নিজের ছেলেটাকে মেয়েদের মানুষ ভাবতে শেখান। যখনই সে ডমিনেট করতে চাইবে, তাকে শাসন করুন। মেয়েদের কাছে হারলে সেটা পজিটিভলি নিতে শেখান। কোনো স্পেসিফিক মেয়ের কথা তুলে ধরে যখন পুরো নারী জাতিকে জেনারালাইজ করবে, তখন তাকে থামান...

খুব ছোটবেলা থেকেই মেয়েদেরকে আমরা ছেলেরা প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখা শিখে ফেলি। একটু খেয়াল করলে দেখবেন, একদম পিচ্চি ছেলেরাও খেলায় মেয়েদের কাছে হারলে প্রচণ্ড কষ্ট  পায়, বলতে চায় না। অন্য ছেলেদের কাছে হারলে কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই নেয়। এটার কারণ কী?

ছেলেদের এমন দশা হলে পরিবারের সবাই ঐ বাচ্চার সাথে মজা করে। এই মজাগুলো আপাত দৃষ্টিতে নির্দোষ হলেও এর একটা ইমপ্যাক্ট রয়ে যায়, যার জন্য ছেলেটা মেয়েদের আর দশটা মানুষের মতো মনে করে না। মনে করে প্রতিপক্ষের মতো! এই প্রতিপক্ষের মতো মনে করার সবচেয়ে বড় সাইডইফেক্ট হল সর্বদা 'অ্যাই এম বেটার দ্যান ইউ' প্রমাণ করার চেষ্টা। কথায়, কাজে সবখানে মেয়েদের সাথে জিততেই হবে। এই অলক্ষ্যে চলা ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব এধরনের ডমিনেট করার মানসিকতা তৈরি করে নিজের অজান্তেই। নারীর অর্জন তুচ্ছ করে দেখা, তাকে নিজের পেছনে দেখে সুখ অনুভব করা, যোগ্যতায় তার সাথে না পারলে তার নামে কুৎসা রটনা করা, শারীরিকভাবে অপদস্থ করা- এগুলোর সব কিছুর মুল কিন্তু সেই শৈশবেই গ্রন্থিত হয়ে রয়েছে। আমরা জানিও না! 

আমার নিজের কথাই বলি। পড়েছি বয়েজ স্কুল, কলেজে। কলেজে পড়ার সময় বাসায় যে ভাইয়া পড়াতেন, উনার কাছে একবার কথায় কথায় জানতে পারি বুয়েটে নরমালি মেয়েদের ফলাফল খুব ভালো, অনেকে টিচার হয়। ছেলেদের পরাজিত করে মেয়েদের টিচার হওয়া- দুঃখজনক হলেও সত্য, আমার পুরুষতান্ত্রিক সত্ত্বা এভাবেই বিষয়টা অনুধাবন করল। বলাই বাহুল্য, আমার কিছুটা পরাজিত বোধ হল! 

এর বেশ অনেক পরে বুয়েটে ক্লাস শুরু করার সময় প্রথম মেয়েদের সাথে ক্লাস করলাম। নানান আড়ষ্টতা কাটিয়ে তাদের সাথে পরিচিত হলাম। হিসাবমতো পরীক্ষা হল, ফলাফল বের হল। তখন আমি আবিষ্কার করলাম, আমার বান্ধবীদের ভালো ফলাফলে আমি আদতেই ভালো অনুভব করছি। যারা খারাপ করেছে, তাদের জন্য খারাপ লাগছে। আমার মনে আছে, এক বয়স্ক পরিচিত ব্যক্তি আমাকে বলেছিলেন- কিরে তুই কি মেয়েদের সাথে পারবি? কেন জানি না, এই ডায়লগ শুনেই আমি প্রচণ্ড অফেন্ডেড ফিল করেছিলাম। অথচ চিন্তা করে দেখুন, কিছুদিন আগে আমারই কিন্তু মেয়েদের অপেক্ষাকৃত ভালো ফলাফলকে মানতে কষ্ট হচ্ছিল! তো এই পরিবর্তনের হেতু কী? 

আমি পরে এটা নিয়ে অনেক ভেবেছি। আমার নিজের কাছে যে ব্যাখ্যা দাঁড়িয়েছে তা হল- দুই সময়ের মাঝে আমি মেয়েদের প্রতিপক্ষ হতে 'মানুষ' হিসেবে চিনতে শিখেছি। এই বোধ কেবল তখনই হয়েছে, যখন আমি মেয়েদের সাথে ক্লাস করেছি, ল্যাবে কাজ করেছি, মাঝের ছুটির সময়গুলোতে মজা করেছি। আর দশটা ছেলে যেমন আমার বন্ধু, একটা মেয়েও যে এরকম হতে পারে- এই বোধোদয় নিঃসন্দেহে 'আই ওপেনিং' ছিল।

গোটা বুয়েট জীবনে আমি বান্ধবীদের কাছে যে হেল্প পেয়েছি, আমাদের ক্লাসের প্রত্যেকে- তা বলার মতো নয়। নিজেদের সারা টার্ম জুড়ে কষ্ট করে তোলা ক্লাসনোট বিনা দ্বিধায় শেয়ার করেছে আমাদের পড়ার জন্য। কোথা থেকে কী পড়তে হবে, কবে স্যার কী পড়িয়েছে এমন নানান ইনফো দরকার হলেই তারা হাজির। আর এগুলোর জন্য আমরা কিন্তু তাদের 'মেয়ে' হিসেবে আলাদা করে দেখিনি, আর দশটা বন্ধুর চোখেই দেখেছি।

নিজের দুটো অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। আমার এক বন্ধু একবার বলেছিল, দেখ মেয়েদের এভাবে কাজে আসাটা ঠিক নয়। আমি খুব ঠাণ্ডা স্বরে জবাব দিয়েছিলাম- দেখ, তুমি সারাজীবনেও অমুকের মতো রেজাল্ট করতে পার নাই। এখন তোমার যদি কাজের অধিকার থাকে, ওর তো আরও দশগুণ ভালো কাজে সরাসরি যুক্ত হবার অধিকার আছে তাই না? এহেন চাঁছাছোলা মন্তব্যের পরে আলাপ আর আগায় নাই! আরেকবার এক ভাই বয়ান দিলেন যে, দেখ অর্ণব, আমি মেয়েদের কাজ করার পক্ষপাতী। কিন্তু আমি দেখেছি, মেয়েরা আসলে কর্মক্ষেত্রে কাজ করে না। আমি বললাম, ভাইয়া, আমি আপনাকে এখনই পাঁচ জন পুরুষের নাম দিচ্ছি, যারা বিভিন্ন পদে আসীন হয়েও নিজের কাজ ভালো মতো করছে না। এরমানে কি এই যে গোটা পুরুষজাতিকে কাজ করা থেকে সরিয়ে দিতে হবে? উত্তরে ভাইয়া বলেছিলেন আমি নাকি ব্যক্তিগত আক্রমণ করছি! খুব জানার ইচ্ছে ছিল উনি কি আমার সেই পাঁচ জনের লিস্টে নিজের নাম আগেভাগেই কল্পনা করে ফেলেছিলেন কিনা! 

আমার মুল বক্তব্য ছিল, একজন নারীর যদি দোষ থাকে তাহলে দোষ সেই ব্যক্তি নারীর। গোটা নারী জাতি কেন দোষের ভাগীদার হবে? আমরা আজ নারীদের অন্য দশটা মানুষের মতো দেখতে পারি না বলেই তাদেরকে নিজেদের অধিকারের জন্য সোচ্চার হতে হচ্ছে, আলাদা বাসের প্রয়োজন হচ্ছে, প্রয়োজন হচ্ছে আইন। খেয়াল করে দেখবেন, একজন রেপিস্ট ধরা পড়লে অনেকে ডিফেন্ড করতে উঠে পড়ে লাগে। এর কারণ হল, সে একজন রেপিস্টকে সমর্থন না করলেও তার ধরা খাওয়াতে নারীর কাছে নিজের পরাজয় হিসেবে দেখে। এই পরাজয় ঢাকতেই নানান তোরজোড়! 

তাই ছোট থেকেই ছেলেকে মেয়েদেরকে মানুষ ভাবতে শেখান। যখনই সে ডমিনেট করতে চাইবে, তাকে শাসন করুন। মেয়েদের কাছে হারলে সেটা পজিটিভলি নিতে শেখান। কোনো স্পেসিফিক মেয়ের কথা তুলে ধরে যখন জেনারালাইজ করবে, তখন তাকে থামান। মেয়েদের নিয়ে বাজে জোকস বলে অসুস্থ মজা নেয়ার সময় বলুন- সে এমন করে তার মায়ের সাথেও মজা নিচ্ছে! তার মাঝে বোধের জন্ম দিন।

আজ যদি মেয়েদের মানুষ হিসেবে ভাবতে পারতাম তাহলে নারী স্বাধীনতা নামক আলাদা টার্মের জন্ম হত না। নিজ থেকেই বুঝতাম একজন নারী কী করবে সেটা সেই নির্ধারণ করবে, অন্য কেউ না। এই বোধের জন্মের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজন পারিবারিক শিক্ষা, সচেতনতা। আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ইলেকট্রন প্রোটনের স্বরূপ উন্মোচনে সাফল্য দেখালেও, শৈশবে প্রোথিত অন্ধ বিশ্বাসের শিকড় উপড়ে ফেলতে যারপরনাই ব্যর্থ।

বোধোদয়ের একমাত্র অবলম্বন নিজের আচরণকে নিজে প্রশ্ন করা, উত্তরের সন্ধান করা। মেয়েদের এটা করা যাবে না, ওটা ঠিক না- এহেন সামাজিক প্রথা মেনে নেবার আগে দেখার চেষ্টা করা, এমন আচরণ তারা 'মানুষ' হিসেবে ডিজার্ভ করে নাকি। চিন্তার সততা থাকলে উত্তরও আশা করি পেয়ে যাব। আসুন, প্রতিপক্ষ হতে নারীদের 'মানুষ' ভাবার চেষ্টা করি।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা