একটা বছর থেকে যা যা খারাপ পাওয়া সম্ভব, সবই পাওয়া গিয়েছে ২০২০ সাল থেকে। করোনাভাইরাস থেকে বৈরুত বিস্ফোরণ বা সবশেষ ক্যালিফোর্নিয়ার আগুন- কি কি ছিলো সে তালিকায়, দেখা যাক তা...

২০২০ সালের মতন এমন অলুক্ষুনে বছর আমাদের জীবদ্দশায় আমরা দেখেছি বলে মনে পড়েনা। একটা বছর যতটা খারাপ, যতটা বাজে, যতটা অপয়া হতে পারে, ২০২০ সাল দেখিয়েছে তার পুরোটাই। যুদ্ধের দামামা, মহামারী, লকডাউন, বিস্ফোরণ, বিতর্ক...সবকিছু মিলিয়ে এরকম ঘটনায় ঠাসা বছর ছিলো কল্পনারই অতীত।

বছরটা শুরুই হয়েছিলো আমেরিকা ও ইরানের মধ্যকার সংঘর্ষ দিয়ে। ড্রোন হামলা করে ইরানী জেনারেল কাশেম সোলাইমানি'কে মেরে ফেলার পর দুই রাষ্ট্রের মধ্যে যে সাসপেন্স আমরা দেখতে পাই, সেটা ছিলো খুবই অন্যরকম এক সাসপেন্স। অবস্থা এতটাই প্রকট ছিলো- তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে কী হবে না, সেটা নিয়েও আলোচনা শুরু হয় জনমানুষের মনে।

এই ঘটনার কয়দিন পরেই সর্বপ্রথম করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব সম্পর্কে টের পায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। চীনের উহান প্রদেশের দিকে নজর পড়ে পুরো পৃথিবীর। আস্তে আস্তে দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়তে থাকে এই মহামারী। পৃথিবীর মানুষ 'সেল্ফ আইসোলেশন' 'হোম কোয়ারেন্টাইন' 'লকডাউন' শব্দগুলোর সাথে পরিচিত হতে শুরু করে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আস্তে আস্তে বন্ধ করে দেয়া হয় বাইরের সাথে সব যোগাযোগ, পাবলিক দোকানপাট, অফিস-আদালত। মানুষ মারা যেতে থাকে খোলামকুচির মতন। সুইজারল্যান্ডে, স্পেনে, আমেরিকায়, ইংল্যান্ডে মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমশই বাড়তে থাকে।

এ বছরের অনেকটা জুড়েই মহামারী। বলতে গেলে '২০২০' নামক সিনেমার প্রধান চরিত্র সে। তাই তাকে নিয়ে কথাবার্তা পরেও বলবো। আপাতত পার্শ্বচরিত্রদের নিয়ে কথা বলা যাক।

এ বছরের শুরুতেই ইউক্রেনের একটি বিমান বিধ্বস্ত হয় তেহরানের মাটিতে। বিমানের ১৭৬ জন প্যাসেঞ্জার সবাই মারা যান। আবার বছরের শুরুর দিকেই ব্রিটেন, ব্রেক্সিট থেকে বের হয়ে আসে। তিন বছর ধরে টানা দড়ি টানাটানির পর অবশেষে তারা বিচ্ছিন্ন হতে সক্ষম হয় ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে।

এরইমধ্যে করোনা বেশ ভালোভাবেই ঘাঁটি গেড়েছে পৃথিবীতে। মার্চ নাগাদ উপমহাদেশের দিকে চলে আসে মহামারী। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের প্রায় পুরোটাই লকডাউন করে দেয়া হয়। মানুষজন গৃহবন্দী হয়ে শাপশাপান্ত করতে থাকে সবকিছুকে, মহামারীকে। টানা তিন/চার মাসের পর লকডাউন এখন নেই একটুও, সামাজিক দূরত্বের বাধানিষেধ হয়েছে অনেকটাই শিথিল,  তবুও জগদ্দল পাথরের মতন চেপে বসা মহামারী এখনো যায় নি কোথাও থেকেই পুরোপুরি।

এরই মাঝখানে 'Black Live Matters' স্লোগানে আলোড়িত হয়েছে আমেরিকা। কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর 'রেসিজম' নিয়ে আলোচনা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। কোভিড-১৯ এর কারণে এমনিতেই আমেরিকার অবস্থা ভালো নেই। শেয়ারবাজারে মন্দা, বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মী ছাঁটাই আর ব্যবসায় স্থবিরতার পাশাপাশি জমে উঠেছে রাজনীতির বাজারও। জর্জ ফ্লয়েডের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই কী না জানা নেই, আমেরিকার ইতিহাসে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়েছেন ভারতীয় বংশোদ্ভুত কমলা হ্যারিস। ট্রাম্প, জো বাইডেনের কাদা ছোঁড়াছুড়ি চলছেই। ট্রাম্পের কথা বলতেই মনে এলো, উত্তর কোরিয়ার কিম জং উনের সাথে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় ও নিউক্লিয়ার বোমার ভয় দেখানো, ইরানকে ড্রোন হামলা করে তাতিয়ে দেয়া ও অভিশংসনের হুমকির মুখেও খালাস পেয়ে যাওয়া... মি. ট্রাম্প নিজে আছেন বেশ উত্থানপতনের মধ্যেই। আবার এরইমধ্যে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্যেও নাকি মনোনয়ন দেয়া হয়েছে তাকে!

ট্রাম্প সারাবছর জুড়েই দেখিয়েছেন বিভিন্ন সব ভেলকি! 

লেবাননের বৈরুতে বোমা বিস্ফোরণে গোটা শহর ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া এবং ক্যালিফোর্নিয়াতে দাবানলে মাইলের পর মাইল উজার হয়েছে। মানুষ, প্রানী, সম্পদ সব পুড়েছে। এদিকে আবার চীন-ভারত সংঘর্ষে মানুষ মারা গিয়েছে। চীনের সাথে দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে বিশ্বের প্রায় অনেকে দেশেরই। শুরু হয়েছে টিকটক সহ চীনের বিভিন্ন পন্য ব্যান করার প্রক্রিয়ায়।

মৃত্যুর মিছিলে সাধারণ মানুষদের পাশাপাশি সেলিব্রেটিরাও বেশ জোরেসোরেই ছিলেন এ বছর। সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যু ও নেপোটিজম নিয়ে ভারতে তো রীতিমতো কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধই বেঁধে গেলো। যেই যুদ্ধ এখনো চলছে। দুই খ্যাতিমান অভিনেতা ইরফান খান ও ঋষি কাপুর প্রয়াত হয়েছেন কিছু দিন আগেই। এনবিএ এর সেলিব্রেটি খেলোয়াড় কোবি ব্রায়ান্ট মারা গেলেন এ বছরেই, বিমান দুর্ঘটনায়। 'ব্ল্যাক প্যানথার'খ্যাত চ্যাডউইক বোসম্যান মারা গেলেন ক্যান্সারের সাথে লড়াই করে।

বাংলাদেশের দিকে যদি তাকাই, মহামারী শুরুর পর একেক সময় একেক সিদ্ধান্ত দিয়েছে কর্তৃপক্ষ, স্বাস্থ্যমন্ত্রী আমাদের হাসিয়েছেন। অদ্ভুতুড়ে সব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। জেকেজির সাবরিনা ও রিজেন্টের সাহেদকে নিয়ে মিডিয়া প্রচুর আলোচনা করেছে এ বছর। মেজর সিনহা'র হত্যাকান্ড এবং ওসি প্রদীপ, শিপ্রা দেবনাথেরাও বেশ ভালো সময় ধরেই ছিলেন আলোচনার টেবিলে। এছাড়াও সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন বেশ ভালো সংখ্যক মানুষ। মসজিদে এসি বিস্ফোরণে ত্রিশেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। ইউনাইটেড হাসপাতালে আগুন লেগে মানুষ মারা গিয়েছে৷ ই-কমার্স সাইট ই-ভ্যালি নিয়ে জলঘোলা হয়েছে বছরের শেষ দিকে এসে। সাংবাদিক কাজলকে বিনা কারণে কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে। বছরের শেষদিকে এসে কুকুর নিয়ে দেশবাসীর ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান বেশ আলোচনার খোরাক যুগিয়েছে। এছাড়া করোনার ত্রান নিয়ে দুর্নীতি, অনিয়ম, অভিযোগ আর নাই বা বললাম। এগুলো তো হয়েই চলছে প্রতিনিয়ত। দেশের উত্তরাঞ্চলে তীব্র বন্যায় নাকাল হয়েছে মানুষজন। মানবেতর জীবনযাপনের চূড়ান্ত করছে তারা।

করোনাভাইরাস ছিলো এ বছরের নাশকতার প্রধান কুশীলব

মহামারী করোনায় প্রতিদিনই একাধিক মানুষকে হারাচ্ছে বাংলাদেশ। তার পাশাপাশি এ বছরে এই দেশ হারিয়েছে বেশ কিছু কৃতী সন্তানকে। মুক্তিযুদ্ধের চার নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার বীরউত্তম চিত্ত রঞ্জন দত্ত প্রয়াত হয়েছেন। প্রয়াত হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের আট নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু ওসমান চৌধুরী। এছাড়াও সঙ্গীতজ্ঞ আলাউদ্দিন আলী, ভাস্কর মৃণাল হকও প্রয়াত হয়েছেন এই অপয়া বছরে।

এই বছরে সবই যে খারাপ হয়েছে তাও না। প্রকৃতি আবার তার ক্ষতস্থানগুলো ঠিকঠাক করে নেওয়া শুরু করেছে। ওজোনস্তর আবার নিজেকে ঠিকঠাক করে নিচ্ছে। প্রকৃতির পূর্বাবস্থায় ফিরে আসার জন্যে এ বছর বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। তাছাড়া 'স্পেস এক্স' দুটি বিমান পাঠিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে। মানুষজন ঘরে থেকে ক্রিয়েটিভ কাজকর্ম করার অন্যরকম এক অখণ্ড অবসর পেয়েছে। কিন্তু সবকিছু মিলিয়ে যদি বলা হয়, বছরের মাত্র নবম মাস চলছে এখন। কিন্তু এরইমধ্যে যে পরিমাণ দুর্ঘটনার মুখোমুখি হয়েছে ২০২০, তাতে নিঃসন্দেহে বলা যায়, নিকট অতীতে এরকম অপয়া বছর আসেনি আর একটিও। এবং আমরা এটাই কায়মনোবাক্যে প্রার্থণা করি, সামনে যেন এরকম কলুষিত সময় আর না আসে।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা