে নিজেকেই রোগী বানিয়ে ফেলা। ইমরান স্যার, ওয়াহিদুল গনি স্যার নিয়মিত ফোন করতেন। কুমিল্লা থেকে ফোন করে মানুষ জানিয়েছে আমার সুস্থতা কামনা করে মিলাদ দিয়েছেন তারা।    

৩১শে মে। সে ঐতিহাসিক দিন। যেদিন প্রথম জানলাম আমি করোনামুক্ত, অবিশ্বাস্য লাগছিলো। প্রথমে যেমন বিশ্বাস হয়নি আমি করোনায় আক্রান্ত হতে পারি, সেদিনো বিশ্বাস হচ্ছিলো না যে আমি করোনামুক্ত হতে পারি। আমি করোনা নেগেটিভ- এটা জানার পরে বুক ভরে যে শ্বাসটা নিয়েছিলাম তাতেই ফিরে এসেছলো আমার জীবনীশক্তি। বিশাল এক স্বস্তি নিয়ে বাসায় ফিরলাম।

শুরু হলো আরেকটি নতুন অধ্যায়। এবার টানা ১৪ দিন হোম কোয়ারিন্টিনে থাকতে হলো আমাকে। পুরোপুরি নিয়ম মেনেই হোম আইসোলেশনে ছিলাম। ১২১৫ নম্বর কেবিন থেকে যা শিখে এসেছিলাম, সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগালাম হোম আইসোলেশনে। আজকে চারদিন হলো সেই অধ্যায়টাও শেষ হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ্‌। এখন আমি পুরোপুরি সুস্থ। 

স্ত্রী সন্তান নিয়ে দারুণ একটা সময় কাটাছে। নতুন করে জীবনটা ফিরে পেয়ে বেঁচে থাকার তাগিদ দ্বিগুণ হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে, হয়তো এই দিনগুলোর দরকার ছিলো জীবনে। অন্যদের কথা বলতে পারবো না। তবে আমি মানুষের কাছ থেকে অনেক ভালোবাসা পেয়েছি। কৃতজ্ঞ সৃষ্টিকর্তার কাছে, নতুন জীবন দিয়েছেন আমাকে। নয়তো কখনোই বুঝে উঠতে পারতাম না, জীবন কতটা সুন্দর! 

পরিশেষে বলতে চাই, আমি পূর্ব বাসাবো গলির বাসিন্দা। এই গলির পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা করেছি করোনায় আক্রান্ত হবার আগে। সুস্থ হয়ে আবারও এই কাজটা চালিয়ে যেতে চাই। আমার গলির বাসিন্দারা যাতে চলাফেরার একটি সুন্দর পরিবেশ পায় সেজন্য আমরণ চেষ্টা থাকবে আমার। এবং সেই সাথে কমিশনার জাহাঙ্গীর ভাইয়ের দৃষ্টি আকর্ষণপূর্বক সর্বাত্মক সাহায্য সহযোগীতা চাই। ধন্যবাদ সবাইকে। সবাই ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন। দেখা হবে বিজয়ে। 

শেয়ারঃ


করোনাজয়ী'র গল্প