রিয়াদের লোকজন অবাক হয়ে দেখেছে, শার্ট-জিন্স আর হাইহিল পরে খোলা চুলে গাড়ি থেকে নামছেন এক সৌদি তরুণী, কেনাকাটা করছেন, ঘুরে বেড়াচ্ছেন, শপিং মলে যাচ্ছেন! আবায়া না পরে চলাফেরা করার কারণে কম সমস্যায় পরতে হয়নি মাশায়েল আল-জালুদকে...

মাশায়েল আল-জালুদের বয়স ৩৩ বছর। সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদের একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে মানবসম্পদ উন্নয়ন কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন তিনি। গত এক-দেড় বছর ধরেই তিনি নিজের দেশে আলোচিত চরিত্রগুলোর একটি। কারণ সৌদি নারীদের প্রচলিত পোষাক আবায়া না পরে নিয়মিত বাইরে বের হচ্ছেন জালুদ। কালো বোরখার মতো যে আলখেল্লাটা সৌদি নারীদের পরা বাধ্যতামূলক, সেটাকেই আবায়া নামে ডাকা হয়। পুরুষেরা তো বটেই, রাস্তায় বের হলে নারীরাও অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন তার দিকে, যেন এলিয়েন দেখছেন চোখের সামনে! আবায়া পরে বের না হবার কারণে অনেক অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতেও পড়তে হয়েছে জালুদকে। তবে নিজের ব্যক্তিস্বাধীনতার সঙ্গে আপোষ করেননি তিনি কখনও। 

আবায়া কী?

পুরো শরীর ঢাকা বোরখার মতো পোশাকের নাম আবায়া৷ এর রং সাধারণত কালো হয়ে থাকে৷ সৌদি আরবে নারীদের এই পোশাক পরা বাধ্যতামূলক, এই পোষাক ছাড়া কেউই বাইরে বের হন না দেশটিতে। একটা সময় তো বাইরে বের হওয়া সৌদি নারীরা এই পোশাক পরছেন কিনা তা দেখাশোনার জন্য ধর্মীয় পুলিশ ছিল৷ তবে এখন আর তারা নেই৷ তবে কড়াকড়ি আছে ঠিকই। আবায়া ছাড়া কেউ বাইরে বের হলে ধর্মীয় কট্টরপন্থীদের ক্ষোভের মুখে পড়তে হয়, একারণে ইচ্ছে থাকলেও অনেকে এই আলখেল্লা গায়ে না জড়িয়ে বাইরে যাওয়ার সাহস পান না। 

বোরখার মতো এই পোষাকের নাম আবায়া

মাশায়েল আল-জালুদের প্রতিবাদ

২০১৯ সালের শুরুর দিকের ঘটনা, মাশায়েল আল-জালুদ ঠিক করলেন, তিনি আবায়া পরে বাইরে বের হবেন না। এমনিতেই খুব কম সংখ্যক নারীই স্বেচ্ছায় আবায়া পরেন, বরং সমাজের ভয়ে, কটুকথা শোনার আতঙ্কে তারা এটা পরতে বাধ্য হন। তবে জালুদকে সাহস দিয়েছিল সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের একটি বক্তব্য। ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সৌদি আরবকে রক্ষণশীল থেকে মডারেট মুসলিম দেশে পরিবর্তন করতে চাইছেন সালমান, তার আমলেই সৌদি নারীরা ড্রাইভিং লাইসেন্স পেয়েছে, স্টেডিয়ামে গিয়ে খেলা দেখার অনুমতি পেয়েছে, সিনেমা হল চালু হয়েছে সেদেশে। 

প্রিন্স সালমান সিএনবিসি চ্যানেলকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, "ইসলাম ধর্মে আবায়া নামের এই পোশাক বাধ্যতামূলক করা হয়নি৷ মেয়েরা ‘শোভন ও সম্মানজনক পোশাক’ পরবে বলে আশা করা হয়৷ এবং সেটা যে আবায়া হতে হবে এমন কোন কথা নেই। শালীন পোষাক অনেক রকমের হতে পারে৷" ক্রাউন প্রিন্সের সেই কথাটাকে আমলে নিয়েই কয়েকদিন বাদে আবায়া পরে বাইরে বেরিয়ে এসেছিলেন জালুদ। রিয়াদের লোকজন অবাক হয়ে দেখেছে, শার্ট-জিন্স আর হাইহিল পরে খোলা চুলে গাড়ি থেকে নামছেন এক সৌদি তরুণী, কেনাকাটা করছেন, ঘুরে বেড়াচ্ছেন, শপিং মলে যাচ্ছেন! এমন বাস্তবতার সঙ্গে দেড় বছর আগেও পরিচিত ছিল না সৌদি আরবের মানুষ! 

বিব্রতকর যত অভিজ্ঞতা

জালুদ জানতেন, তার এই পদক্ষেপটা সাধারণ মানুষ ভালোভাবে নেবে না। তবে তাতে থোড়াই কেয়ার করেছে তিনি। প্রস্তুত থেকেছেন যেকোন বাজে মন্তব্য বা অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে পড়ার জন্য। সেরকম ঘটনা ঘটেছেও। আবায়া পরিহিত না থাকায় একবার এক শপিং মলে তাকে ঢুকতে দেয়া হয়নি। সিকিউরিটি গার্ডের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ তর্ক করেও তাকে নিজের অবস্থান বোঝাতে পারেননি জালুদ। শেষে ক্রাউন প্রিন্সের সেই সাক্ষাৎকারও তাদের দেখিয়েছেন, তবু মন গলেনি সিকিউরিটি গার্ডদের। 

রাস্তায় বের হলে জালুদের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে সবাই

সেই ঘটনার ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তখনও সাইবার বুলিংয়ের শিকার হতে হয়েছে জালুদকে। সৌদি রাজপরিবারের এক সদস্য তো সেই ভিডিও শেয়ার দিয়ে বলেছিলেন, সৌদি মূল্যবোধকে আঘাত দেয়ার কারণে জালুদের নাকি মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত! জালুদ পাশে পাননি সেই শপিং মল কর্তৃপক্ষকেও। তারা বরং বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছিল, ‘নৈতিকতা ভঙ্গকারীদের’ তারা ঢুকতে দেবে না! এখনও যখন জালুদ আবায়া ছাড়া রাস্তা দিয়ে হেঁটে যান, কটু মন্তব্য ভেসে আসে তার কানে। আশেপাশের মানুষজন তাকে নিয়ে কানাঘুষা করে৷ কেউ কেউ তাকে এসে জিজ্ঞেস করে, তিনি কোনো তারকা, কিংবা মডেল কিনা৷

জালুদ কি বলছেন?

আবায়া না পরে সৌদি আরবের মতো রক্ষণশীল মুসলিম দেশে চলাফেরা করাটা একজন নারীর জন্য যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। জালুদ সেটা এক বছরের বেশি সময় ধরে করে আসছেন। আজেবাজে অনেক পরিস্থিতিই তিনি মোকাবেলা করেছেন, এখনও করছেন। পুরো সময়টাতে কেমন হুমকি-ধামকি বা বাজে অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেছেন তিনি? জালুদ বলেছেন- 

"সৌদি আরবে পোশাক নিয়ে কোনো স্পষ্ট আইন নেই। আমি হয়তো ঝুঁকিতে আছি। ধর্মীয় কট্টরপন্থিরা আমাকে হুমকি দিচ্ছে কারণ আমি আবায়া পরছি না। কিন্তু এটি কোনো ধর্মীয় বিষয় নয়। কারণ এটা যদি ধর্মের বিষয়ই হতো, তাহলে সৌদি নারীরা দেশের বাইরে গেলে আবায়া ছুড়ে ফেলতো না। যারা এখানে আবায়ার নিচে চাপা পড়ে থাকে, তারাই কিন্ত ইউরোপ-আমেরিকায় গেলে অন্যরকম পোষাক পরে।" 

এখনও অনেকটা পথ চলা বাকী

মাশায়েল আল-জালুদ শপিং মলে গেলে বা বাইরে বের হলে আবায়া ছাড়াই যান। কিন্ত অফিসে তাকে আবায়া পরেই যেতে হয়। অফিস কর্তৃপক্ষ তাকে জানিয়ে দিয়েছে, তার ব্যক্তিগত মতামতকে তারা সম্মান করে, কিন্ত জালুদের কারনে কোম্পানী বা অন্য কর্মচারীদের কোন সমস্যা হোক, কোন বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হোক, এটা তারা চায় না। তাই তারা জালুদকে অনুরোধ করেছে, তিনি যাতে অফিসে আবায়া পরে আসেন।জালুদ তাদের অনুরোধ রেখেছেন, তিনি জানেন, পরিবর্তন হুট করে একদিনে আসবে না, সময় লাগবে। দীর্ঘ এই লড়াইটা তিনি চালিয়ে যেতে চান, পর্দাপ্রথার নামে দাসত্বের যে বেড়াজালে সৌদি নারীদের আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে, সেটা থেকে প্রত্যেক নারীকে তিনি মুক্তি দিতে চান। 

জালুদের আরেক সঙ্গী

মানাহেল আল-ওতাইবি, অনলাইন এক্টিভিস্ট। রিয়াদে বসবাস, বয়স ২৫। গত পাঁচ মাস ধরে তিনি আবায়া ছাড়াই বাইরে বের হচ্ছেন। টিশার্ট আর জিন্স পরিহিত ওতাইবিকে দেখেও ভ্রু কুঁচকে ফেলছেন সৌদি পুরুষেরা, আবায়ার ফাঁক গলে ওতাইবিকে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন নারীরাও। জালুদকে দেখেই অনুপ্রেরণা নিয়েছেন ওতাইবি, পোষাকের স্বাধীনতা নিয়ে তার মনোভাবও জালুদের মতোই- "আমার যেভাবে খুশি সেভাবেই আমি জীবনযাপন করতে চাই৷ আমি যা পরতে চাই না, সেটা পরতে আমাকে বাধ্য করা উচিত নয়। এটা কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না।" 

মানাহেল আল ওতাইবি, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট

জালুদ-ওতাইবিদের হাত ধরেই বদলাবে সৌদি আরব?

এই প্রশ্নের সরাসরি কোন উত্তর দেয়াটা খুব কঠিণ। সৌদি আরবের রক্ষণশীল সংস্কৃতিটার বয়স হাজার বছরেরও বেশি। সৌদি পুরুষদের মানসিকতায় নারীকে দমিয়ে রাখার ব্যাপারটা যেমন আছে, তেমনই আছে ধর্মীয় কিছু জটিল সমীকরণও। তবে খুব ধীরে ধীরে হলেও একটা বদল যে আসছে, সেটা লক্ষ্য করার মতো। আবায়া ছাড়া বাইরে বের হবার সাহস না করলেও, সৌদি নারীদের অনেকেই রঙ বেরঙের আবায়া পরছেন ইদানিং, গোলাপি, হলুদ, বেগুনি- এসব রঙের আবায়া দেড়-দুই বছর আগেও কেউ দেখবে বলে কল্পনা করতে পারতো না। অনেকেই আবার আবায়া ছেড়ে লম্বা গাউন পরে বাইরে যাচ্ছেন। 

অদূর ভবিষ্যতে না হলেও, একসময় সৌদিতে এমন দিন নিশ্চয়ই আসবে, যখন আবায়া ছাড়া নারীরা বাইরে গেলে কেউ ভ্রু কুঁচকে তাকাবে না, কেউ ফতোয়া ঝাড়বে না। যার ইচ্ছে সে আবায়া পরবে, যার ইচ্ছে সে পরবে না। এখানে ভয় না জোর-জবরদস্তির কোন ব্যাপার থাকবে না। জালুদ-ওতাইবিরা সেই দিনের অপেক্ষাতেই লড়ে যাচ্ছেন নিজ নিজ জায়গা থেকে...

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা