খাটো চুল, তামাটে চামড়া- আত্নীয় স্বজনের কাছে 'মেয়ে হয়ে থাকার' উপদেশ আর রাস্তাঘাটে 'ব্লাডি নিগা' গালি শোনা মেয়েটাই কিছুদিন আগে মিস ইউনিভার্সের মুকুট মাথায় তুলেছেন...

উপস্থাপকের কণ্ঠে যখন বিজয়ী হিসেবে জোজিবিনি তুনযির নামটা ঘোষিত হলো, নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আসা এই প্রতিযোগী। এরকমই অবিশ্বাস্য একটা অনুভূতি তার হয়েছিল আড়াই মাস আগে, যখন মিস ইউনিভার্স সাউথ আফ্রিকা হিসেবে তাকে নির্বাচিত করেছিলেন বিচারকেরা। সারাজীবন 'কুৎসিত', 'নিগা', 'ছেলেদের মতো দেখতে' বিশেষন পাওয়া মেয়েটার কাছে পুরো জার্নিটাই তো স্বপ্নের মতো। আর মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে বিশ্বের তাবৎ সুন্দরীদের হারিয়ে মিস ইউনিভার্স হওয়াটা? স্বপ্নপূরণের চেয়েও বেশি কিছু!

ছাব্বিশ বছরের জোজিবিনি তুনযিকে দেখে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ নাক কুঁচকাতেই পারেন। এই মেয়ে মিস ইউনিভার্স নির্বাচিত হয়েছেন, এমনটা শোনার পরে অনেকে ঠোঁট উল্টে ব্যাঙ্গও করতে পারেন। গ্রীক ভাস্কর্যের মতো শরীরের গড়ন, গায়ের রঙটা মার্বেল পাথরের মতোই। চুলগুলো একদম ছোট করে ছাটা- নারী বলতে উপমহাদেশের মানুষ যে প্রতিমূর্তিটা বোঝে, সেটার পুরোপুরি বিপরীত জোজিবিনি তুনযি। নারীত্ব তার শরীরে নয়, বসত করে তার মনের অন্দরমহলে। 

পেশায় তিনি জনসংযোগ কর্মকর্তা, চাকুরী করেন জোহানেসবার্গের একটা বহুজাতিক সংস্থায়। তার কাজটা মূলত নারী সহিংসতা নিয়ে, নারীর ওপর হওয়া নির্যাতনের বহুমাত্রিক রূপ প্রতিনিয়তই চোখে পড়ে তার। মিস ইউনিভার্সের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে তার নামের পাশে লেখা আছে- লিঙ্গ বৈষম্য দূর করাটা তার স্বপ্ন। নারী আর পুরুষের ভেদাভেদ ও সামাজিক অবস্থানের ভিন্নতা নিয়ে মানুষের মনে যেসব ভুল ধারণা আছে, সেগুলো ভাঙার জন্যে কাজ করতে চান তিনি।

জোজিবিনি তুনজি

যে জায়গা থেকে জোজিবিনি উঠে এসেছেন, সেখানে সৌন্দর্য্যের সংজ্ঞাটা প্রচলিত পৃথিবীর মতোই। সেখানেও নারীর লম্বা চুল, গায়ের রঙ কিংবা রূপচর্চাকেই প্রাধান্য দেয়া হয় সৌন্দর্য্যের বিচারে। সেখানে খাটো চুল আর তামাটে গায়ের রঙের কারণে কম কথা শুনতে হয়নি জোজিবিনিকে, হতে হয়েছে হেনস্থাও। কুৎসিত-কদাকার, এমনকি সাদা চামড়ার কারো মুখ থেকে 'ব্লাডি নিগা' গালিও শুনেছেন। পাড়া-প্রতিবেশি থেকে আত্নীয়, সবাই বলেছেন তাকে 'মেয়েদের' মতো হয়ে থাকতে। তুতসির আপত্তি এই জায়গাতেই, মেয়ে হতে হলে স্টেরিওটাইপ কিছু ধ্যানধারণে মেনে চলতেই হবে কেন? 

মিস ইউনিভার্সের মুকুটটা মাথায় নিয়ে জোজিবিনি বলছিলেন, ' আমি সুন্দর কিনা জানিনা, তবে আমি শৈল্পিক। কালোর ভেতর সৌন্দর্য খুঁজে পেতে সমাজের অনেক দিন লেগে গেল। কিন্তু আশার কথা হলো, তবু তো দেরিতে হলেও এই সৌন্দর্য চোখে পড়ল পৃথিবীর! এভাবেই কালো বর্ণের নারীরা সমাজে নিজেদের স্থান করে নেবে। কালো নতুনভাবে সৌন্দর্যের অর্থ তৈরি করবে। দক্ষিণ অফ্রিকা সম্পর্কে মানুষের ধারণা বদলে যাবে।'

সাবলীল আর বুদ্ধিদীপ্ত উত্তরে জোজিবিনি মুগ্ধ করেছেন সবাইকে

তবে মিস ইউনিভার্সের মঞ্চে তুতসির যে বক্তব্যটি সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তুলেছে, কিংবদন্তী উপস্থাপিকা অপরাহ উইনফ্রে যেটার জন্যে টুইট করে জোজিবিনিকে উৎসাহ জানিয়েছেন, সেই প্রশ্নটা ছিল 'তরুণীদের মধ্যে কোন গুণটা থাকা দরকার বলে তার মনে হয়?' জোজিবিনি স্পষ্ট শব্দে উত্তর দিয়েছেন- 

'অবশ্যই নেতৃত্বের গুণাবলি। আমাদের নারীদের মধ্যে এই জিনিসটার খুব অভাব। এমন নয় যে আমরা নেতৃত্ব দিতে পারি না, বরং অন্য যে কারো চেয়ে এটা আমাদের ভালো পারার কথা। কিন্ত পুরুষবাদী সমাজ সেটা চায় না, তারা নারীর কর্তৃত্ব ভয় পায়, নারীর হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে ভয় পায়। আমার মনে হয়, নারী হচ্ছে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ক্ষমতার উৎস, আর তাই নেতৃত্বের সুযোগটাও আমাদের পাওয়া উচিত। আর একদম ছোটবেলা থেকেই মেয়েদেরকে এই বিষয়টা সম্পর্কে সচেতন করে তোলাটা দরকার। নইলে আমাদের মনে নেতৃত্ব নিয়ে ভুল একটা ধারণা তৈরি হয়ে যায় যে, এটা শুধুই ছেলেদের কাজ, এটা বুঝি আমাদেরকে দিয়ে হবে না!'

২০১১ সালে অ্যাঙ্গোলার লেইলা লোপেজ জিতেছিলেন মিস ইউনিভার্সের মুকুট, আট বছর বাদে এসে আরেক কৃষ্ণাঙ্গ তরুণীর মাথায় উঠলো শিরোপাটা। জোজিবিনি তুনযি আরও একবার বিশ্বকে দেখিয়ে দিলেন, আসল সৌন্দর্য্যের বাস মানুষের মনে  মানুষের মগজে। চামড়ায় যে বাহ্যিক রূপটা বাস করে, সেটার নাম সৌন্দর্য্য নয়। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা