রিমান্ডের মতো মারধর করা হয় না এখানে, বরং সময়মতো খাবার দেয়া হয়, আলাদা রুম থাকে প্রত্যেক বন্দীর জন্য। কিন্ত এখানে কয়েকদিন কাটালেই মানুষ হেলুসিনেশনে ভুগতে শুর করে, দীর্ঘদিন থাকলে পাগল হয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। এই ভয়ংকর হোয়াইট টর্চার সেল জিনিসটা আসলে কী?

হাসিবুর রহমান ভাসানী 

'রিমান্ড' শব্দটা শুনলেই আমাদের গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। সাধারণত আমাদের দেশে অপরাধীদের শাস্তি বা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এই ধরনের ব্যবস্থা করা হয়। এর শাব্দিক অর্থ 'তদন্ত সাপেক্ষে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আদালত থেকে হাজতে পাঠানো'। তবে এই তদন্ত/জিজ্ঞাসাবাদ নিয়ে নানামহলে নানান রকম কথা প্রচলিত আছে।  অনেকেই এটিকে বর্ণনা করতে গিয়ে বেতের আঘাত,পানিতে চুবানো,ডিম থেরাপি সহ বিভিন্ন ধরনের শাস্তির কথা উল্লেখ করেছেন। ব্যাপারটা এমন যে,বিভিন্ন দেশে অপরাধীদেরকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় এমনসব শারীরিক শাস্তি দেয়া হয়, যেগুলো সহ্য করতে না পেরে অপরাধী তার অপরাধগুলো স্বীকার করে নেয়।

এখন কথা হচ্ছে,পৃথিবীর সমস্ত দেশেই কি অপরাধীদেরকে শুধুমাত্র শারীরিক শাস্তিই দেয়া হয়? উত্তর হচ্ছে- না। আজ এমন এক শাস্তির কথা বলব, যেখানে কোনোরূপ শারীরিক নির্যাতন করা হয় না। বরং আপনাকে সময়মতো খাবার দাবার ও দেয়া হবে, একইসাথে থাকার জন্য একটা জায়গাও।

নিশ্চয়ই ভাবছেন এটা তাহলে কোনো শাস্তি হলো? এবার আসি আসল কথায়। এই বিশেষ ধরনের শাস্তিটির নাম 'হোয়াইট টর্চার' বা 'হোয়াইট রুম টর্চার'। বর্তমান সময়ে পৃথিবীর জঘন্যতম দশটি শাস্তির মধ্যে এটি একটি। গত কয়েক দশক আগে থেকে শুরু হয়ে এখন অব্দি এটি চলছে ইরান,আয়ারল্যান্ড,আমেরিকা, ভেনিজুয়েলা এবং ইউরোপের কয়েকটি দেশে।

এটি মূলত একধরনের মানসিক শাস্তি। অনেক অপরাধী আছেন যারা ভীষণ সাহসী,শারীরিক শাস্তির তোয়াক্কা করেন না; তাদের জন্য এই বিশেষ ব্যবস্থা। যাতে তাদের মধ্যে ভয় তৈরি হয়। হোয়াইট টর্চারে প্রথমত আপনাকে একটি সম্পূর্ণ আলাদা রুমে নেয়া হবে, যেটি থাকবে সাউন্ডপ্রুফ মানে আপনার রুমে বাইরের কোনো শব্দ আসবেনা এবং ভেতর থেকে কোনো শব্দও বাইরে যাবে না।

এখন আসি রুমের বৈশিষ্ট্যে- ধবধবে সাদা রঙের একটা রুম, ফ্লোর একদম সমতল এবং সাদা রঙের; দেয়াল সাদা রঙের, মাথার উপরের ছাদও সাদা রঙের। রুমে ২৪ ঘন্টা সাদা আলো জ্বলবে এবং খুব বিশেষায়িতভাবে লাইটটি সেট করা থাকবে যাতে করে রুমের কোত্থাও বিন্দুমাত্র ছায়াও না পড়ে। কোনো প্রকার জানালা থাকবে না, থাকলেও কয়েক মিলিমিটার দৈর্ঘ্যের, সেখান থেকে কিছু দেখা যাবে না, কারণ বাইরে পুরু নেটের আস্তরণ।

এরপর আসি অন্যান্য জিনিসপত্রে; আপনার পোষাক পুরোটাই হবে ধবধবে সাদা, বিছানা, বালিশ ,বেডশিট সব ধবধবে সাদা। আপনি টয়লেটে যাবেন, টয়লেটের দরজার নিচ থেকে আপনাকে ট্যিসু দেয়া হবে; যার রঙও থাকবে সাদা। খাবার হিসেবে আপনি পাবেন কেবল ভাত, যেটিও সাদা বর্ণেরই। যে প্লেটে করে দেয়া হবে সেটাও সাদা রঙের।

এরকম একটা কক্ষে রাখা হয় বন্দীকে

সেখানে কর্মরত কেউ আপনার কাছে খুব একটা আসবে না। কর্মচারীরা এক বিশেষ ধরনের জুতো পরেন, যেটা পায়ে দিয়ে হাঁটলে কোনো প্রকার শব্দ হয় না। মানে হচ্ছে আপনি বাইরের একটা শব্দও শুনতে পাবেন না। আর বন্দী থাকা অবস্থায় কারো সাথে কথা বলাও নিষেধ। আপনি শুধু নিজের সাথেই কথা বলতে পারবেন।

আপনার আশেপাশের সবকিছু সাদা দেয়ার কারণে এরকম পরিবেশে থাকতে থাকতে আপনি আস্তে আস্তে অনুভূতি শক্তি হারাবেন। এরপর আপনি ঘ্রাণশক্তি হারাবেন, একইসাথে হারাবেন খাবারের স্বাদও। পুরো রুম সর্বক্ষণ সাদা আলোয় ভর্তি থাকায় আপনি ঠিকঠাক ঘুমুতেও পারবেন না। খুব দ্রুতই আপনার হ্যালুসিনেশন(অলীক কিছুতে বিশ্বাস করা) শুরু হবে।

পরের ধাপে ক্রমেই আপনি মানসিক বিকারগ্রস্থ হওয়া শুরু করবেন। একসময় আপনার পুরো ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়েরই কাজে ব্যাঘাত ঘটবে এবং আপনি চলৎশক্তিহীন/অসাড় হয়ে পড়বেন। সাধারণত অপরাধ অনুযায়ী একজন অপরাধীকে কয়েক মাস থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত এসব রুমে আটকে রাখা হয়। হোয়াইট রুম থেকে বের হবার পর অপরাধীর এমন অবস্থা হয় যে, সে কাউকেই আর চিনতে পারে না। সাময়িক স্মৃতিভ্রম হয়। সে কোথায় ছিল, কেনো ছিল বা আগে কি করতো সবকিছুই ভুলে যায়। পরবর্তীতে অনেক সময় নিয়ে এটা সারলেও এর প্রভাবগুলো সারাজীবনের সঙ্গী হয়ে যায়।

আমির আব্বাস ফখ্রাভার নামক এক ব্যক্তিকে প্রথম এই শাস্তি দিয়েছিলো ইরান সরকার। এছাড়াও সত্তরের দশকে জার্মান সাংবাদিক এবং সন্ত্রাসী উলরিখ মেনহফকেও এমন হোয়াইট রুম টর্চার সেল এ রাখা হয়েছিল। তিনি তার বর্ণনায় বলেছিলেন, মাঝেমধ্যে আমার মনে হতো যেন আমার মাথা ফেটে সব বের হয়ে যাচ্ছে।

একবার তার সাথে একজন দেখা করতে এসেছিলেন, কিন্তু সেই লোক চলে যাওয়ার পর উলরিখের কখনও মনেই হয়নি যে কেউ কোনদিন তার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন। মুক্তির ২ বছর পর উলরিখ আত্মহত্যা করে মারা যান।

সায়েদ ইবরাহীম নবাভী একজন ইরানিয়ান সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন। ইরান সরকার তাকে হোয়াইট রুম টর্চার সেলে বন্দী করেন। নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন,ঘুমের ঔষধ নেয়া ছাড়া তিনি একটা রাতও ঘুমাতে পারেননি। প্রচন্ড রকম একাকিত্ব তাকে গ্রাস করে নিয়েছিলো এবং ২০০৪ সালে মুক্তির পরও তার মধ্যকার সেই একাকিত্ব দশার অনুভূতিটা কাটেনি। তার মতে তার অনূভুতি শক্তি হ্রাসের পাশাপাশি আরও কিছু মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছিল। যেমন তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে,তার স্ত্রী কিডন্যাপ হয়েছে এবং তার বন্ধু বান্ধব পুলিশের কাছে মিথ্যা তথ্য দিয়ে তাকে ফাঁসিয়েছে।

আমির ফখ্রাভার নামক ১৭ বছর বয়সী একজন ছাত্রকেও এমন হোয়াইট রুম টর্চারে আট মাস আটকে রাখা হয়েছিল। মুক্তির পর সে তার নিজের বাবা-মাকেও চিনতে পারেনি। বহুল আলোচিত এই টর্চার সেল নিয়ে বেশ কিছু সিনেমা,সিরিজ এবং বইও রচিত হয়েছে। THX 1138 এবং White Chamber এ মুভি দুটিও এই হোয়াইট রুম টর্চার এর উপর ভিত্তি করেই নির্মিত।

তথ্যসূত্র- 

  1. https://emadion.it/en/tortures/white-torture-the-damage-it-can-cause
  2. https://www.mensxp.com/special-features/features/46352-10-terrifying-modern-day-torture-techniques-that-give-us-the-creeps.html
  3. https://www.google.com/amp/s/unbelievable-facts.com/2017/01/white-torture.html
  4. https://www.wikiwand.com/en/White_torture#/google_vignette
  5. https://www.google.com/amp/s/listverse.com/2013/10/19/10-gruesome-torture-devices-used-in-modern-times/amp/

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা