“শুক্রবারের এই পবিত্র দিনটাতে এই পাকিস্তানের শত্রু ইন্ডিয়ার দালালগুলারে ঝাড়েবংশে শেষ করতেছি, জেনারেল টিক্কা খান আমার উপর খুশি না হইয়া এইবার যাইব কই?”

ভোর হচ্ছে। ২রা এপ্রিল, ১৯৭১। চারপাশে প্রভাতের কোমল আলো ফুটে উঠছে ধীরে ধীরে। উদ্ভ্রান্তের মত ছুটছেন রায়হান চৌধুরী, এক হাতে স্ত্রী রাফিয়া আর অন্য হাতে মেয়ে নাফিজার হাত শক্ত করে ধরে। আশেপাশে শুধু মানুষ আর মানুষ, ছুটছে সবাই... হঠাৎ বুড়িগঙ্গা নদীর ওই পাড় থেকে তীব্র আলোর রশ্মি আকাশে উঠে গেল, আলোকিত হয়ে গেল চারপাশ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই গুলি শুরু হয়ে গেল, ঠা ঠা ঠা, আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে মর্টারের গোলা পড়তে লাগলো একের পর এক। আশেপাশে সবাই পালাচ্ছে, ছোট্ট নাফিজা হঠাৎ আবিস্কার করলো, তার আব্বুর হাতটা সে খুঁজে পাচ্ছে না, কখন যেন আব্বু-আম্মুকে হারিয়ে ফেলেছে সে। তার অসহায় কান্না ঢাকা পড়ে গেল মরণাপন্ন মানুষের তীব্র আর্তচিৎকারে... যন্ত্রণায়...

ঠিক সেই মুহূর্তে মিটফোর্ড হাসপাতালের ছাদে দাঁড়িয়ে সভ্যতার জঘন্যতম পৈশাচিকতা দেখতে দেখতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার রশিদের মুখে আত্মতৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো, ঢাকা থেকে ২৫ তারিখের পর যে বাঙ্গালীগুলা পালিয়েছিল, সবগুলোকে আজকে এই জিঞ্জিরায় খতম করে দেওয়া যাচ্ছে। এমনিতেই বুড়িগঙ্গার তীরে এই জিঞ্জিরা,কালিন্দী আর শুভ্যাডা থানা তিনটা মালাউনের আখড়া, তার উপর প্রায় এক লাখ লোক পালায়ে আসছে ঢাকা থেকে, আজকে এইগুলারে এইখানেই পাকিস্তানের নামে পুইতা ফেলা হবে। মনে মনে ভাবে সে, “শুক্রবারের এই পবিত্র দিনটাতে এই পাকিস্তানের শত্রু ইন্ডিয়ার দালালগুলারে ঝাড়েবংশে শেষ করতেছি, জেনারেল টিক্কা খান আমার উপর খুশি না হইয়া এইবার যাইব কই?”

বেলা একটু বাড়ার পর পাকিস্তানি সেনারা শুয়োরের মত ঘোঁৎ ঘোঁৎ করতে করতে গ্রামগুলোর ভেতরে ঢুকলো... একের পর এক বাড়িতে ঢুকে সবাইকে ব্রাশফায়ার করলো, মায়ের কোল থেকে বাচ্চাকে কেড়ে নিয়ে আছাড় দিয়ে বুটের নিচে পিষতে থাকলো কয়েকজন, ইত্যবসরে বাকিরা মায়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো, লোলুপ হিংস্রতায়... তারপর বাড়িগুলোকে পুড়িয়ে দিতে থাকলো, একের পর এক... রাস্তায়, পুকুর পাড়ে, ক্ষেতের ভেতর, বাগানে যাকে যেখানে পেল, সেখানেই গুলি করে মেরে ফেলল ওরা, মেয়েদের অনেককে তুলে নিয়ে গেল উচ্চপদস্থ অফিসারের জন্য তোফা হিসেবে।

মান্দাইল গ্রামে ৬০ জনকে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করার পর বেয়নেট দিয়ে গলা আর পেট চিরে দেওয়া হল, কনফার্মেশন... যে চার পাঁচ জন তখনো বেঁচে ছিল, তারা চলে গেল সব যন্ত্রণার উর্ধে... কালিন্দ গ্রামের এক বাড়িতে ১১জন হিন্দু নারীকে পাশাপাশি ফেলে ঝাঁপিয়ে পড়লো অসংখ্য শুয়োর, ধর্ষণ শেষে বেয়োনেট দিয়ে মোরব্বার মত খোঁচালো কিছুক্ষন , তারপর রক্তাক্ত মাংসপিণ্ডগুলোতে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে বেরিয়ে এল ওরা... চারিদিকে শুধু লাশ আর লাশ, ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সর্বত্র...

চারিদিকে ছিল শুধু লাশের স্তুপ

ওদিকে বুড়িগঙ্গার তীরে তখনো হত্যার মহোৎসব চলছেই। বাচ্চারা যেমন খেলার ছলে টিপে টিপে পিঁপড়া মারে, ঠিক তেমনি পাকিস্তানি শুয়োরগুলো যাকে ইচ্ছে গুলি করছে, যাকে ইচ্ছে বেয়নেট দিয়ে ফালাফালা করছে। মাথার উপর হেলিকপ্টার রোটোর ব্লেডের কট কট শব্দ করে উড়ছে, অবিরাম গুলিবর্ষন হচ্ছে সেখান থেকেও, মাঝে মাঝেই ফ্লেইমথ্রোয়ার থেকে তীব্র আগুনের হলকা এসে নীচে বিস্তৃত প্রান্তরে প্রানটা হাতে ছুটতে থাকা অসংখ্য নিরপরাধ মানুষকে পুড়িয়ে দিচ্ছে, দিকবিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে থাকা মানুষটা পুড়তে পুড়তেই ছুটছে, একসময় ছুটতে ছুটতে নিস্তেজ হয়ে কয়লা হয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে, রক্ত-মাংসের কুচকুচে কালো কয়লা... কখন যেন কান্না থেমে গেছে নাফিজার, দাঁড়িয়ে আছে স্তব্ধ হয়ে, দেখছে রক্তের হোলিখেলা... চোখে অবাক অবিশ্বাসের দৃষ্টি... দুঃস্বপ্নও কি এতোটা ভয়াবহ হয়? হতে পারে?

আনাস রহমান নামে একজন তার জবানীতে শোনা সেইদিনের ইতিহাস বর্ণনা করেন এভাবে-

 পঁচিশে মার্চ ঢাকায় মিলিটারী আক্রমনের পর আমার বাবা আমাদের সবাইকে নিয়ে মিরপুর থেকে কেরানীগঞ্জ বামনসুর চলে যান, তখন আমার বয়স ছিল আট, তোমার বড় খালার বয়স ছিল পাঁচ, মেঝ জনের ছিল তিন অথবা সাড়ে তিন, আর ছোট খালা মাত্র হয়েছে। বামনসুর অবস্থাকালে শুনলাম এখানেও মিলিটারীরা আসবে, জেনে আমরা তখন আমার নানা বাড়ী ভাওয়াল এ চলে গেলাম। 
কিছুদিন অবস্থানের পর শুনলাম এখানেও আসবে মিলিটারীরা, আগেরদিন রাতে সারারাত আতঙ্কে ছিলাম, ভোরের দিকে আমার মামা, চাচা, যাকে যে পেল হাত ধরে চলে গেল, আব্বা তোমার ছোট দু খালা কে নিয়ে চলে যান, আমি আমার ছোট মামা আর আরো কিছু আত্মী স্বজনেরা রওনা করি, প্রায় বিশ পচিশ মাইল হাটি, কোন বাহন ছিল না, আমরা কলাতিয়া পার হয়ে আরো ভিতরে এক গ্রামে যাই। তখন আম্মার অনেক জ্বর ছিল, আব্বা ভেবেছিলেন যে আরো ভোর হলে ছোট চাচা বাকীদের নিয়ে সরে আসবে, কিন্তু আম্মার শরীর অনেক খারাপ থাকায় তাকে, তোমার ছোট খালা আর আমার ফুপু নানীকে রেখে চাচা চলে যান।
এরই মধ্যে মিলিটারীরা এসে যাকে পাচ্ছিল লাইন করে দাঁড় করিয়ে মেরে ফেলছিল, ওই গ্রাম থেকে অনেকে যুদ্ধে গিয়েছিল এ তথ্য তাদের কাছে ছিল, তাই তাদের আক্রোশও বেশী ছিল। এদিকে আমার নানা বাড়ীতে এসে মিলিটারীরা সাম্নের কিছু ঘর খালি দেখে পরিত্যাক্ত বাড়ী মনে করে আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা করছিল, আমার ফুপু নানী আমাদের বলেছিলেন যে  “আমি দেখছি যে মিলিটারীরা পাউডার ছিটাচ্ছে, কিন্তু ভয়ে বের হতে পারছিনা কারন বের হলেই তো মেরে ফেলবে। তারা আগুন জ্বালানোর পুর্বে আরেকবার ঢুকে যতটা পাড়ল লুট করে আগুন ধরিয়ে দিল, এদিকে তোমার মা আমাকে ডেকে বলছে যে এত গরম কেন লাগছে, আমাকে বাইরে নিয়ে যাও, মিলিটারীরা তখন ছিল যে কেউ বের হয়ে আসে কিনা”।
আমাদের বাড়ীটা চারদিকে টিন উপরে কাঠ, তার উপর আবার আমরা লাকড়ি আর কেরসিন রাখতাম, কিচ্ছুক্ষনের মধ্যে আগুনের মাত্রা বাড়লে মিলিটারীরা চলে যায় কেউ নেই ভেবে, এই সুযোগে আমার ফুপু নানী মা আর তোমার ছোট খালাকে নিয়ে পাশের চাচাদের ঘরে গিয়ে আশ্রয় নেন।
ওই ঘরের জানালা দরজা পুড়লেও ভিতরে কিছু হয়নি, আমার ফুপু নানী বলেন যে আর কিছুক্ষন আগের ঘরে থাকলে আমরা কয়লা হয়ে যেতাম। এদিকে ছোট চাচাকে দেখে তো আমরা কান্নাকাটি জুড়ে দেই, ভেবেছিলাম মা মারা গিয়েছেন, সেই সাথে আমার ছোট বোন। রাতের দিকে বাবা আবার গ্রামে যান, যেয়ে তাদেরকে পেয়ে নিয়ে আসেন।
পচে যাওয়া লাশ খুটে খাচ্ছে কাক-শকুনেরা...

সেদিনের সেই নির্বিচার গণহত্যা নিয়ে বলতে গিয়ে এক পাকিস্তানী সেনা স্বীকারোক্তি দিয়েছিল এভাবেঃ

“...we were told to kill hindus and kafirs (non-believers in God). One day in June, we cordoned a village and were ordered to kill the kafirs in that area. We found all the women reciting from the Holy Quran and the men holding special congregational prayers seeking God’s mercy. But they were unlucky. Our commanding officer ordered us not to waste any time”.( comfession of a Pakistani Soilder)।

জিঞ্জিরা গণহত্যার পরের দিন, অর্থাৎ ৩ এপ্রিল ১৯৭১ পাকিস্তানী প্রচারযন্ত্র জিঞ্জিরা গণহত্যাকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য এবং দেশের অন্যান্য মানুষ ও বহির্বিশ্বকে বিভ্রান্ত করার জন্য হত্যার সপক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করে মিথ্যা খবর প্রচার করে। ৩ এপ্রিল তৎকালীন পাকিস্তান সরকার সমর্থিত পত্রিকা মর্নিং নিউজের একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল এরকম,

”Action against miscreants at Jinjira” অর্থাৎ ‘‘জিঞ্জিরায় দুস্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন”।

আর তৎকালীন পিটিভি (পাকিস্তান টেলিভিশন) ঐ দিন ২ এপ্রিল রাতে খবর প্রচার করে,

”‘বুড়িগঙ্গা নদীর অপর পাড়ে কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরায় আশ্রয় গ্রহণকারী বিচ্ছিন্নতাবাদী দুস্কৃতিকারীদের কঠোর হাতে নির্মূল করা হয়েছে’“।

আম্মা জাহানারা ইমাম একাত্তরের দিনগুলিতে পাওয়া সেইদিনের বিবরণে যা দেখা যায়, সেটা হচ্ছে-

২৫শে মার্চের কালরাতের সেই গণহত্যার পর সবচেয়ে বড় এই ম্যাসাকার হয়েছিল ঠিক তার পরের শুক্রবার, ২রা এপ্রিল, প্রকাশ্য দিবালোকে। অথচ এইদিন নির্বিচারে নিহত হওয়া হাজার হাজার মানুষ যেন স্রেফ বেমালুম গায়েব হয়ে গেছে। তাদের নিয়ে তেমন কেউ লেখেনি, প্রত্যক্ষদর্শীদের ভেতর কেবল কবি নির্মলেন্দু গুণ  একটা বই লিখে সেইদিনের বীভৎস স্মৃতি সংরক্ষণ করে রাখতে সচেষ্ট হয়েছেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য।

তার "জিঞ্জিরা জেনোসাইড ১৯৭১" বইটি সেইদিনের নির্বিচার গণহত্যার অন্যতম প্রামাণ্য দলিল হয়ে আছে। তাছাড়া যেন পুরো পৃথিবিই ভুলে গেছে জিঞ্জিরা গণহত্যার রক্তাক্ত ইতিহাস। আজ বুড়িগঙ্গার ওপারে জিঞ্জিরায় গিয়ে গণহত্যার ছোট্ট একটা স্মৃতিস্তম্ভ ছাড়া তেমন আর কোন স্মৃতিচিহ্ন খুঁজে পাওয়া যাবে না। একাত্তরের ২রা এপ্রিল এখানে কি ঘটেছিল, সেটা সম্পর্কে তেমন কারো আগ্রহ নেই, সেদিনের ইতিহাস বলার মতও তেমন কাউকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। জিঞ্জিরা গণহত্যা তাই একাত্তরের আরেক ফরগটেন জেনোসাইড হয়েই হারিয়ে যেতে থাকে, চুপচাপ... নিঃশব্দে! 

তথ্যসুত্র ও প্রয়োজনীয় দলিল: 

  • আত্মকথা ১৯৭১, নির্মলেন্দু গুণ, বাংলা প্রকাশ,
  • স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র, অষ্টম খন্ড (পৃ৩৭৬-৩৭৮) দৈনিক বাংলা, ১৩ নভেম্বর
  • ১৯৭২ একাত্তরের দিনগুলি, জাহানারা ইমাম, সন্ধানী প্রকাশনী, ২০০৫(পৃ ৫৬)

জিঞ্জিরা জেনোসাইড নিয়ে চমৎকার তথ্য উপাত্তসমৃদ্ধ লেখা- অপারেশন জিঞ্জিরা ১৯৭১ এবং বদরুদ্দীন ওমরের বাতাস খাওয়া   

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা