ভারতের আদালত সকল জেন্ডারের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেছে, শবরীমালার ঘটনা যার প্রমাণ। কিন্তু বাংলাদেশের আদালত কি বলছে?

১৯৬১ সালের ১২ই এপ্রিল রাশিয়ার এ্যাস্ট্রোনট ইউরি গ্যাগারিন প্রথম মানব সন্তান হিসেবে একটা রকেটে চড়ে পৃথিবীর বাইরে মহাকাশে ঘুরতে গিয়েছিলেন। ১০৮ মিনিট মহাশূন্যে থেকে তিনি আবার পৃথিবীতে ফিরে এসেছিলেন সূস্থ শরীরে।

সে সময় রাশিয়া-আমেরিকার মধ্যে ভয়াবহ কোল্ড ওয়ার চলছিল। রাশিয়া আগেই স্পেসে মানুষ পাঠিয়ে দিলো, আমেরিকা পিছিয়ে পড়লো।যেটা আমেরিকানদের জন্য খুব লজ্জার একটা ব্যাপার ছিল।

১৯৬২ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি একটা আবেগময়ী ভাষন দেন, We choose to go to moon শিরোনামে । এই ভাষণে তিনি বলেছিলেন, "রাশিয়ার চেয়ে আমরা পিছিয়ে থাকব না। রাশিয়া জাস্ট মহাশূন্যে মানুষ পাঠিয়েছে, আমরা চাঁদে মানুষ পাঠিয়ে দেখিয়ে দেব, আমরা আমেরিকানরাও পারি, ওদের চেয়ে আরো ভাল পারি।"

কেনেডির এই ভাষণ আমেরিকার ইতিহাসে মার্টিন লুথারের "I have a dream" এর মতোই জনপ্রিয় ভাষণ হয়েছিল সেই সময়ে। 

হিলারি ক্লিনটন এর বয়স তখন মাত্র ১৫ বছর। তিনি নাচতে নাচতে চিঠি লিখেছিল NASA'র হেড অফিসে। লিখেছিলেন, "তোমরা নেক্সট কবে চাঁদে মিশন পাঠাবে? আমি সেখানে যেতে চাই। এ্যাস্ট্রনট হিসেবে আমার নাম লিস্টে ঢুকিয়ে দাও। আমার লেখাপড়া, ট্রেনিং কি কি লাগবে, জানাও, আমি প্রিপারেশন নিতে থাকি।"

নাসার লোকেরা তাকে কোনো বেইল দেয় নি। ফিরতি চিঠিতে জানায়, "আমরা কোনো মেয়েকে স্পেসে পাঠাব না। Sorry Little girl, we don't accept women into space program."

ঘটনাটা ১৫ বছর বয়সী কিশোরী হিলারির উপর প্রচন্ড আলোড়ন ফেলেছিল।  তার আত্মজীবনী  "লিভিং হ্রিস্ট্রীতে"  তিনি তা লিখেছেন।  তখন থেকেই তিনি নারী অধিকার নিয়ে সোচ্চার হয়েছিলেন।

হিলারীর আত্মজীবনী লিভিং হিস্ট্রি

মেয়েদের প্রতিবাদ, সমালোচনার মুখে এরপরে মহাকাশে নারী এ্যাস্ট্রনটেরা গিয়েছেন। ভ্যালেন্টিনা তেরেস্কোভা, কল্পনা চাওলা,  সুনীতা উইলিয়ামস, আনুশেহ আনসারিসহ অনেক নারী এ্যাস্ট্রনটই স্পেসে গুরুত্বপূর্ণ মিশনে গিয়েছেন বা ফিউচারেও যাবেন। (এ্যালিজা কার্সন নামের যাকে নিয়ে মঙ্গলে যাওয়ার গুজব উঠেছে, তিনিও একজন নারী) 

 ১৯৬৩ সালে ভ্যালেন্টিনা তেরেস্কোভা স্পেসে গিয়েছিলেন ৭০ ঘন্টার জন্য। সেখানে তার পিরিয়ড নিয়ে কোনো সমস্যা হয়েছিল কিনা, রাশিয়া থেকে খবর পাওয়া যায়নি। আমেরিকার প্রথম মেয়ে এ্যাস্ট্রনট ছিলেন স্যালি রাইড, ১৯৮৩ সালে এক সপ্তাহব্যাপী STS-7 মিশনে গিয়েছিলেন তিনি। 

স্পেসে পিরিয়ড এখনো একটা বড় সমস্যা। মহাশূন্যে অভিকর্ষজ ত্বরণ নেই। তাই সব কিছু নিচের দিকে না পড়ে শূন্যে ভেসে থাকে। পানি খেতে, টয়লেট করতে  অনেক ঝামেলা হয় ।  পিরিয়ডের ব্লিডিং সামলাতেও বেশ একটু কসরত করতে হয়। প্রথম দিকে মেয়ে এ্যাস্ট্রনটরা  স্পেস মিশনে গেলে সেখানে কেজি কেজি স্যানিটারি প্যাড নেওয়ার দরকার হতো। এগুলা ডিসপোজ করাও একটা বড় সমস্যা। এ কারনে বর্তমানে অধিকাংশ মেয়ে এ্যাস্ট্রনট স্পেসে যাওয়ার সময় পিল বা ইঞ্জেকশন গ্রহণ করে পিরিয়ড সাময়িকভাবে বন্ধ রাখেন ওই সময়ের জন্য। ভবিষ্যতের বিজ্ঞানীরা হয়ত আরো ভাল কোনো টেকনোলজি উপহার দিতে পারবেন। এসব প্রতিকূলতা উপেক্ষা করেই নারীরা এখন স্পেসে  দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন।

নারীদের এই "শরীর খারাপ" এর জন্য ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে তাদেরকে বিভিন্ন কাজ থেকে বিরত রাখা হয়েছে। সময়ের পরিক্রমায় কিছু নিষেধাজ্ঞায় পরিবর্তন এসেছে, কিছু নিষেধাজ্ঞা আবার নতুন করে আরোপ করা হয়েছে। 

শবরীমালা মন্দিরে প্রবেশ করা দুই নারী

বছর দুয়েক আগে, ভারতের শবরীমালা মন্দির খুব আলোচিত হয়েছিল। ওই মন্দিরে কোনো মেয়েকে প্রবেশ করতে দেওয়া হত না। নারী অধিকারকর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছিল। একদল মেয়ে ২০১৮ এর দিকে জোর করে মন্দিরে ঢুকে শবরিমালা'র দেবতা আয়াপ্পান এর পূজা করার চেষ্টা করছিলেন । মন্দিরের পুরুষ পুরোহিতরা তখন আবার মন্দিরের রেগুলার পূজা বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিলেন। কয়েক মাস ধরে এই বিক্ষোভ প্রতিবাদ আন্দোলন চলেছিল।

২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ভারতের হাইকোর্ট রায় দিয়েছিল, শবরীমালা মন্দিরে মেয়েদের পূজা করার অধিকার দিতে হবে। ২রা জানুয়ারি, ২০১৯ তারিখে, হাইকোর্টের রায় নিয়ে পুলিশী প্রহরায় 'বিন্দু আমিনি" আর "কংকদুর্গা" নামের দুই নারী শবরীমালা মন্দিরে ঢুকে পূজা দিয়েছিলেন। 

ভারতের আদালত সকল জেন্ডারের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এভাবেই সাহায্য করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের আদালত কি বলছে? 

বাংলাদেশের হাইকোর্ট সম্প্রতি রায় দিয়েছেন মেয়েরা বিয়ের কাজী/রেজিস্ট্রার হতে পারবেন না। কারণ মুসলিম বিয়েতে কিছু ধর্মীয় রিচুয়াল থাকে যেখানে ঋতুবতী নারীর উপস্থিতি নিষেধ। ফলে মাসের কিছু অংশে ওই নারী কাজীর পক্ষে বিয়ে পড়ানো সম্ভব হবেনা। এ কারণে কজীর এই পোস্টে নারীদের নিয়োগের বিপক্ষে রায় দিয়েছে হাইকোর্ট।  

বাংলাদেশের মধ্যে কি কোনো হিলারি ক্লিনটন বা বিন্দু আমিনি আছেন!?  যিনি এই রায়ের খুটিনাটি পর্যালোচনা করে সকল জেন্ডারের সমান সুযোগ প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্যোগী হবেন?

রেফারেন্সেস-


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা