সামান্য শীতেই আমরা কাবু হয়ে যাই। অথচ এমন অনেক প্রানী রয়েছে, প্রচন্ড শীতে, জমাট বরফ কিংবা হিম শীতল পানিতে মজা করে দাঁপিয়ে বেড়ায়। আজকে জানবো এমন কয়েকটি শীতের দেশের প্রানী এবং তাদের অদ্ভুত কান্ড-কারখানা সম্পর্কে...

স্নো লেপার্ড (তুষার চিতা): হিমালয় পর্বতমালার ষোল হাজার ফুট উচুতে বাস করে এই স্নো লেপার্ড বা তুষার চিতা। রহস্যময় আচরনের জন্য এদের ঘোষ্ট অফ মাউনটেন বা পাহাড়ের ভুত নামে ডাকা হয়। মাইনাস তিরিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার নিচেও এরা স্বাচ্ছন্দে বসবাস করতে পারে। মজার ব্যাপার হলো অন্যান্য বাঘের মতো এরা কখনই গর্জন করে না, নির্জন জায়গায় থাকতে পছন্দ করে।  শরীরে কালো ও বাদামী গোল ছোপ-ছোপ দাগের কারণে সহজেই এরা পাহাড়ি প্রকৃতির মাঝে নিজেদের লুকিয়ে ফেলতে পারে। প্রচন্ড ক্ষীপ্র গতির এই চিতা তার নিজের ওজনের চেয়ে দুই-তিন গুন বড় শিকার ধরতে পারে।

মাস্ক বুল (কস্তুরি ষাড়): লম্বা ঝাকরা লোমের এই প্রানিটিকে দেখলে অনেকেই হয়তো চমকে উঠবেন। গ্রীন ল্যান্ড, আলাস্কা ও রাশিয়ার প্রবল শীত অঞ্চলে এই প্রানিটির আবাস। এর সারা শরীর জুড়ে লম্বা চুলের একটা আবরন আর তার নিচে বাদামি ঘন লোমের আস্তরন। শরীরের এই বিশেষ বৈশিষ্ট্য এদের প্রবল শীতের হাত থেকে রক্ষা করে। নেকড়ে ও পোলার বিয়ার এদের প্রধান শক্র, তাই আক্রমন থেকে বাঁচতে এরা দল বেধে থাকে একং বাঁকানো লম্বা শিঙের সাহায্যে আত্নরক্ষা করে। এদের রয়েছে ধারালো শক্ত ক্ষুর, এই ক্ষুরের সাহায্যে এরা শীতের সময় বরফের আস্তরন আচরে তুলে নিচে ঘাষের মূল ও শেকড় বের করে আনে। শীতের সময় এসব শেকড় ও মূলই মাস্ক বুলের একমাত্র খাদ্য।

মাস্ক বুল

পোলার বেয়ার (মেরু ভালুক): হিম শীতল বরফে আচ্ছাদিত উত্তর মেরু আর পোলার বিয়ার একটি যেন অন্যটিকে ছাড়া ভাবাই যায় না। একটু শীতেই আমরা কেমন কাতর হয়ে যাই, অথচ মেরু অঞ্চলে হিম শীতল ঠান্ডা পরিবেশে সারা বছড় দাপিয়ে বেড়ায় ছয়শো থেকে সাতশো কেজি ওজনের বিশাল দেহী এই প্রানীটি। পোলার বিয়ার বসবাসরত এলাকায় স্বাভাবিকভাবে শিকার পাওয়া খুবই কঠিন। কিন্তু এরা ভিষন সুযোগসন্ধানী, ঘ্রান শক্তি খুব প্রখর হওয়ায় অনেক দূর থেকেও এরা শিকারের ঘ্রান পায় এবং তা এতটাই যে বরফের তিন ফিট নিচ থেকেও এরা গন্ধ শুকে শিকারের অবস্হান চিহ্নিত করতে পারে।

এদের শীল মাছ শিকারের কৌশল বেশ চমকপ্রদ। প্রথমে এরা শীল মাছের শ্বাস নেয়ার গর্তের খুব কাছে চুপটি করে করে বসে থাকে, যেই কোন শীল মাথা বের করে, ওমনি ওটাকে পাকড়াও করে ওপরে তোলে। এমনকি সুযোগ পেলে এরা ছোট ডলফিন’ও শিকার করে। শীত মৌসুমে পোলার বেয়ার প্রচুর খাবার খায়, যা এদের শরীরে অতিরিক্ত চর্বি হিসেব জমা থাকে, অতিরিক্ত এ চর্বি তাদের দেহের তাপমাত্রা ধরে রাখতে সাহায্য করে, ফলে প্রতিকুল ঠান্ডা পরিবেশেও এদের কোন সমস্যা হয় না।

আর্কটিক ফক্স (মেরু শেয়াল): আর্কটিক ফক্স সাধারনত ধবধবে সাদা রঙের হয়ে থাকে এবং  শরীর পুরো লোমে ঢাকা থাকে। যেসব এলাকায় বরফ ধবধবে সাদা নয়, ধূসর ধরনের, সেখানে মেরু শিয়ালদের রংও হয় ধূসর। খুব ঠাণ্ডা পড়ে এমন এলাকায় এরা তাকতে পছন্দ করে। তাই এদেরকে দেখতে হলে তোমাকে যেতে হবে  আলাস্কা, কানাডা, গ্রিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড, নরওয়ে, রাশিয়ার মতো শীতপ্রধান এলাকায়। এদের শীত সহনশীলতা এতো বেশি যে, মাইনাস ষাট ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচের তাপমাত্রায়ও এরা দিব্বি ঘুরে বেড়ায়।

আর্কটিক ফক্স সাধারনত দেড় থেকে দুই ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। এদের লম্বা লোমশ লেজ আছে, যেটা এক ফুটের মত লম্বা হয় আর এই লেজ দিয়ে জড়িয়ে এরা নিজের শরীর গরম রাখে। মেরু শিয়ালরা বাড়ি বানায় মাটির তলে, গুহায়। মেরু শিয়ালদের ঘ্রাণশক্তি প্রখর এবং কানও খুব খাড়া। ছোট পাখি, পাখির ডিম, কাঠবিড়ালী, ফলমূল— এসব কিছু খেয়েই এরা বেঁচে থাকে। বুনো পরিবেশে এরা তিন থেকে ছয় বছর পর্যন্ত বাঁচে।

পেঙ্গুইন: পেঙ্গুইন পাখি হলেও এরা কিন্তু উড়তে পারে না। এদের বসবাস বরফ আচ্ছাদিত অ্যান্টার্কটিকাতে। পেঙ্গুইনের বেশ কয়েকটি জাত রয়েছে, সবচেয়ে বড় প্রজাতিটির নাম হচ্ছে এম্পেরর পেঙ্গুইন; এরা উচ্চতায় ৪ ফুট এবং ওজনে প্রায় ৪৫ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। আর সবচেয়ে ছোট প্রজাতিটির নাম হলো এডিলি। সাদা বরফের উপরে কোন পেঙ্গুইনকে দেখলে তোমার মনে হবে যেন কোন ভদ্রলোক কোট পড়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেরুর মাইনাস ষাট ডিগ্রি সেলসিয়াস এর নিচের তীব্র ঠান্ডা থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য এদের দেহে ছোট উজ্জ্বল পালকের মতো তাপরোধক এবং তাপ পরিবাহী আবরণ থাকে।

তাছাড়াও এদের চামড়ার নিচে দুই ইঞ্চির মতো পুরু চর্বির স্তর থাকে। সাঁতার কাটায় পেঙ্গুইনরা বেশ পটু, প্রতি ঘন্টায় এরা প্রায় ৩০ মাইল পর্যন্ত পথ পাড়ি দিতে পারে। মানুষের মতই পেঙ্গুইন সামাজিক জীব, এরা দলবদ্ব হয়ে থাকতে পছন্দ করে। অসম্ভব শান্তিপ্রিয় আর বুদ্ধিমান এই পাখিটির জীবনযাত্রা মানুষকে আজও বিস্মিত করে।

ওয়ালরাস (সিন্ধু ঘোটক): ওয়ালরাস বা সিন্ধু ঘোটক একটি জলজ স্তন্যপ্রায়ী প্রাণী। উত্তর মেরুর কাছাকাছি অঞ্চলে এরা বসবাস করে। এরা সামাজিক জীব এবং মোটামুটি চল্লিশ বছর পর্জন্ত বাঁচে। পূর্নবয়স্ক একটি ওয়ালরাসের ওজন এক হাজার থেকে দেড় হাজার কেজি পর্জন্ত হয়ে থাকে। এদের মুখে হাতির দাঁতের মত সাদা দাঁত রয়েছে যা তিন ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। এই দাঁতের সাহায্যে এরা জল থেকে ডাঙায় উঠে আসতে পারে আবার বরফের তলায় থাকাকালীন শ্বাস নেওয়ার জন্য বরফে ফুটো তৈরি করতে পারে।

ওয়ালরাস

এমনকি নিজের বিচরন এলাকা রক্ষা করার সময় অন্য ওয়ালরাসদের সাথে লড়াই করতে পারে। স্থুলাকার এই প্রানিটির গায়ে পুরু চর্বির স্তর তাকায় এরা অগভীর জল, ও বরফের মধ্যে থাকতে পছন্দ করে। শামুক ও ঝিনুক এদের প্রধান খাবার। দিনে সতের থেকে আঠার ঘন্টা এরা ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয়। এদের মুখে গোঁফ আছে, সাঁতার কাটার সুবিধার জন্যে আছে দু জোড়া ফ্লিপার। জলের মধ্যে এরা ঘণ্টায় ৩৫ কিমি পর্যন্ত দ্রুত সাঁতার কাটতে পারে। ফ্লীপারের নিচের দিকটা অমসৃণ হওয়ায় এরা ডাঙ্গায় চার পায়ে, মানুষের মত জোরে দৌড়তে পারে।

উত্তর মেরুর আদিবাসীরা ওয়ালরাস শিকার করে এবং খাদ্য ছাড়াও এর চামড়া, হাড় ও দাঁত বিভিন্ন কাজে লাগায়। সামুদ্রিক তিমি ও শ্বেত ভাল্লুক এদের প্রধান শক্র। বর্তমান সময়ে এদের সংখ্যা দিনদিন কমে যাচ্ছে বলে এরা বিপন্ন প্রজাতির প্রানির তালিকায় রয়েছে।

আরও অন্যান্য কোন প্রানী সম্পর্কে আপনাদের আগ্রহ থাকলে কমেন্টে আমাদের লিখে জানাতে পারেন। আমরা সেগুলো নিয়ে পরবর্তীতে লেখার চেষ্টা করবো।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা