জাফর মুন্সীকে সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোর পরে আর কেউ মনে রাখেনি। সবাই ভুলে গেছে যে, গণজাগরণের সেই উত্তাল দিনগুলোতে সর্বপ্রথম যে মানুষটা নিজের রক্ত ঢেলে রাজপথ রঞ্জিত করেছিলেন, তার নাম জাফর মুন্সী।

জাফর মুন্সীকে কেউ শহীদ খেতাব দেয়নি। নতুন প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধা বলেও আখ্যায়িত করা হয়নি তাকে। জাফর মুন্সীর কথা হয়তো কেউ মনেই রাখেনি, এরকম ছাপোষা একটা মানুষের কথা মনে রাখার দায় পড়েছে কার? জাফর মুন্সি কে ছিলেন যে তাকে মনে রাখতে হবে? তিনি তো ফেসবুক সেলিব্রেটি ছিলেন না, মোটিভেশনাল স্পিকার ছিলেন না, শেয়ার বাজার বা ব্যাংকের টাকা লুটে খাওয়া কোনো রাঘব বোয়ালও ছিলেন না, তাকে কে স্মরণ করবে? কেন স্মরণ করবে বলুন? আমাদের এই প্রজন্মটা যে এই মানুষটার কাছে ঋণী, সেটা আমরা জানিও না।

যুদ্ধাপরাধের বিচার হয়েছে এই দেশে, সেই বিচারের পেছনের গল্পগুলোতে জাফর মুন্সী হয়তো গুরুত্বপূর্ণ কোনো চরিত্র হিসেবে ঠাঁই পাবেন না ইতিহাসের পাতায়, কিন্ত দ্রোহের যে আগুন বুকে জ্বেলে তিনি মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছিলেন অসম সাহসীকতার সঙ্গে, সেটাকে কি চাইলেই ভুলে যাওয়া সম্ভব? চলুন, আজ আপনাদের জাফর মুন্সী নামের একটা সাদাসিধে মানুষের গল্প শোনাই।

তার গ্রামের বাড়ি ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলার ঘারুয়া ইউনিয়নের গঙ্গাধরদী। জাফর মুন্সী প্রায় ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে মতিঝিলে অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে লিফটম্যান হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পরিবারকে ঢাকায় এনে রাখার মতো সামর্থ্য ছিল না, তাই কমলাপুরের একটা মেসে একাই থাকতেন তিনি। ২০১৩ সালের কথা বলছি, জাফর মুন্সীর বয়স তখন ছিল ৪৫।

ফেব্রুয়ারীর পাঁচ তারিখে যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার মামলার রায় হলো। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা পেয়ে হাসতে হাসতে আদালত প্রাঙ্গন থেকে বেরিয়ে ভি সাইন দেখালো হায়েনাটা। মাথায় রক্ত উঠে গেল তারছেঁড়া কিছু তরুণের, তারা জড় হলেন শাহবাগে, তৈরি হলো প্রজন্ম চত্বর। বাকীটা ইতিহাস। স্বাধীন বাংলাদেশ সম্ভবত তার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গণজমায়েতটা দেখে ফেললো সেই ক'টা দিনেই। 

গণজাগরণ মঞ্চ, ২০১৩

ব্লগ কী জিনিস, সেটা জাফর মুন্সী জানতেন না। ফেসবুকে কোনো একাউন্টও ছিল না তার। তিনি শুধু জানতেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রাণের দাবী নিয়ে লাখো মানুষ জড়ো হচ্ছে শাহবাগে। শরীরটা অফিসে থাকলেও, জাফর মুন্সীর মনটা পড়ে থাকত প্রজন্ম চত্বরে। হাজারো তরুণের সাথে যেন তিনিও গলা মেলাতেন, 'ক-তে কাদের মোল্লা, তুই রাজাকার তুই রাজাকার!' 

এরপরে এলো ফেব্রুয়ারীর তেরো তারিখ। আর দশটা দিনের মতোই অফিসে এসে কাজ শুরু করেছিলেন জাফর মুন্সী। অগ্রণী ব্যাংকের কর্মচারীরা তখন ভবনের সামনে একটা ব্যানার লাগাচ্ছিলেন, যেখানে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবী লেখা ছিল। তখনই সেখানে অতর্কিত হামলা চালায় শিবিরের কর্মীরা। গত কয়েকদিনের ঘটনাপ্রবাহে ক্ষ্যাপা কুকুরের মতো হয়ে ছিল তারা। সেই আক্রোশ থেকেই চোখের সামনে কাউকে যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবী তুলতে দেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ওরা হায়েনার মতো।

গাড়ি ভাংচুরের সময় অগ্রণী ব্যাংকের সিবিএ'র নেতাকর্মীরাও পালটা ধাওয়া দিলেন শিবির কর্মীদের, কয়েকজনকে আটকও করেছিলেন তারা। সিবিএ নেতা জাফর মুন্সী শিবির কর্মীদের ধাওয়া দিতে গিয়ে একটু বেশিই এগিয়ে গিয়েছিলেন, হায়েনার দল সেখানে ঘিরে ফেলে তাকে, তারপর এলোপাথাড়ি আঘাত করে তাকে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, সেখান থেকে নেয়া হয় গ্রীন লাইফ মেডিকেলে। পরদিন ১৪ই ফেব্রুয়ারী, ভালোবাসা দিবসের দিনে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে অন্যভূবনে পাড়ি জমান জাফর মুন্সী। 

জাফর মুন্সী

না, জাফর মুন্সীকে সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোর পরে আর কেউ মনে রাখেনি। সবাই ভুলে গেছে যে, গণজাগরণের সেই উত্তাল দিনগুলোতে সর্বপ্রথম যে মানুষটা নিজের রক্ত ঢেলে রাজপথ রঞ্জিত করেছিলেন, তার নাম জাফর মুন্সী। ব্যাংকের এক ছাপোষা লিফটম্যানের কথা মনে রাখার ঠেকা কার পড়েছে? এরপরে তো আরও কত ব্লগার নিহত হলেন, কারো হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি, বিচার হয়নি জাফর মুন্সীর হত্যাকাণ্ডেরও। ফরিদপুরের ভাঙ্গায় তার বাড়িটাতেই শুধু বছরের এই দিনটাতে কান্নার রোল ওঠে হয়তো। কিংবা কে জানে, তারাও হয়তো মানিয়ে নিয়েছে এতদিনে! জীবন তো মানিয়ে নেয়ারই!

জাফর মুন্সীর মৃত্যুর খবর পেয়ে তার স্ত্রী হাসপাতালে ছুটে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন, বলেছিলেন, ‘এখন আমার কী হবে, সন্তানদের নিয়ে আমি কোথায় দাঁড়াব?’ আমরা জানিনা, জাফর মুন্সীর পরিবার এখন কেমন আছে। যুবরাজ আর জিসান নামের ফুটফুটে দুটো সন্তানের বাবা ছিলেন জাফর মুন্সী, তিনি চলে যাবার পরে ওদের জীবনে কী ঘটেছে আমরা খোঁজও নেইনি। হয়তো কখনও নেবোও না, এটাই হয়তো নিয়তি! জাফর মুন্সীর মতো তার পরিবারও লোকচক্ষুর অন্তরালেই কাটিয়ে দেবে বাকীটা জীবন...


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা