নিজের নাম বলার 'অপরাধে' যেখানে নারীদের নির্যাতিত হতে হয়!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
চলাফেরার স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতাসহ আমাদের কত অধিকারই তো হস্তক্ষেপ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু নিজের নাম প্রকাশ করার অধিকার হারানোর কথা কখনো ভাবতে পারেন কি?
দক্ষিন এশিয়ার ছোটখাটো দেশ আফগানিস্তান। আফগানিস্তানকে আমরা অনেকেই মোটামুটি ভালোভাবে চিনেছি আফগানিস্তান ক্রিকেট টীমের উত্থানের পর। রশিদ খানই হোক বা আফগান বিরিয়ানি... কোনো না কোনোভাবে আলোচনার চিমনি দিয়ে বাষ্প হয়ে আফগানিস্তান চলে আসে আমাদের মাঝখানে, মাঝেসাঝেই৷ সেই আফগানিস্তান সম্প্রতি আলোচিত হচ্ছে একটা মুভমেন্ট নিয়ে, যার নাম 'হোয়্যার ইজ মাই নেম' মুভমেন্ট।
ইন্টারেস্টিং নাম, তাই না? নামটা বেশ চটকদারও। কিন্তু এই মুভমেন্টের পেছনের ইতিহাসটা খুব বেশি চটকদার না। বরং গ্লানিকর এক সংস্কৃতির কথাই উঠে আসবে এই মুভমেন্ট নিয়ে কথা বলতে গেলে।
আপনি, আমি, আমরা প্রতিদিনই নানা কারণে বঞ্চিত হই, আমাদের বাক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হয়, চলাফেরার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হয়, আমাদের অনুভূতি আহত হয়, আমাদের অধিকার প্রবঞ্চিত হয়। কিন্তু কখনো কি আমাদের নাম প্রকাশের অধিকারের ওপরে হস্তক্ষেপ করা হয়? কখনো কি আমাদের বলা হয়- আপনি আপনার নাম প্রকাশ করতে পারবেন না? এমন কথা শুনেছেন কখনও? কিন্তু এই বিষয়টিই খুব স্বাভাবিক ঘটনা আফগানিস্তানের নারীদের জন্যে। নড়েচড়ে বসছেন? তা বসুন। মূল প্রসঙ্গে ঢুকছি এখন।
পৃথিবীর অনেক দেশেই নারীদের রাখা হয় কোনঠাসা করে৷ বৈষম্যের এ পৃথিবীতে হরেক রকম বৈষম্যের মধ্যে সবচেয়ে প্রকট হচ্ছে লিঙ্গ-বৈষম্য। বাংলাদেশ বলি বা আফগানিস্তান, কাঁটাতার পেরিয়ে রকমফের খুব একটা দেখা যায় না। তবুও আফগানিস্তানের এই বৈষম্যের সংস্কৃতি যেন এককাঠি বেশি নির্মম। সে দেশে যে নারীরা কখনো চাঁদ বা সূর্যও দেখেনি, যে নারীদের কন্ঠ অন্য কেউ শুনেনি কখনও, তাদেরই আদর্শ ও সতী নারী ধরা হয়। এই বাড়াবাড়ি রকমের রক্ষনশীলতা শরীর, কাজকর্ম থেকে শুরু করে সংক্রমিত হয়ে চলে যায় নাম পর্যন্ত।
সে দেশে একটা কন্যাসন্তানের জন্মের পর বহুবছর চলে যায় তার নামকরণ করতে, পরিবার নাম নিয়ে গড়িমসি করে। ধীরে ধীরে নামকরণ এবং সে নাম বাইরে প্রকাশ করা পরিণত হয় ট্যাবুতে। আফগানিস্তানে ঘরের বোন, কন্যা বা স্ত্রীকে বাইরে পরিচয় দেয়া হয় অমুকের বোন, অমুকের কন্যা বা অমুকের স্ত্রী নামে৷ পরিবারের পুরুষের নামের সাথে সম্পর্ক মিশিয়ে তাদের নাম প্রকাশ করতে হয়। তাছাড়া আফগান আইন অনুযায়ী শিশুর জন্ম সনদে শুধু বাবার নাম নথিভূক্ত করার বিধান আছে। মায়ের নামও সেখানে আসে না। এভাবেই ব্রাত্য হয়ে যায় তাদের নাম ধীরে ধীরে। অনেক আফগান মানুষ আছেন যারা তাদের মায়ের নামও ঠিকঠাক জানেন না।
এরকম সংস্কার প্রাচীন আমলের মহিলারা মেনে নিলেও এখন সংস্কৃতি আর সেরকমটা নেই মোটেও। মানুষ এখন অনেকটাই স্বাধীনচেতা, অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু ধর্মের দোহাই দিয়ে, সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে আফগানিস্তানের এই 'বর্বর সংস্কৃতি' এখনো টিকে আছে আগের মতোই। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের দিকে 'হোয়্যার ইজ মাই নেম' আন্দোলন শুরু করেন আফগানিস্তানের হেরাতের বাসিন্দা লালেহ ওসমানী।
সোশ্যাল মিডিয়ায় #whereismyname হ্যাশট্যাগ দিয়ে শুরু হয় এ আন্দোলন, এতে যোগ দেন আরো কিছু স্বাধীনচেতা নারী। নিজের নাম স্বাধীনভাবে বলার অধিকার তো তারা চাইছেনই, সে সাথে আফগানিস্তানের বিতর্কিত 'সতীত্ব পরীক্ষা' পদ্ধতিরও বিলোপ চান তারা। তারা চাচ্ছেন আইন পরিবর্তন হোক, সন্তানদের জন্ম সনদ এবং পরিচয়পত্রে বাবার নামের পাশাপাশি মায়ের নামও থাকুক।
অনেক মানুষ এই আন্দোলনকে সমর্থন দিয়েছে। সংসদ সদস্য, সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে শুরু করে শিল্প-সংস্কৃতি জগতের মানুষও সামিল হয়েছেন এই আন্দোলনে।
তবে এই আন্দোলন শুরুর পর অনেক আফগান জনগন বলেছেন- এটা তাদের সংস্কৃতির উপর একটা কালো থাবা৷ এই আন্দোলনকে তীব্র তিরস্কারও করেন তারা৷ তারা বলেন, ঘরের মহিলাদের মাথার কাপড়ের মতন, তাদের নামও পবিত্র। এগুলো বাইরে আনা মানে তাদের অসম্মান করা। তাই তারা চান না, এরকম আন্দোলন সফলতা পাক। অনেকে তো এই আন্দোলনকে পশ্চিমা বিশ্বের ষড়যন্ত্র বলেও মনে করেন।
পুরুষতান্ত্রিক আফগান সমাজে এরকম বিরোধ আসবে, এটাই স্বাভাবিক ছিলো। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, কিছু আফগান মহিলাও মনে করেন, নিজের নাম বাইরে প্রকাশ করা অসম্মানজনক। তারা নিজেরাও এই মুভমেন্টের তীব্র বিরোধীতা করেন। অনেক বছর ধরে শৃঙখলে আবদ্ধ থাকার কারণে তাদের মানসিকতাও যে অনেকাংশে পরনির্ভরশীল হয়ে গিয়েছে, এ বিষয়টি হয়তো তার স্বপক্ষেই সাক্ষ্য দেয়।
যাই হোক, ২০১৭ সালে শুরু হওয়া এই 'হোয়ার ইজ মাই নেম' আন্দোলন স্তিমিত হয়ে গিয়েছিলো কিছুদিনের মধ্যেই। #MeToo আন্দোলনের মতো বৈশ্বিকভাবে এতটা ধাক্কা দিতে পারেনি এই আন্দোলন। তবে সম্প্রতি এই আন্দোলন আবার জোরেসোরে শুরু হয়েছে।
কিছুদিন আগে আফগানিস্তানের এক মহিলা করোনা ভাইরাস পরীক্ষা করার জন্যে ডাক্তারের কাছে যান। সেখানে তিনি নিজের নাম বলেন ডাক্তারকে। ডাক্তার প্রেসক্রিপশন লিখে দেন। এই প্রেসক্রিপশন দেখেন সেই মহিলার স্বামী। বাইরের মানুষের কাছে নিজের নাম প্রকাশ করায় স্বামী মহিলাটির উপর ক্ষুব্ধ হন এবং বেধড়ক মারধোর করেন। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে এই ঘটনা ভাইরাল হয় এবং এরপরেই 'where is my name' মুভমেন্ট ক্রমশ আবার শুরু হয়।
বাংলাদেশেও লিঙ্গ-বৈষম্য এখনো বেশ প্রকট। সেটা ঘরেই হোক আর বাইরেই হোক, নারীরা সেভাবে এখনো স্বাবলম্বী হতে পারেননি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সবসময়ই একটা অদৃশ্য গণ্ডি তাদের চারপাশে ঘুরপাক খায়। তবে তুলনা করলে আফগানিস্তানের মতো এতটাও কট্টরপন্থী নন এদেশের মানুষ।
এদেশের মেয়েরা নিজের নাম প্রকাশ করতে পারেন, কোনোরকম চিন্তাভাবনা ছাড়াই। সেই প্রেক্ষাপটে এই লেখাটি হয়তো এ দেশে ততটা প্রাসঙ্গিক না। তবুও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে যদি ভাবি, তাহলে লিঙ্গ বৈষম্যের এই ঘৃণ্য নিদর্শন একটু বিক্ষুব্ধ করবেই আমাদের। তাছাড়া এদেশেও এখনো অজস্র পরিবার রয়ে গিয়েছে যেখানে নারীরা পরিবারের অনুমতি ছাড়া একটি শব্দ বলারও স্বাধীনতা পান না। সে হিসেব করলে এই আন্দোলন আমাদের দেশের জন্যেও প্রাসঙ্গিক।
আফগানিস্তানের এই বর্বর প্রথার অবসান কামনা করি এবং এই আন্দোলনের সাফল্য কামনা করি৷ একটা সুস্থ, স্বাভাবিক, স্বাস্থ্যকর সমাজ কামনা করি, পুরো বিশ্বের জন্যেই। তাতেই সবার মঙ্গল।
-
* প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন
* সমাজের নানান অসঙ্গতি নিয়ে আওয়াজ তুলুন। অংশ নিন আমাদের মিছিলে। যোগ দিন 'এগিয়ে চলো বাংলাদেশ' ফেসবুক গ্রুপে
আরও পড়ুন-