বাহ্যিক সৌন্দর্য্যের পেছনের রাজনীতিটা বুঝতে শিখুন, হে নারী!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
ফেসবুকের বিউটি প্রোডাক্টের গ্রুপে গ্রুপে, দোকানে বাজারে এদেশের নারীরা বগল ফর্সা বানানোর ক্রিম খুঁজে বেড়ান। এদিকে দুনিয়া কোথা থেকে কোথায় চলে যাচ্ছে! অথচ 'বগল ফর্সা' করার পেছনের রাজনীতিটা যদি তারা বুঝতেন...
ভ্যাটিকান সিটিতে গিয়েছি, ট্যুরিস্টদের কয়েকটা ভাগে ভাগ করে ঘুরিয়ে দেখানো হচ্ছে। আমাদের ট্যুরিস্ট গাইড একজন প্রফেসর। আসলে ইউরোপে প্রায় সব দেশে গাইডরা অধিকাংশই উচ্চশিক্ষিত, কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কেউ পিএইচডি স্টুডেন্ট এরকম। তো আমাদের গাইড একজন পুরুষ। আমাদের সাথে লেগে লেগে চলা যে দলটি, তার গাইড একজন নারী। দীর্ঘাঙ্গী, সুন্দর, চশমা পরা, হাতাকাটা স্যান্ডো গেঞ্জি টাইপ কিছু একটা পরে আছেন আর একটানা বকবক করছেন।
এক জায়গা থেকে আরেক জায়গা, এক ঘর থেকে আরেক ঘরে ঢুকছি। গাইডরা এয়ারফোনে যে যার দলের ট্যুরিস্টদের গুছিয়ে গাছিয়ে এগোচ্ছেন। তো, দেখি ওই ভদ্রমহিলা নিজের দলের সবাইকে ডাকছেন, তো কেউ কেউ দেখতে পাচ্ছে না তাকে ভিড়ের ভেতরে। তো উনি দু’হাত উঁচু করে দলের লোকদের ইশারা করছেন তার দিকে।
তো আমার দক্ষিণ এশীয় চোখ দূর থেকে চলে গেল তার আর্মপিটে। উনি শেভ করেননি। ঘন কালো লোমে ঢাকা তার আর্মপিট।
না, তার আশেপাশে কারু কোন অস্বস্তি নেই। দ্রুত চোখ নামিয়ে নিয়েছি আমিও। কিছুই মনে হয়নি, অস্বস্তিও না।
আর্মপিট হেয়ার রেভ্যুলিউশিন বলে একটা জিনিস আছে। দ্বিতীয় তরঙ্গের নারীবাদীরা যখন সৌন্দর্যের প্রথাগত ধারণাগুলোকে ছুড়ে ফেলতে শুরু করলেন, তখন বাহুমূলের লোম নিয়মিত তুলে ঝকঝকে বাহুমূল ধরে রাখার জন্য নারীর প্রতি সমাজের যে সৌন্দর্যের চাপ, সেটির বিরুদ্ধেও দাঁড়ালেন।
নারীর সৌন্দর্য কমনীয় ত্বক, ঝলমলে দীর্ঘ চুল, লম্বা মেদহীন শরীর, চম্পাকলির মতো লম্বা লম্বা আঙুল, সলসলে হাত পা, সুগঠিত বুক, নিতম্ব, মেদহীন পেট- এসব ধারণার মুখে সপাটে একটা চড় কষালেন তারা।
১৯৬৮ সালে আটলান্টিক সিটিতে মিস আমেরিকা প্রতিযোগিতার বাইরে যে বিশাল মিছিল নামলো নারীবাদীদের, সেখানে তারা সৌন্দর্যবর্ধক ব্রা আর উচু হিলজুতোগুলো উৎসব করে পরিত্যাগ করলেন। একই সময় কেউ কেউ তাদের লোম তোলা রেজর আর টুইজারও ছুড়ে ফেললেন।
একুশ শতকের নারীবাদকে এরই ধারাবাহিকতা বলা যায়, তবে একটু ভিন্ন ফরমেটে। এখন নারীবাদীরা ভাবছেন, সৌন্দর্য নিজের ইচ্ছে ও রুচির ব্যাপার। সমাজ একে কোন ফরমেটে বেধে দিতে পারে না। ইচ্ছে হলে নারী তার ভ্রু প্লাক করবেন, লিপস্টিক দেবেন, মেকাপ করবেন, এমনকি তার ইচ্ছে হলে সেক্সি আন্ডারগার্মেন্টও পরবেন। কিন্তু সেই নারীর যদি আবার ইচ্ছে জাগে আর্মপিট শেভ না করার, সেটি না করার স্বাধীনতাটাও তার আছে। এজন্য তাকে অসুন্দর বলার অধিকারও কারও নেই। কারণ সমাজের বেধে দেয়া বিউটি স্ট্যান্ডার্ডকেই চ্যালেঞ্জ ও অস্বীকার করে আজকের ফেমিনিজম। কারণ এই বিউটি স্ট্যান্ডার্ডের উদ্দেশ্য সৌন্দর্য নয়, এর পেছনের রাজনীতি অনেক গভীর ও জটিল।
আগেকার দিনে এদেশের নারীকে প্রচুর গহনা পরিয়ে রাখা হত। বিশেষ করে নুপুর, চুড়ি ইত্যাদি। এর পেছনে বহু কারণ আছে। প্রথম কারণ নারীকে ব্যস্ত রাখা, এনগেজড রাখা। শাড়ি গহনা আলতা সিঁদুর চুলের সুগন্ধী তেল আতর ইত্যাদি নিয়েই দিন কেটে যেত তাদের অর্থহীন জীবনে। টেরও পেতেন না জীবনের আসল মানেটা যে কী, মানুষ হওয়া কাকে বলে! আর আরেকটা বড় কারণ এই নুপুর চুড়ি ইত্যাদি ঝমঝম করে বাজতো। ফলে বাড়ির বউ মেয়ে কে কোথায় যাচ্ছে, তা চট করে ধরে ফেলা যেত। সে পুকুরঘাটে নাইতে যাচ্ছে নাকি রাতের বেলা জানালায় দাঁড়াচ্ছে, সবই সংকেত বাজিয়ে জানান দিয়ে হত। এড়ানোর উপায় নেই। যত বড় বাড়ির বউ, তত বেশি নজরদারি আর তত বেশি গয়না। চোখে চোখে রাখার কী অপূর্ব কৌশল!
বিউটি স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে নারীর শরীরের সব লোম তুলে ফেলার পেছনেও বহু রকম কারণ আছে। এর একটি বড় কারণ সেই ব্যস্ত রাখা। বাড়িতে বসে বাচ্চা পালা আর ঘরদোর সামলানোর পর হাতে যা সময় থাকে, তা দিয়ে নিত্যনতুন সৌন্দর্য চর্চার উপায় বের করা একটা কাজ বটে। নারী সেই কাজটা মন দিয়ে করে। বাসায় বসে সম্ভব না হলে পার্লারে যায়। পার্লারে গিয়ে হাত পা বগল ভ্যাজাইনার উপরের অংশ- সব কিছু থেকে বাড়তি লোম ঝেড়ে পুছে একেবারে সাফসুতরো রাখে। এক ইঞ্চি গজানোর সাথে সাথে অস্বস্তি শুরু হয় তার, সেই অস্বস্তি শুধু তার একার না, সমাজেরও।
বলা বাহুল্য, পুরুষেরও লোম আছে। নারীর শরীরের যে যে স্থানে লোম আছে, পুরুষেরও হুবহু সেই সেই স্থানে লোম হয়, থাকে। এর বাইরেও পুরুষের শরীরের বিভিন্ন স্থানে লোম হয়, যা নারীর হয় না। বুকে পেটে পিঠে কাঁধেও পুরুষের লোম গজায় এবং তা নারীর চেয়ে অনেক বেশি ঘন, বড় এবং চোখে পড়ার মতো।
মজা হলো, পুরুষকে লোম কাটতে বলা হয় না। বরং পুরুষের লোম থাকাটাকেই পুরুষালি বলে প্রচার প্রচারণা করা হয়েছে। ফলে পুরুষ বড় বড় লোমওয়ালা পা নিয়ে হাফপ্যান্ট পরে প্রকাশ্যে ঘুরতে পারেন, বগলের নিচের লোম জনসমক্ষে তুলে ধরতে পারেন, পিঠ বুকের লোম নিয়ে জামা খুলে বারান্দায় বসে রোদ পোহাইতে পারেন। কেউ তাকে কুচ্ছিত বলে না, জঘন্য বলে না, অসুন্দর বলে না। বরং বলে- পুরুষালি।
এই যে পুরুষালির সংজ্ঞা, এই যে লোম দেখাতে পারার সুযোগ, এটা হয়েছে পুরুষের সুবিধার জন্য। লোম তোলার জন্য পুরুষের দিনের বড় অংশ সময় যায় না, মনোযোগ যায় না। সেই সময় ও মনোযোগ পুরুষ কোন একটা প্রোডাকটিভ কাজে লাগাতে পারে। ক্যারিয়ার বানাতে পারে, টাকা রোজগার করতে পারে। সেইসব কাজ-কাম শেষ করে পুরুষ যখন ঘরে আসে, তখন তার জন্য অপেক্ষা করে লোম উঠানো কোমল ত্বকের নারী, সেই নারীকে জড়িয়ে ধরে পুরুষের বাড়তি আরাম হয় বটে, নারীর কী লাভ হয় আল্লাহ জানে!
ফেসবুকের বিউটি প্রোডাক্টের গ্রুপে গ্রুপে, দোকানে বাজারে এদেশের নারীরা বগল ফর্সা বানানোর ক্রিম খুঁজে বেড়ান। এদিকে দুনিয়া কোথা থেকে কোথায় চলে যাচ্ছে! আর্ম পিটের লোম তোলার পেছনের রাজনীতিটা নিয়ে যখন কথা হচ্ছে, তখন আপ্পিরা পড়ে আছে প্রতিদিন লোম তোলার পরও বগল কেন যথেষ্ট সাদা হচ্ছে না, সেই ধান্ধা নিয়ে!
এরা আর কবে মানুষ হবে, তা নিয়ে একটা গবেষণা হতে পারে।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন