রোটেশন পলিসি, খেলোয়াড়দের মনোবল ফেরানো, ট্যাকটিকসে পরিবর্তন আনা- গত মৌসুমের ভঙ্গুর রিয়াল যেন বদলে গেল রাতারাতি! জিদান তো এমনই, যিনি রেকর্ড তৈরী করেন, নিজের হাতে লেখেন ইতিহাসের নতুন পংক্তিমালা...
সার্জিও র্যামোস আবেগ চেপে রাখতে পারছিলেন না। ধরা গলাতেই স্প্যানিশে বললেন, জিজু হচ্ছে মিডাসের মতো, ও যা ধরে, তাই সোনা হয়ে যায়! ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ আবার মানুষ হিসেবে বেশ কাঠখোট্টা, আবেগ চেপে রাখেন, তিনিও জিদানের প্রশংসা করতে গিয়ে খুলে দিলেন হৃদয়ের আগল। জিদান যা করেছেন, ভাঙাচোরা দল নিয়ে যেভাবে লিগ জিতে ফেলেছেন এক ম্যাচ হাতে রেখেই- তাতে অবশ্য সব প্রশংসাই কম পড়ে যায় তার জন্য!
তিনি বিদায় নিয়েছিলেন দলকে সবকিছু জিতিয়ে। টানা তিনবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতার রেকর্ড গড়েছিল রিয়াল, তার অধীনে। লিগ জিতেছেন, ক্লাব ওয়ার্ল্ডকাপ জিতেছেন, অনেকদিন পর ইউরোপিয়ান ফুটবলে একটানা ডমিনেট করেছে রিয়াল মাদ্রিদ। খেলোয়াড় আর কোচ- দুই ভূমিকায় চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ীদের বিরল তালিকায় নিজের নামটাও লিখে ফেলেছিলেন জিদান। রিয়াল থেকে তার আর কিছু জেতার ছিল না, সেজন্যেই হয়তো ক্লাব ছেড়েছিলেন। কিন্ত জিদান আর রিয়ালের সম্পর্কটা তো হরিহর আত্মার, ছাড়ি বললেই কি আর ছাড়া যায়?
জিদান যাওয়ার পর থেকেই রিয়ালের দুর্দশার শুরু, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোও ক্লাব ছেড়েছেন একই মৌসুমে, দুই মহীরূহের বিদায়ে রিয়াল যেন ধ্বংস্তুপে পরিণত হলো। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের দ্বিতীয় রাউন্ড থেকেই বিদায় নিলো দলটা, লিগ শিরোপার ধারেকাছেও থাকা হলো না। আগের তিন মৌসুমে যারা রিয়ালকে দেখেছে, তাদের চোখে এই রিয়াল বড্ড অচেনা, সাদা জার্সিটা পরে যেন একদল আগন্তুক খেলছে! চেলসি থেকে হ্যাজার্ডকে উড়িয়ে আনা হলো, গোলবারের নিচে দাঁড়ালেন কর্তোয়া- কিন্ত তাতে প্রাপ্তির খাতা শূন্যই রইলো।
বাধ্য হয়েই আবার জিদানের শরণাপন্ন হলেন ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ! অভিজ্ঞ পেরেজ জানতেন, জিদান ছাড়া এই বিপদ থেকে রিয়ালকে উদ্ধার করার কেউ নেই।মাদ্রিদের প্রতিটা সমর্থকও মনে প্রাণে বিশ্বাস করতো সেটা। সেকারণেই বার্নাব্যুর সামনে 'জিদান প্লিজ কাম ব্যাক হোম' লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়েছে লোকে, খেলা চলাকালীন সময়ে জিদানের নামে চ্যান্ট করেছে সমর্থকেরা। জনতার দাবী মেনেই লোপেতেগুই-সোলারি স্যাক হলেন, জিদান ফিরলেন বার্নাব্যুতে, রিয়ালে তার ক্যারিয়ারের তৃতীয় কিস্তিটা লিখতে!
রিয়ালের গত মৌসুমের পারফরম্যান্সের সঙ্গে এই মৌসুমের পারফরম্যান্সকে মেলালেই জিদান ম্যাজিকের মহিমাটা বুঝে যাবেন যে কেউ। খেলার ধরণে পরিবর্তন এসেছে, তবে সবচেয়ে বেশি বদলটা হয়েছে মানসিকতায়। এক মৌসুম আগে যে ফুটবলাররা ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত অবস্থান নজরে এসেছেন, তারাই যেন গা ঝাড়া দিয়ে উঠলেন হঠাৎ! জিততেই হবে টাইপের একটা ব্যাপার চলে এসেছে সবার মধ্যে। এক কোর্তোয়ার কথাই ধরা যাক, আগের সিজনে নিজেকে হারিয়ে খুঁজছিলেন, মানিয়ে নিতে পারছিলেন না দলের সঙ্গে। এসব নিয়ে সমালোচনার মুখেও পড়েছেন। সেই কর্তোয়া এই মৌসুমে স্প্যানিশ লিগের সেরা গোলরক্ষক, রিয়ালের সাফল্যের অন্যতম কাণ্ডারী!
জিদানের প্লেয়ার রোটেশন পলিসি নিয়ে আগেও বিস্তর গবেষণা হয়েছে। দলের চাহিদা মেনে অভিজ্ঞতা আর তারুণ্যের মিশেলে দল সাজানোটা তার পছন্দ। ফুটবলারেরা যাতে ক্লান্ত হয়ে না যান, সেটা তার মাথায় সারাক্ষণ ঘুরপাক খায়। গত মৌসুমে রিয়াল এই জিনিসটাকে মিস করেছে সবচেয়ে বেশি। টানা খেলায় ক্লান্তি ঘিরে ধরেছিল মার্সেলো, র্যামোস সহ সবাইকেই, বিশেষ করে সিনিয়র যারা ছিলেন। এই মৌসুমে জিদানের রোটেশন পলিসি ফিরেছে, অমনি বিরতি পেয়ে ফুটবলারেরা হয়ে উঠেছেন চনমনে, নিজেদের সেরাটা ঢেলে দিয়েছেন মাঠে।
রিয়ালের বড় দুর্বলতা ছিল হোম গ্রাউন্ডে পয়েন্ট হারানো। অথচ এই মৌসুমে বার্নাব্যুতে কোন ম্যাচই হারেনি দলটা! করোনা পরবর্তী সময়ে টানা দশ ম্যাচ জিতেছে রিয়াল, অথচ আগে শেষ মুহূর্তে পা ফসকানোটাকে অভ্যাস বানিয়ে ফেলেছিল তারা। জিদান ম্যাচ বাই ম্যাচ এগিয়েছেন, প্রতিটা ম্যাচকে সমান গুরুত্ব দিয়েছেন, পূর্ণ তিন পয়েন্ট আদায় করে তারপরই সন্তুষ্টির শ্বাস ছেড়েছেন। আর পচা শামুকে পা কেটে রিয়ালকে বাড়তি এডভান্টেজ দেয়ার জন্য বার্সেলোনা তো ছিলই!
জিদানের আগের চ্যাপ্টারের যতো সাফল্য, তাতে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর একটা বড় ভূমিকা ছিল, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান বললেও ভুল হবে না। এই মৌসুমে জিদানের হাতে রোনালদো ছিলেন না, ম্যাচে পার্থক্য গড়ে দেয়ার মতো কেউই ছিলেন না, জিদান কাউকে রোনালদো বানানোর চেষ্টাও করেননি। বেনজেমাকে সামনে রেখে গোটা দলকে তিনি ব্যবহার করেছেন। বেনজেমা দলের সর্বোচ্চ স্কোরার, সবচেয়ে বেশি অ্যাসিস্টও তার, কিন্ত জেনে অবাক হবেন, লিগে এই সিজনে রিয়ালের হয়ে গোল করেছে মোট একুশ জন ফুটবলার! এটাই টোটাল ফুটবলের জিদানীয় ভার্সন!
গত মৌসুমে ৪৬টা গোল হজম করা দলটা এই মৌসুমে কনসিভ করেছে এর অর্ধেক গোল, কর্তোয়া ক্লিনশিট ধরে রেখেছেন ১৮টা ম্যাচে! বুড়ো হয়ে যাওয়া মড্রিচকে ব্যবহার করেছেন সুযোগ বুঝে, পরিশ্রম না করিয়েই তাকে দিয়ে ছোট ছোট পাসে আক্রমণ বিল্ডাপ করিয়েছেন। র্যামোস ডিফেন্স সামলানোর পাশাপাশি উপরে উঠে আক্রমণও শাণিয়েছেন, দশটা গোলও করেছেন। কর্তোয়া, ক্যাসেমিরো এবং রামোসও বোধহয় লীগে ক্যারিয়ারের সেরা খেলাটা খেলছে এবার। অসাধারণ পারফর্ম করেছেন তরুণ মেন্ডি। ছোট ছোট এই ব্যাপারগুলোই এই মৌসুমে রিয়ালের সাফল্যের নেপথ্য কারণ, শিল্পী হয়ে সবগুলো ফুলকে যিনি এক মালায় গেঁথেছেন, তার নাম জিদান!
চ্যাম্পিয়ন্স লিগে টিকে থাকার আশাটা এখনও বেঁচে আছে, যদিও করতে হবে অসম্ভবকে সম্ভব। সেই কাজটা জিদানের চেয়ে ভালো আর কে পারেন বলুন? জিদান রেকর্ড তৈরী করেন, নিজের হাতে লেখেন ইতিহাসের পংক্তিমালা। প্রত্যাবর্তনের গল্পটাও জিদান নিজেই লিখছেন, শেষ পৃষ্ঠায় কি ঘটবে, সেটাও হয়তো জিদানই ঠিক করবেন, অন্য কেউ নয়।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন