মেয়েরা পাবলিক প্লেসে ধূমপান করলে পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাবে?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
হয়তো বলবেন, ‘মেয়েদের সিগারেট খাওয়াটাও তবে আমাদের কালচারে অস্বাভাবিক’। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, মেয়েদের ধূমপান কিন্তু হাল আমলের কোনো ফ্যাশন বা ট্রেন্ড নয়।
“মেয়েরা পাবলিক প্লেসে ধূমপান করলে পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাবে”- এই সংক্রান্ত একটি ‘শর্টফিল্ম' আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল কদিন আগে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এ ধরণের তৃতীয় শ্রেণীর জিনিসপত্র নিয়ে আলোচনার পক্ষপাতি নই, কারণ সমালোচনা করে কিছু লিখলেও সেটা এক ধরণের প্রচারণা। আর মিডিয়াতে নেগেটিভ মার্কেটিং অনেক বেশি কার্যকর। এই তথাকথিত শর্টফিল্মটির ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। একটি বাজে ধারণাকে আমরা সমালোচনা করতে গিয়ে প্রমোট করছি। এই লেখাটি যখন লিখছি, ইউটিউবে ঐ ভিডিওটিতে 'লাইক' এর বিপরীতে ‘ডিজলাইক’ এর সংখ্যা কয়েক'শগুণ বেশি। এ সংখ্যাই প্রমাণ করে আমাদের মানসিকতার পাল্লা কোনদিকে বেশি ভারী।
ভিডিওটির মূল বক্তব্য ছিল- পাবলিক প্লেসে একটা মেয়ে ধূমপান করতে পারবে না, করলে পরিবেশ নষ্ট হবে, পাবলিক প্লেসে কোনো মেয়ে ধূমপান করলে আশেপাশের সকল মানুষের অধিকার জন্মে যাবে সেই মেয়েটির দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকার এবং কোনো মন্তব্য করার। ভিডিওটিতে কিন্তু ধূমপানের বিরুদ্ধে কোনো বার্তা দেয়া হয়নি, নির্মাতা স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছে- ছেলেরা পাবলিক প্লেসে চাইলেই ধূমপান করতে পারে কিন্তু মেয়েরা পারবে না, করলে পরিবেশ নষ্ট হবে! ‘যুক্তি’ হিসেবে সে বলেছে- একটা ছেলে চাইলেই তার জামা খুলে রাস্তায় হাঁটতে পারবে, কিন্তু একটি মেয়ে পারবে না!
আমি জানি না, এগুলোর বিরুদ্ধে যুক্তি উপস্থাপন করে কোনো লাভ আছে কিনা, তবে অধিকাংশের চিন্তা চেতনা যখন এরকম বর্বর প্রকৃতির পুরুষতান্ত্রিক, সেখানে কথা বলে যাওয়া ছাড়া তো উপায় নেই। যদিও ভিডিওটি ভাইরাল হয়ে গেছে, অনেকেই এটার কথা জানে, তারপরও আমার এই লেখা যেন এটার প্রচারণা না হয়ে যায়- তাই সচেতনভাবে আমি শর্টফিল্ম এবং এর নির্মাতার নাম লেখা থেকে বিরত থাকলাম। ভিডিওটি না দেখে থাকলেও, আমার বক্তব্য বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
আমার এক বন্ধু একবার টি.এস.সিতে বসে চা পান করতে করতে বলছিল, “টি.এস.সি জায়গাটাকে আমার খুব ভালো লাগে, সেফ মনে হয়।” আমি বললাম, “কেন এমন মনে হয়?” সে উত্তর দিল, “কারণ এটা মনে হয় বাংলাদেশের একমাত্র জায়গা যেখানে মেয়েরা নির্দ্বিধায় সিগারেট খেতে পারে। কেউ তাদের দিকে আলাদা লুক দেয় না!” আমার ঐ বন্ধুর কথা হয়তো পুরোপুরি সত্য নয়, ‘লুক’ হয়তো অনেকেই দেয় টিএসসিতে বসে সিগারেট খাওয়া মেয়েদের দিকে এবং মাঝেমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিশেষ গ্রুপ এবং পোর্টালে এটা নিয়ে লেখালেখিও হয় কিন্তু এটাও ঠিক যে এখানে সবাই যে নিরাপত্তা অনুভব করে, সেটা হয়তো বাংলাদেশে আর কোথাও করে না।
এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো, আমার এই লেখা কোনোভাবেই ধূমপান করাকে উৎসাহিত করার জন্য নয়, ধূমপান ক্ষতিকর। নারী এবং পুরুষ উভয়ের জন্যই। নারী ও পুরুষের শারীরিক গঠনে পার্থক্য থাকলেও উভয়ের ফুসফুস একই রকম এবং সিগারেটের বিষাক্ত নিকোটিন উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর। যেহেতু কথাটা উঠেছে এরকম, ‘ছেলেরা পাবলিকলি ধূমপান করতে পারলেও মেয়েরা পারবে না’, তাই এই বক্তব্যের বিরুদ্ধেই আমার লেখা, ধূমপানের পক্ষে নয়।
ভিডিওটি যদি ধূমপানকে নিরুৎসাহিত করে বানানো হতো, তবে সেটাকে আমরা সাধুবাদই জানাতাম। মেয়েরা সিগারেট খেলে রাস্তার লোকজন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে এবং অবধারিতভাবে মেয়েটিকে খারাপ মনে করে, যতটা খারাপ মনে করে যায়, ততটাই। আবারও বলছি, ধূমপান করা অবশ্যই ক্ষতিকর। তবে সেটা নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই। নিজে নিজে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে শুধু নারীদের উপর ধূমপানের নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয়াটা একধরণের পুরুষতান্ত্রিক ভণ্ডামি। আমরা ধূমপানের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারি, কিন্তু কেউ নারী বলে তাকে আলাদাভাবে ধূমপানে বাঁধা দিতে পারিনা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় কোনো নারীকে যদি তার সমাজ নির্ধারিত ‘ভূমিকা’র বাইরে দেখা যায়, তখনই পুরুষতন্ত্র গেল গেল রব তোলে। তখন সে সমাজ-ধর্ম-প্রকৃতি ইত্যাদি সব কিছু দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে নারীটির উপরে। এ কারণেই কর্মজীবী নারীদের তুলনামূলক ভাবে বেশি হেনস্তার শিকার হতে হয়।
ফিরে আসি ঐ ভিডিওতে। সেখানে নির্মাতা ‘যুক্তি’ দিয়েছেন, ‘পুরুষরা চাইলেই জামা খুলে ওপেনলি হাঁটতে পারবে, নারীরা পারবে না।’ এই ‘যুক্তি’(!) নিয়েও কথা বলা যায়। নারীরা জামা খুলে হাঁটতে পারবে না, ব্যাপারটা সত্যি নয়। উন্নতবিশ্বে অনেক স্থানে ন্যুডিস্ট আন্দোলন, ফ্রি-নিপলস আন্দোলন এসব হয়, সেখানে অসংখ্য নারী ‘জামা খুলে’ মিছিল করেন, কেউ তাদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে না! উন্নত বিশ্বে যাওয়ার দরকার নেই, আমাদের দেশেই অনেক আদিবাসী গোষ্ঠীর নারীরা শরীরের উপরের অংশ উন্মুক্ত করে থাকেন, গোসল করেন। এবং তারা তাদের গোষ্ঠীর পুরুষদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হন না!
যেখানে আপাদমস্তক পোশাকে আবৃত নারীরাই টিজিংয়ের শিকার হন, যেখানে স্লিভলেস ব্লাউজ পড়লেই হায়-হায় লেগে যায়। সেখানে কেন নারীরা ওপেনলি জামা খোলার কথা ভাববেন? বিষয়টা জামা খোলা-পরার নয়, বিষয়টা হচ্ছে কালচারে। উন্নত বিশ্বে কিংবা আদিবাসী সমাজের কালচারে বিষয়টি স্বাভাবিক, আমাদের এখানে অস্বাভাবিক।
হয়তো বলবেন, ‘মেয়েদের সিগারেট খাওয়াটাও তবে আমাদের কালচারে অস্বাভাবিক’। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, মেয়েদের ধূমপান কিন্তু হাল আমলের কোনো ফ্যাশন বা ট্রেন্ড নয়। এদেশে নারীদের ধূমপানের ইতিহাস বহু পুরানো। অতি প্রাচীনকাল থেকেই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের মধ্যে হুকো-তামাক-বিড়ির প্রচলন ছিল। কাজেই নারীদের ধূমপানের বিষয়টি নতুন কিছু নয়। তবে মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরা সাধারণত ধূমপান করতো না, সামাজিক গঠনের কারণে। যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে এই ক্ষেত্রে এখন পরিবর্তন এসেছে।
মধ্যবিত্ত নারী, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কিংবা কর্মজীবী নারীরা প্রকাশ্যে ধূমপান করতে লজ্জাবোধ করেন না। আমাদের সামাজিক মন-মানসিকতার অবস্থা যদি কখনো অতটা উন্নত হয়, যখন কে কী পোশাক পড়লো সেদিকে কেউ তাকিয়েও দেখবে না। তখন নারীরা পোশাক খুলতে পারবে কিনা, এই অপযুক্তিও কেউ দিতে আসবেনা!
সাধারণত কোন সমাজের তরুণ অংশটি বিদ্রোহী হয়, পরিবর্তনকামী হয়। তারা পুরানো রীতিনীতি-ধ্যানধারণাগুলোকে প্রশ্ন করে, এগুলো অমান্য করে, এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। সমাজে নতুন ধরণের চিন্তা-চেতনার উন্মেষ ঘটায়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, আমাদের দেশের তরুণ অংশটি হতাশাজনক রকমের বৃদ্ধ। তারা প্রশ্ন করে না, মেনে নেয়। যারা প্রশ্ন করে, তাদের আক্রমণ করে। তারা নতুন কিছুর কথা বলে না, পুরানো বস্তাপচা নিয়মগুলোকে প্রতিষ্ঠার কথা বলে। তারা তাই বলে, যা বেশিরভাগ লোক শুনতে চায়। শুনে সুখ পায়।
তারা সেই ভয়ানক কথা বলতে পারে না, যা শুনে সমাজে লাগবে বিশাল আলোড়ন। টলে যাবে পুরানোর ভীত। তারা নতুন দিনের সেনাপতি নয়, পুরানো দিনের সৈনিক। তাই আধুনিক প্রযুক্তি হস্তগত হলেও, পুরানো মন-মানসিকতার প্রচারণাতেই তাদের আগ্রহ, কারণ এই পথে আসবে স্বস্তা জনপ্রিয়তা।
কিন্তু আমরা চাই, আমাদের তরুণরা স্বস্তা জনপ্রিয়তার মোহে না পড়ে, পরিবর্তনের কথা ভাববে, পরিবর্তনের জন্য নিজেদের মেধা নিয়োগ করবে। মার্কিন সেলিব্রেটি টিভি-স্টার অপরাহ উইনফ্রে'র একটি ভাষণ শুনছিলাম। সেখানে তিনি বলেছেন, “যারা এক সময় নারীদের দমিয়ে রাখতো, তাদের কথা বলতে দিত না। তাদের দিন শেষ। আমি বলছি তাদের সময় শেষ। সেই সব নারীদের যারা নিজেদের কথা বলতে চায়, এবং সেইসব পুরুষদের যারা এসব কথা শুনতে চায়, তাদের একসাথে এমনভাবে কাজ করতে হবে যেন আমাদের আরেকটা #metoo ক্যাম্পেইন না করতে হয়।”
আমরা ধূমপানের বিরুদ্ধে শর্টফিল্ম বানাবো, নাটক বানাবো, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করব। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে কখনোই আলাদা করে নারীদের লক্ষ্যবস্তু বানাতে যাবো না। সেটি করতে গেলে, এটা আর ধূমপান বিরোধী কাজ না হয়ে, নারী-বিরোধী কাজ হয়ে যাবে। যেখানে পুরুষরা ধূমপান করতে পারে, সেখানে নারীদের ধূমপান করতে কোন বাধা দেখি না। সব থেকে বড় কথা, এ ধরণের শর্টফিল্ম, ভিডিও কিংবা আর্টিকেল আসলে ধূমপান বা অন্য কোন সমস্যার বিরুদ্ধে নয়, নারীদের বিরুদ্ধে। আরো ভালো করে বলতে গেলে, সেই সব নারীদের বিরুদ্ধে, যারা স্থবির সমাজের নিয়ম কানুনকে থোরাই কেয়ার করে। বৃদ্ধ তরুণদের মধ্যে তাদের উপস্থিতি মাঝেমধ্যে আশাণ্বিত করে বৈকি! (তবে ধূমপান না করেও, সমাজ পরিবর্তন করা যেতে পারে! কিন্তু যেহেতু আমি নিজে শখের ধূমপায়ী, তাই অন্য কাউকে ধূমপান করতে মানা করা আমার সাজে না!)