কেন আমার চারপাশের পরিচিত মানুষগুলো তাদের জীবন নিয়ে এত বেশি হতাশ? কেন তাদের কৈশোরের দুরন্ত এনার্জিগুলো হারিয়ে গেছে? কেন তাদের আচরণে নিয়মিত বার্ধক্য উঁকি দিচ্ছে?

এর উত্তর একটু পরে দিচ্ছি, তার আগে প্রাসঙ্গিক একটা বিষয় বলে নিচ্ছি। 

আজকাল,  নানা-নানুদেরও ফেইসবুক একাউন্ট আছে। পাশের দেশ ভারতে প্রচুর ষাটোর্ধ মানুষেরা টিকটক করা শুরু করেছেন। এদের কারো কারো মিলিয়ন ভিউ হচ্ছে। প্রশ্ন হল, মানুষ কেন ঘরের মানুষ থেকে সরে গিয়ে অপরিচিত মানুষদের সাথে সামাজিক হচ্ছে? কেন এই ক্রেজ? কারণ উনারা সোশ্যাল মিডিয়া ব্যাবহার করে সুখী হচ্ছেন। টিকটকে ওনাদের নিজেদের পোল ড্যান্স থেকে শুরু করে,  প্রপোজ করার ভিডিও দেখাতে ভাল লাগছে। 

সোশ্যাল মিডিয়ার সাথে সুখের যোগসূত্র নিয়ে প্রচুর গবেষণা হয়েছে। ডঃ লি ফারখুহা (Dr. Lee Farquha) এর গবেষণাটা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে। ভদ্রলোক প্রমাণ করে দেখিয়েছেন, মানুষ নিয়মিত সোশ্যাল মিডিয়ায় অন্যদের জীবনের সাথে নিজের জীবনের তুলনা করেন। যখন সে দেখেন, অন্য কারও তুলনায় তার জীবন, তার কাজ বেশি এপ্রেসিয়েশন পাচ্ছে, তখন সে সুখী হন। মানে লাইক কমেন্ট এর সংখ্যা অনুযায়ী তার সুখের কম-বেশি  নির্ধারিত হয়। তার লাইক বেশি দেখে অন্য কেউ যখন দুঃখী হন, সেটা তাকে আনন্দিত করে!

লাইক-কমেন্টের উপর এখন মানুষের সুখী হওয়া নির্ভর হরে

ঘুরেফিরে হুমায়ুন আজাদের সেই কথাই সত্যি, ´সুখ হলো তাই, যা অন্যের  মনে ঈর্ষা জাগায়´। এই ঈর্ষা বা সুখী হওয়া দোষের না, কিন্তু যে কোনো ফেইমের একটা মূল্য আছে। বাস্তব জগত থেকে, প্রিয় মানুষগুলো থেকে এবং নিজের ভেতরের একান্ত আনন্দ থেকে মানুষ অনেক দূরে সরে যায়। 

এই যে যারা ফেমাস, সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্সার, নায়ক-গায়ক কিংবা স্টার, তাদের জীবন মোটেও সহজ না। হাজার হাজার মানুষের এক্সপেকটেশনের সাথে ডিল করা মানে নার্ভের উপর নিয়মিত পেশার দেয়া। একটা প্রেশার কুকারের ভেতরে থেকে ফেইম  উপভোগ করার শক্তি সবার থাকে না। তাই ফেইসবুক স্টার, টিকটক স্টার, ইউটিউব স্টারদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা আজকাল খুব কমন হয়ে গেছে। বিখ্যাত অভিনেতা রবার্ট উইলিয়াম থেকে সুশান্ত সিং পর্যন্ত স্টারদের জীবন থেকে পালিয়ে যাবার ঘটনা নিয়মিত ঘটছে। 

প্রথমেই বলেছিলাম, কেন আমার চারপাশের পরিচিত মানুষগুলো তাদের জীবন নিয়ে এত বেশি হতাশ? কেন তাদের কৈশোরের দুরন্ত এনার্জিগুলো হারিয়ে গেছে? কেন তাদের আচরণে নিয়মিত বার্ধক্য উকি দিচ্ছে? 

কারণ, তারা প্রচণ্ড স্ট্রেস-ফুল জীবনযাপন করেন। ভাবুন তো, শেষ কবে একটা পুরো দিন আপনি কোন টেনশন ছাড়াই কাটিয়েছেন। কোন চিন্তা নেই, জাস্ট ঘুরে ফিরে, আনন্দ করে, কিচ্ছু না ভেবে কাটিয়েছেন? আমি নিশ্চিত আপনি হাতের আঙুল গুনে বলে দিতে পারবেন, কিংবা সেটাও পারবেন না।

কেন এখন সবাই জীবন নিয়ে এত হতাশ থাকে?

এর ফলাফল হলো জীবনের প্রতি উৎসাহ হারিয়ে ফেলা। প্রথমে মনে হয় এটাই বোধহয় জীবন, এভাবেই জীবন কেটে যাবে, কিন্তু আসলে তা না। লাইফে স্ট্রেস নিতে নিতে এক সময় মানুষ ভেঙে যায়। অন্যের কী আছে সেটা আমার কেন নেই এই চিন্তা থেকেই মানুষ একটা অলিক জীবনের পেছনে ছুটতে শুরু করে। 

অন্যের ফ্ল্যাট আছে, আমারও করতে হবে, কিন্তু কেন করতে হবে, কেন ভাড়া বাড়ি কিংবা নিজের বাবা-মায়ের বাড়িটা যথেষ্ট নয় এই  ভাবনাটা ভাবেন না। আগে প্রতি দুই ঈদে মানুষ দুটো কাপড় কিনত, তাতেই তারা সুখী ছিল; এখন রোজ কাপড় বদলায় কিন্তু মানুষ সুখী না । 

ছোট জীবন, অল্পতে খুশি থাকা শিখে নিলে হতাশা কমে আসে। অভিজিৎ ব্যানার্জি তার একটা ইন্টার্ভিউতে বলেছিল, মানুষ কোন কিছু অনুকরণ করতে পারলে সুখী হয়। মানে হলো, পাশের বাসায় পোলাও রান্না হয়েছে তাই আমার বাসায় পোলাও রান্না হলেই আমি সুখী। 

অভিজিতের সাথে আমি একমত। আজকাল, কাউকে আই লাভ ইউ বলাটা সুখী হবার জন্য যথেষ্ট কারণ না, সেটা যত মানুষ দেখবে, জানবে ততই  সুখের পরিমাণ বাড়বে। তাই এসব ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়াতে ভরতি। সে সব ভিডিওতে যত লাইক, তারা তত সুখী অথচ প্রপোজাল একসেপ্ট কিংবা রিজেকশনের উপরে সুখ দুঃখ নির্ভর করার কথা ছিল। 

শেষ করছি একটা ছোট বিষয় বলে। খুব অল্প সময়ের জীবন, এই তো সেদিন স্কুলের মাঠে খেলতাম অথচ সময় কোথা থেকে চলে গেছে! জীবনে সুখী হবার জন্য বছরে দুটা জামা, মাথার উপরে ছাঁদ, নিয়মিত খাবার আর প্রচুর গান আর ঘোরাফেরার অপশন ছাড়া আর কিছুর দরকার নেই। 

স্টার হয়ে আসলে হয় কী? যারা স্টার ছিল, তারা কেউ আজীবন বেঁচে থাকেননি। এক সময় এই  মহাবিশ্বও ধ্বংস হয়ে যাবে, কিছুই থাকবে না। তাই একটা জীবন পেয়েছেন উপভোগ করুন। জীবনটা প্রেশার কুকারে দিয়ে সেদ্ধ করবেন না। তার চেয়ে চাহিদা কমিয়ে সুখী থাকুন। আমার জীবনে দীর্ঘশ্বাসের স্থান থাকবে না। মাঝ রাতে ভাবতে ভাল লাগবে, জীবন জোস! এটা ভেবে আক্ষেপ হবে, ঈশ!  কেন জীবনটা একটু লম্বা হল না।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা