নারীর সমস্যা নিয়ে কথা বলতে গেলেই কিছু কমন ডায়লগ ধেয়ে আসে। নারী পুরুষ সবাই সেই ডায়ালগ দেন। ডায়ালগগুলো হলো- ‘নারীরাই নারীর শত্রু/ নারীরাই নারীকে পিছে টেনে ধরে/ নারীই নারীকে বেশি অত্যাচার করে, দেখেন না বউরে শাশুড়ি নির্যাতন করে আবার বউ শাশুড়িরে খাইতে দেয় না/ মেয়েরাই মেয়েদের পিছে কুটনামি করে’ ইত্যাদি।

সাদা চোখে দেখলে ডায়ালগগুলা সত্য। এমনকি আমার নিজের জীবনেও যত শত্রু পেয়েছি, তার শতকরা ৬০ ভাগ নারী। তবে বাকি ৪০ ভাগ পুরুষ।

কিন্তু আমি জিন্দেগিতে কোনোদিন উপরের জনপ্রিয় ডায়ালগগুলার কোনোটা কোনোদিন উচ্চারণ করি নাই। করি নাই, কারণ এইসব ডায়ালগের পেছনের যে গভীর সত্য, কুটিল রাজনীতি আর আদিম নোংরা ক্লেদাক্ত ঐতিহ্যের ধারাটা চলমান আছে, সেটি বোঝার মতো ঘিলু ও পড়ালেখা আমার আছে। প্রত্যেকটা ঘটনাকে দেখবার, বুঝবার ও অনুধাবন করার মতো চিন্তাশীল মন আছে। এবং আছে একটা নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি। ফলে 'নারীরাই নারীর শত্রু' মার্কা পিতলা মন্তব্য করে আমি জীবনে হতাশা আর তৃপ্তির ঢেকুর- কোনটাই কোনোদিন ফেলি নাই।

ধরেন, এই মুহুর্তে আমার কাজের ক্ষেত্রে যে ব্যক্তিটি আমাকে শত্রু বা প্রতিদ্বন্দ্বি ভেবে নানারকম প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে, কিংবা ডিফেম করতে চাচ্ছে এবং তাকে যারা সহায়তা দিচ্ছে, এরা সবাই নারী। এখন এই নারীদের চিহ্নিত করে আমি যদি চিৎকার-চেঁচামেচি করে বলি নারীই নারীর শত্রু, তাহলে ওই যে বছর কয়েক আগে যে 'পুরুষ' নিউজ এডিটরটি আমাকে প্রকাশ্য নিউজ রুমে কটুক্তি, অপমান ইত্যাদি করার চেষ্টা নিতেন, যে 'পুরুষ' হেড অব নিউজ, সিএনই আমার মাতৃত্ব নিয়ে ঘেউ ঘেউ করতেন, উনাদের যে 'পুরুষ' পরিচয়টা, সেটা নিয়ে আমার তাহলে কী বলার আছে? যে ডায়ালগ আমি দিলাম, ‘নারীই নারীর শত্রু’, সেই ডায়ালগ এখানে তাহলে কীভাবে দেব? বরং সেই সময় যে সহকর্মীরা আমার পাশে বন্ধু হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, তারা বেশিরভাগই ছিলেন নারী। এখন তাহলে কী বলবেন?

নারী নারীর শত্রু না। নারীর শত্রু সিস্টেম। পিতৃতন্ত্র পুরুষ ও নারী দুই পক্ষরই মগজ ধোলাই করে। সেই মগজ ধোলাইয়ের ফল হলো উভয় পক্ষই কোমর বেঁধে নারীর পিছনে লাগে। নারীর চলার পথে কাঁটা বিছায়। নারীর গায়ে আগুন দেয়। নারীর চরিত্র নিয়ে ঘাটাঘাটি করে। এসব কেন করে? 

করে, যাতে পুরো সিস্টেমের ভেতরে পুরুষের যে আধিপত্য আর প্রভাব, সেটা অক্ষুন্ন থাকে। এই অক্ষুন্ন রাখার কাজটা করতে এই সিস্টেমের নারী ও পুরুষ- উভয়কেই দরকার হয়। যে নারী সিস্টেমের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, প্রতিবাদ জানায়, পরিবর্তনের দাবিতে লড়াই করে, সেই নারী হয়ে ওঠে সিস্টেমের প্রতি হুমকি। সিস্টেম তখন সেই হুমকি নারীর বিরুদ্ধে তার সৈন্য সামন্ত লেলিয়ে দেয়। এই সৈন্যসামন্তরা নারী ও পুরুষ দুই-ই হয়। শুধু পুরুষ না। কারণ একা পুরুষের পক্ষে এই কাজ করা বেশ কঠিন।

পিতৃতান্ত্রিক সিস্টেম সৈন্যদের গড়ে-পিঠে নেয়। এই গড়ে-পিঠে নেবার সিলেবাসে আছে ঐতিহ্য, মূলব্যবোধ, ধারা, প্রথা, ধর্ম, সামাজিক আচার, পারিবারিক সিস্টেম ইত্যাদি গালভরা নামের কতগুলি পাঠ, যা আদতে পুরুষতন্ত্রের আনুষ্ঠানিক মুখপত্র ছাড়া আর কিছুই না। পুরুষতন্ত্র শিখাতে আলাদা ও চকমকে শিরোনামে এই সব পাঠ যুগ যুগ ধরে তৈরি করা হয়েছে, দাঁড়া করানো হয়েছে, আর সেই পাঠ অনুশীলন করানো হয়েছে নারী ও পুরুষ দুই পক্ষকেই। 

পিতৃতন্ত্র পুরুষকে যা শিখিয়েছে, নারীকেও তাই শিখিয়েছে। ফলে পুরুষ ও নারীর মানসিকতা, শিক্ষা, চিন্তাচেতনা, মনন, দৃষ্টিভঙ্গি হয়েছে এক ও অভিন্ন। এরা উভয়ই পিতৃতন্ত্রের প্রতিনিধি। শরীরে এরা কেউ নারী কেউ পুরুষ, কিন্তু মানসিকভাবে এরা দুই দলই পুরুষতান্ত্রিক। যে পুরুষতন্ত্র চেতনে ও অবচেতনে নারীর এগিয়ে যাওয়াকে অস্বীকার করে, নারীর প্রতিবাদকে ঘৃণার চোখে দেখে, নারীর প্রতিভাকে সন্দেহ করে, নারীর উচ্চকণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিতে চায়। তাই যে নারী প্রতিভাবান, সাহসী ও উজ্জ্বল, সেই নারীকে ডিফেম করতে উঠে পড়ে লাগে পুরুষতন্ত্র, আর এই পুরুষতন্ত্রের সৈন্য নারী বা পুরুষ যে কেউ হতে পারে।

নারী পিতৃতন্ত্রের সৈন্য হিসেবে বেড়ে ওঠে বলেই জীবনের প্রতিটা ধাপেই সে পুরুষের মালিকানা ও শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নেয়। পুরুষের ক্ষমতার গদি টিকিয়ে রাখতে সেও প্রাণপাত করে। এই কাজে যখনই বাধা আসে, সে হুংকার দেয়, ঠিক যেমন দেয় পুরুষ। আর এই গদি ধরে রাখার জন্য যত প্রথা ও নিয়মরীতি- সব সে অক্ষরে অক্ষরে পালন করে যায়। এই নিয়ম রীতির ভেতরেই আছে নারীকে নির্যাতন করে তার শারীরিক মানসিক মেরুদণ্ডটি নাজুক বানিয়ে রাখা, তাকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু রাখতে কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখা, তার শিক্ষা, মানসিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করা। 

ফলে ব্যাটার বউয়ের চাকরি করায় সবচেয়ে বড় বাধার নাম শুধু শ্বশুর না, শাশুড়িও। বউয়ের গায়ে অত্যাচারের দাগ শুধু স্বামীর দেয়া লাঠির বাড়িতেই না, শাশুড়ির ছুড়ে মারা রুটি বেলা বেলনেরও। কর্মক্ষেত্রে নারীর পদোন্নতি ‘বসের সাথে শুয়ে হইসে’- এইটা বলা লোকজনের ভেতরে তাই দাঁত কেলিয়ে হাসা নারী সহকর্মীটাও থাকে।

এক্ষেত্রে পুরুষতন্ত্র বাড়তি আরেকটা সুবিধা ভোগ করে। সেটা হল- নারী যখন নারীর পিছে লাগে, তখন পুরুষতন্ত্র একটা নিষ্পাপ চেহারা বানিয়ে চুপচাপ আড়ালে বসে ঠ্যাং দুলাইতে পারে। তাতে পুরো জগতের মনে হতে থাকে, পুরুষতন্ত্র বলে কিছু নাই। বরং নারীরই স্বভাব খারাপ আর তাই এরা একজন আরেকজনের পিছনে লাগে। এই যে নারীর স্বভাব খারাপ, নারী কুটনা, পরশ্রীকাতর, হিংসুক- এইসবও পুরুষতন্ত্রের সিলেবাসে আছে, যা পাঠ করানো হয়েছে নারী ও পুরুষ উভয়কেই।

তাই, নারীই নারীর শত্রু- এই জাতীয় লেইম, মান্ধাত্ত্বামার্কা, অশিক্ষিত ডায়ালগ ছাড়ার আগে, নিজের চিন্তাভাবনা আর দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রসারিত করুন। নতুন করে ভাবা প্র্যাকটিস করুন। আর তা না পারলে চুপ করে থাকেন। শুধু শুধু শব্দদূষণ করবেন না।

* প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা