দিনাজপুর তখন অরাজক এক রাজ্য। আইন-শৃঙখলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়েছে পুরোপুরি। জারি হয়েছে ১৪৪ ধারা। পুলিশের বেপরোয়া গুলির সামনে হাজারো মানুষ বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছে। ইয়াসমিনের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ঝড়ে গিয়েছে আরও সাতটি প্রাণ!

আইনের রক্ষক যখন ভক্ষক হয়ে যায়, তখন সেটা সাধারণ মানুষের জন্যে ভয়ঙ্কর হয়ে দাঁড়ায়। মানুষের বিপদে আপদে যারা পাশে দাঁড়াবে, তারাই যখন বিপদের কারণ হয়ে যায়, সেটার চেয়ে খারাপ কিছু আর ঘটতে পারে না। ১৯৯৫ সালে দিনাজপুরের আলোচিত ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডে ঠিক এমনটাই ঘটেছিল। পুলিশের তিন সদস্য ধর্ষণের পরে হত্যা করেছিল ইয়াসমিন নামের এক কিশোরীকে, তারপর সেই ঘটনাকে ধামাচাপা দেয়ার অজস্র চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্ত স্থানীয় মানুষ আর মিডিয়ার ফুঁসে ওঠায় শেষমেশ টলে উঠেছে ক্ষমতাসীনদের দম্ভ, হার মেনেছে প্রশাসন। ইয়াসমীনের জন্যে অকাতরে পুলিশের গুলি বুকে ধারণ করেছিল আরও সাতজন। 

আজ থেকে ঠিক পঁচিশ বছর আগে ঘটেছিল মর্মান্তিক এই ঘটনাটা। ঘড়ির কাঁটায় রাত প্রায় তিনটা, মেয়েটা বসেছিল বাজারের একটা দোকানে। ঢাকা-ঠাকুরগাঁওয়ের বাসটা একটু আগেই তাকে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছে দশমাইল নামের একটা জায়গায়। এখান থেকে ইয়াসমিনের বাড়ি খুব বেশি দূরে নয়, কিন্ত এত রাতে একা বাজার থেকে বাড়ির দিকে যাওয়াটা প্রায় অসম্ভব। বাসের ড্রাইভার আর হেল্পার বেশ ভালো মানুষ, চৌদ্দ বছরের ইয়াসমিন তাদের সাথে অল্প সময়েই খাতির জমিয়ে ফেলেছিল। ইয়াসমিনকে বাস থেকে নামিয়ে স্থানীয় এক দোকানদারের জিম্মায় ওকে রেখে গেছে ড্রাইভার, বলে দিয়েছে, সকাল হলেই যেন বাড়িতে যাওয়ার জন্যে রিক্সা বা বাসে উঠিয়ে দেয়া হয়। 

দশ মাইল মোড়ের পান দোকানদার জাবেদ আলী, ওসমান গণি, রহিমসহ স্থানীয় আরও কয়েকজন সেখানে ছিলেন তখন, তাদের পাশেই বসেছিল ইয়াসমিন, ভাবছিল ফেলে আসা দিনটার কথা। বাবা মারা গেছে কয়েকবছর আগে। ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়ালেখা করতে পেরেছে, সংসারের অভাব-অনটনের কারণে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিতে হয়েছে তারপর। বছর তিনেক আগে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাকে, ধানমন্ডির একটা বাসায় কাজ করার জন্যে। বাসার গৃহকর্তা আর গৃহকর্ত্রী মানুষ খারাপ ছিলেন না, তবে ছুটি মিলতো না একদমই। তিন বছর ধরে বাড়ি আসেনি ইয়াসমিন, মায়ের জন্যে মন ভীষণ কাঁদতো মেয়েটার। 

দূর্গাপূজায় ছুটি পাবার কথা ছিল তার, কিন্ত ইয়াসমিনের তর সইছিল না। জমানো অল্প কিছু টাকা কাপড়ের পুঁটলিতে ভরে রেখেছিল সে। আগস্টের তেইশ তারিখে অন্য দিনগুলোর মতোই ওই পরিবারের ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দিয়েছিল ইয়াসমিন, তারপর আর বাসায় ফিরে আসেনি, খুঁজে খুঁজে চলে গিয়েছিল গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে, সেখান থেকে উঠে পড়েছিল দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁওগামী হাছনা এন্টারপ্রাইজের একটা বাসে। দিনাজপুর থেকে খানিকটা দূরের দশমাইল নামের জায়গাটায় বাস যখন তাকে নামিয়ে দিল, তখন রাত তিনটা বেজে গেছে প্রায়! 

ছবি- ভ্যানে শোয়ানো ইয়াসমিনের মৃতদেহ

আনমনে এসবই ভাবছিল বোধহয় ইয়াসমিন। সময় কাটছে না, আশেপাশেই শোনা যাচ্ছে ব্যাঙ আর ঝিঁঝিঁর ডাক। হুশহাশ করে দূরপাল্লার গাড়িগুলো পেরিয়ে যাচ্ছে দশমাইল বাজার, মানুষজন নেই দু-চারজনের বেশি। খানিক বাদে একটা পুলিশ জীপ এসে থামলো বাজারে, সেটার ভেতরে দুজন পুলিশ সদস্য বসে আছে। এত রাতে একা একটা মেয়েকে দেখতে পেয়ে পরিচয় জানতে চাইলো তাদের একজন, ইয়াসমিনের ঢাকা থেকে আসার কথা শুনে পুলিশরা বললো, তারাও দিনাজপুরের দিকে যাচ্ছে, ইয়াসমিন যেন তাদের সঙ্গে যায়। খানিকটা ইতস্তত করে রাজী হয়ে গেল ইয়াসমিন, বাজারের মানুষগুলোও আপত্তি করার কোন কারণ খুঁজে পেল না। এত রাতে পুলিশের গাড়ির চেয়ে নিরাপদ তো আর কিছু হতে পারে না। ইয়াসমিন জানতো না, যমের হাতে পড়তে যাচ্ছে ও। 

দশমাইল বাজারে সেদিন রাতে যারা ইয়াসমিনকে পুলিশের গাড়িতে উঠতে দেখেছিল, তারা কল্পনাও করতে পারেনি, এই একরত্তি মেয়েটাকে ভয়াবহ আর নৃশংস এক মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে তারা। ইয়াসমিন উঠে গেল পুলিশ ভ্যানে, চলতে শুরু করলো সেটা, একসময় হেডলাইটের আলো হারিয়ে গেল রাত্রির নিকষ কালো অন্ধকারে। ভ্যানে বসে থাকা ইয়াসমিন তখনও জানে না, অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে তার জীবনেও! ভ্যানের মধ্যেই কিশোরী ইয়াসমিনকে ধর্ষনের চেষ্টা করে দুই পুলিশ সদস্য, চলন্ত গাড়ি থেকে লাফ দিয়েছিল ইয়াসমিন, কিন্ত পালিয়ে বাঁচতে পারেনি। নির্জন রাতে ওর চিৎকারও কেউ শুনতে পায়নি। 

ইয়াসমিনকে ধরে গাড়িতে ওঠায় পুলিশের দুই সদস্য এএসআই মইনুল এবং কনস্টেবল আব্দুস সাত্তার। আর গাড়িটা চালাচ্ছিল অমৃত লাল বর্মন নামের একজন। ইয়াসমিনকে নিয়ে এই তিনজন গেল কাছেই সাধনা আদিবাসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। নির্জন স্কুলঘরে ইয়াসমিনের ওপর চালানো হলো অমানুষিক নির্যাতন। পালাক্রমে এই তিন পশু মিলে ধর্ষণ করেছিল কিশোরী ইয়াসমিনকে, তারপর প্রমাণ লোপাটের জন্যে তাকে খুন করে লাশ ফেলে দিয়েছিল দিনাজপুর শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে রানীগঞ্জের ব্র‍্যাক অফিসের পাশে। মায়ের টানে যে মেয়েটা কাউকে কিচ্ছু না বলে ঢাকা থেকে ছুটে এসেছিল, তার নিথর দেহটা পড়ে রইলো রাস্তার পাশে! 

পরদিন সকালে উদ্ধার হলো ইয়াসমিনের মৃতদেহ। জানাজানি হলো গতকাল রাতে ইয়াসমিনকে বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার কথা বলে তাকে টহল ভ্যানে উঠিয়েছিল পুলিশের কয়েকজন সদস্য। ক্ষোভে ফেটে পড়লো দিনাজপুরের মানুষ। আর সম্পূর্ণ উল্টো চিত্রটা দেখা গেল তদন্তকারী কর্মকর্তাদের মধ্যে। 'একজন অজ্ঞাতপরিচয় নারীর লাশ উদ্ধার হয়েছে' লিখে মামলা দায়ের করা হলো, তড়িঘড়ি করে ময়নাতদন্ত শেষ করেই আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের মাধ্যমে দাফন করা হলো ইয়াসমিনের লাশ, এমনকি লাশের গোসল বা জানাজাও করানো হয়নি! ডাক্তারেরা জানালেন, ধর্ষণের পর শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে ইয়াসমিনকে। 

পরদিন, পঁচিশে আগস্ট, দোষী পুলিশ অফিসারদের বিচারের দাবীতে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হলো দিনাজপুরে। এদিকে স্থানীয় পুলিশের পক্ষ থেকে দাবী করা হলো, ইয়াসমিন নাকি একজন পতিতা ছিলেন! ইয়াসমিনের কবরের সামনেও তখন পুলিশি প্রহরা, কাউকে যেতে দেয়া হচ্ছে না সেখানে। এই হত্যাকান্ড নিয়ে পুলিশের একের পর এক রহস্যময় আচরণে বিক্ষুব্ধ জনতা তখন ফুঁসছে। আর জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে ইয়াসমিনকে 'পতিতা বানু' হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে! নিজেদের পরিচিত একটা মেয়েকে এভাবে মেরে ফেলা হলো, সেটার বিচার না করে পুলিশ উল্টো তাকে পতিতা বানানোর চেষ্টা করছে, সেটা মেনে নিতে পারলো না শহরের মানুষ। 

২৬শে আগস্ট শহরের রামনগর মোড়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালনের সময় পুলিশ সেখানকার মাইক ভেঙে দিয়েছিল। সাধারণ মানুষের ক্রোধ বাড়তে থাকে সময়ের সঙ্গে, সেটা প্রশমিত করার কোন উদ্যোগই নেয়া হচ্ছিল না প্রশাসনের পক্ষ থেকে, তারা উল্টো অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বাঁচানোর চেষ্টায় রত ছিল। সন্ধ্যার পরে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে রামনগর মোড়ে ইয়াসমিনের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হলো, তারপর মিছিল নিয়ে সবাই গেল শহরের কোতোয়ালী থানার সামনে। থানা ঘেরাও করে যথাযথ তদন্ত এবং অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিচার দাবী করা হয়। ক্ষুব্ধ জনতা কোন সুনির্দিষ্ট আশ্বাস না পেয়ে থানার সীমানাপ্রাচীর ভেঙে ফেলেছিল সেই রাতে, পুলিশও গুলি চালিয়েছিল থানার ভেতর থেকে, আহত হয়েছিল আট-দশজন সাধারণ মানুষ। 

ইয়াসমিনের স্মরণে নির্মিত হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ

শহরে তখন থমথমে একটা পরিস্থিতি, যেকোন সময় খারাপ কিছু ঘটে যেতে পারে। কিন্ত প্রশাসন তখনও নাক ডেকে ঘুমুচ্ছে। সকাল থেকে বন্যার স্রোতের মতো শহরের আশেপাশে থেকে মানুষজন আসা শুরু করলো। সবার দাবী একটাই, দোষীদের বিচার চাই! হাজার হাজার মানুষের মিছিলটা শহর প্রদক্ষিণ করতে শুরু করলো, সেই মিছিলে হামলা চালালো পুলিশ। নির্বিচারে গুলি চালানো হলো প্রতিবাদমুখর মানুষগুলোর ওপরে, লুটিয়ে পড়লো সামনের সারিতে থাকা বেশ কয়েকজন। ছত্রভঙ্গ হলেও আবার বিভিন্ন এলাকায় ছোট ছোট আকারের মিছিল বের হলো অল্প সময়ের মধ্যেই, সেগুলোতেও হামলা করলো পুলিশ। 

সাতাশে আগস্টের দিনেই পুলিশের গুলিতে ঝরে গিয়েছিল সাতটি তাজা প্রাণ! শহরের আইন-শৃঙখলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়লো পুরোপুরি। দিনাজপুর তখন অরাজক এক রাজ্য, নৃশংস এক হত্যাকাণ্ডের বিচার চাওয়ার অপরাধে ঝরে গেছে কত নিরীহ প্রাণ! শহরে ১৪৪ ধারা জারী করা হলো, নামানো হলো বিজিবি। জেলা প্রশাসক আর পুলিশ সুপারকে প্রত্যাহার করা হলো সেদিনই। কিন্ত এই কাজটা দুইদিন আগে করলে হয়ত এত ক্ষয়ক্ষতি দেখতে হতো না। রাষ্ট্রযন্ত্র বা প্রশাসন অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বাঁচানোর চেষ্টা না করে জনদাবী মেনে নিলে ঘটনা এতদূর গড়াতোও না। 

দিনাজপুরবাসীর পক্ষ থেকে এই ঘটনায় তিনটা মামলা করা হয়েছিল। এরমধ্যে ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যাকান্ডের মামলার বিচারকাজ হয়েছিল রংপুরে, নিরাপত্তার খাতিরে। ১৯৯৭ সালে আদালত তিন অভিযুক্ত মইনুল, আব্দুস সাত্তার এবং অমৃত লাল বর্মনকে ফাঁসির আদেশ দেন। আসামীরা উচ্চ আদালতে আপিল করলেও একই রায় বজায় ছিল। ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এই তিনজনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ইয়াসমিন হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে, কিন্ত ইয়াসমিনের জন্যে ন্যায়বিচার চাইতে গিয়ে যারা পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছিলেন, সেই হত্যাকান্ডের কোন বিচার হয়ন আজও! 

ইয়াসমিন একদিক দিয়ে ভাগ্যবান, মেয়েটা মরে গিয়েও বিচার পেয়েছে। অনেক দূরের অন্য কোন ভূবনে বসে ইয়াসমিন দেখেছে, তার হত্যার বিচারের দাবীতে হাজার হাজার মানুষ কিভাবে রাস্তায় নেমেছে, পুলিশের গুলির সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে! ইয়াসমিনের হত্যার বিচার চাইতে গিয়ে আরও সাতটা প্রাণ ঝরে গিয়েছিল, ইয়াসমিন যেন সাত ভাই চম্পার একমাত্র বোন! কিন্ত যারা ইয়াসমিনের জন্যে নিজেদের প্রাণ উৎসর্গ করেছিল, পুলিশের বেপরোয়া গুলিতে যাদের শরীর ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল, সেই মানুষগুলোর পরিবারের সদস্যরা বিচার পায়নি, কে জানে, হয়তো কখনও পাবেও না!

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা