'তোমরা একবার ভেবে দেখো তো, আমরা আগেই ভাল ছিলাম কিনা?'
মুনিরা চৌধুরি: “বিয়ে”- ছোট্ট একটি শব্দ। কিন্তু এর গভীরতা ব্যপ্তি কতটা প্রসার তা বোধহয় মানুষ মাত্রই জানে। প্রতিটা দেশে প্রতিটা সমাজে নিজেদের নিজস্বতা বা স্বকীয়তা রয়েছে। পুরো বিশ্বের কথা না হয় বাদই দেই, এই ছোট একটি দেশ বাংলাদেশের নানা জেলায় নানা মত নানা সংস্কৃতি ও আভিজাত্য রয়েছে। তবে বিবাহ প্রথাটা বা সংস্কৃতি বোধহয় বাংলাদেশের প্রতিটা জেলায় কমবেশী একই।
আজকের এই লেখাটার মূল উদ্দেশ্য- সম্প্রতি বেশ কিছু বৎসর ধরে দেখছি আমাদের সেই চিরচেনা বাঙ্গালী বিয়ের সৌন্দর্য্যতা ও স্বকীয়তা হারাচ্ছে বিদেশী সংস্কৃতির আগ্রাসনে। সেই কোমলতা, ভালবাসা আর বাঙ্গালী বর, বধুর সলজ্জ হাসি কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে! আজকাল বাঙ্গালী বিয়ের স্থান দখল করে নিয়েছে হিন্দী সিনেমা আর হিন্দী সিরিয়ালের দৃশ্যগুলো। বিয়ে বাড়িতে গেলে ভুল হয়- একি বাংলাদেশ, না বলিউডের কোন শুটিং স্পট!
কয়েক বৎসর ধরে বিদেশী সংস্কৃতি যেন জেঁকে বসেছে আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠানগুলোতে। হারিয়ে ফেলছি আমাদের নিজেদের বাঙ্গালীপনা। মানছি সময় পাল্টিয়েছে, কিন্তু তাই বলে হিন্দী বা উর্দু সংস্কৃতি কেন আমাদের সংস্কৃতি দখল করে নিবে? এই প্রজন্মের কাছে বিনীত অনুরোধ জানিয়ে আজ এই লেখা।
তোমরা একবার ভেবে দেখো তো, আমরা আগেই ভাল ছিলাম কিনা? যুগে যুগে আমরা দেখে আসছি বিয়ের অনুষ্ঠান মূলত চারটি। বর ও বধুর হলুদ, বিয়ে আর বৌভাত। এখন দেখছি আরও দুটো অনুষ্ঠান যোগ হয়েছে হিন্দী সিনেমার অনুকরণে- মেহেন্দী সন্ধ্যা আর ব্যাচেলার পার্টি! লাভ ম্যারেজ হোক বা সেটেল ম্যারেজ হোক, বিয়েটা হচ্ছে দুটো পরিবারের বন্ধন। দুটো অচেনা ছেলে মেয়ে যেমন কাছে আসে তেমনি দুটো পরিবারও নতুন আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হয়।
গত কয়েক বৎসরে আগেও দেখেছি বিয়েটা হয় পারিবারিক উৎসবমুখর ভাবে। অথচ কিছুদিন থেকে দেখছি বিয়ে বাড়িতে বর বধুই হোষ্ট আর সবাই গেষ্ট। দুপক্ষের আত্মীয় স্বজন কেউ কাউকে চেনে না। যে যার মতন সেজেগুজে যন্ত্রের মতন বিয়ে বাড়িতে যাচ্ছে, খাওয়া দাওয়া হচ্ছে আর একই ঢংয়ে ছবি তুলে যে যার বাসায় ফিরছে। এ যেন কোন রকমে দায়সাড়াভাবে কর্তব্য পালন।
এইসব বিয়েতে না আছে আন্তরিকতা, না আছে আনন্দ। আগে বিয়ে বাড়ি ছিল বাবা, চাচা, মামা, ভাইদের ব্যস্ততা। বর থাকত আড়ালে বা কিছুটা লজ্জা নিয়ে মুরুব্বীদের পিছনে ঘুর ঘুর করতো। মুরুব্বীরা সবকিছু ঠিক করতেন। ঘরের ভিতর মা, চাচী, মামী, বোন, ভাবীরা অন্দরমহল সামলাতেন। বউ তার বান্ধবীদের নিয়ে লজ্জাবনত দৃষ্টিতে ঘরেই থাকত। এই সময় মুরুব্বীরা কনেকে বলতেন এই কয়টা দিন ঘরে থাক আর রূপচর্চা কর। কনেও লেপ্টে থাকত মায়ের সাথে।
প্রতিটা কনের আলাদা একটা সৌন্দর্য থাকত। তখন দেখা যেত মেয়ে, মা নিকট আত্মীয়স্বজনরা আনন্দের মধ্যে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদত । আর এই কান্নাভেজা একটু লালাভ মুখগুলো ছিল অপূর্ব সুন্দর আর নিষ্পাপ। কোন বিউটিশিয়ান হাজার মেকাপ করলেও এই রূপের এই সহজতাটা ধরতে পারবে না!
প্রথম অনুষ্ঠানটি ছিল মেয়ের হলুদ। আহ, এই দিনটি কনে যখন হলুদ শাড়ী আর ফুলের গয়না আর হালকা মেকাপে মঞ্চে বসত তখন চোখটি জুড়িয়ে যেত। বউয়ের অধঃনমিত দৃষ্টি, কিছুটা ভয় কিছুটা বেদনা আর কিছুটা লজ্জা আর আনন্দ মেশানো মুখটির সৌর্ন্দয যুগ যুগ ধরে হৃদয়ে একেঁ আছে। হলুদের দিন দুই বাড়ীর আত্মীয়স্বজনদের হলুদ দেওয়া, মিষ্টি মুখ করা, একটু খুনসুটি আর হলুদের আনন্দে নিজেদের উদ্ভাসিত করে দুই বেয়াই বাড়ি জমজমাট করে রাখত। কে কতটা আপ্যায়ন করতে পারে, কোন পক্ষ কতটা বিনয়ী আর ভদ্র, তা নিয়ে চলত নীরব প্রতিযোগিতা। বাঙ্গালী পরিবারগুলোর আভিজাত্য ফুটে উঠত এই আতিয়েথতায়।
হলুদের দিন হয়ত হালকা গান বাজত অথবা পরিবারের আপনজনেরা গান গাইত। নিজেদের সংস্কৃতি ফুটে উঠত বউয়ের মঞ্চটি ঘিরে। বেশ কয়েক বৎসর আগেও দেখেছি বাড়ীর মেয়েরা ছেলেরা নিজেরা গান গাইতে গাইতে বাড়ীতে আলপনা আকঁছে, মাটির কলসি, কুলো বিভিন্ন রঙ্গে ডিজাইনে আঁকছে। বউ বা বরের বসার জায়গাটা নিজেরা সাজাচ্ছে। এর ফলে হত কি- প্রতিটা বিয়ে বাড়িতে আলাদা আলাদা স্বকীয়তা ছিল আর ছিল আন্তরিকতা।
দেশী সূতী হলুদ শাড়ী বা লাল শাড়ী মেয়েরা পড়ত সাথে হাতে মেহেন্দী ও কাঁচের চুড়ি আর চুলে তাজা ফুল। সাজগোজে কোন বাহুল্য ছিল না, ছিল চোখ জুড়ানো স্নিগ্ধতা। আর কনে আহা সেই লাজনম্র দৃষ্টি আর হলুদ লেপ্টানো মুখ কি যে সুন্দর। দুই বাড়ীর মুরব্বীদের দোয়া আর ভালবাসায় সৌরভ ছড়াত চারিদিক। মা, খালা, বাবা কিংবা ঘনিষ্ঠ জনেরা যখন কনেকে হলুদ দিত তখন দেখা যেত সবার চোখে পানি। মেয়ে শ্বশুড়বাড়ী চলে যাচ্ছে কি এক হারানোর বেদনা সবার অন্তর ছুঁয়ে যেত।
বরের হলুদের দিন কনের ভাই বোনদের নানা দুষ্টমি আর আপ্যায়ন ছিল অবধারিত। হলুদের পর কনে বা বরের চেহারায় অন্যরকম স্নিগ্ধতা দেখা যেত। বর্তমানে অধিকাংশ হলুদের অনুষ্ঠান দুই পক্ষের অনুষ্ঠান একসাথেই হচ্ছে। তাছাড়া বর্তমানে লাভ ম্যারেজই বেশী হচ্ছে । এর ফলে দেখা যাচ্ছে ছেলে আর মেয়ে দুজন দুজনকে চেনে। দুই পক্ষের আত্মীয়স্বজন কেও কাউকে তেমন করে চেনা জানা হচ্ছে না। কমিউনিটি সেন্টারে গেলে দেখা যায় দুইপক্ষের আমন্ত্রিত অতিথিরা যে যার আত্মীয়ের সাথে গল্প করছে। কে বরের আত্মীয় আর কে কনের আত্মীয় এর কোন হদিস নাই। বর ও কনে আছে ছবি তোলায় ব্যস্ত।
তীব্র আওয়াজে হিন্দী চটুল গান বাজছে, মঞ্চ কাপিয়ে বর, বধু আর তাদের বন্ধুবান্ধবরা নাচ গান করছে। মনে হয় হিন্দী সিরিয়ালের বাস্তব রূপ দেখছি। কোথায় বর, বধুর সলজ্জ হাসি আর মুরুব্বিদের সালাম করে দোয়া চাওয়া। ইদানিং তো আবার বউরা শাড়িও পরছে না, বিদেশী সংস্কৃতির অনুসরনে পোশাক পড়ছে। আর যন্ত্রনার ব্যাপার আমন্ত্রিত অতিথিদের উপর ড্রেস কোড চাপিয়ে দিচ্ছে। আরে তোমরা যদি হিন্দী সিনেমা বানাতে চাও তবে অতিথিদের ড্রেস কোড দিয়ে বিপাকে ফেলা কেন? অতিথিদের পোশাক পরিচ্ছদ উপহার হিসেবে দিলেই তো সমস্যা আর হয় না।
এখন হলুদ হয় কমিউনিটি সেন্টারে, সবাই সেজেগুজে মেহমান। বর আর কনের মা, খালা আর মামি, ফুপু,চাচিদের চেনার উপায় নেই কারন পার্লারে সেজে সবাই দেখতে একই রকম হয়ে যায়।
বিয়ে আর বউভাতেও একই অবস্থা। সেই বর ও কনের ফটো সেশন চলতেই থাকে। মঞ্চে আর বউ মুখ ঢেকে বসে না, বর, কনে নিজেরাই অতিথি আপ্যায়ন করছে। মুরুব্বিদের সালাম করা সে তো এখন অতীত ইতিহাস...
আগে বিদায় বেলায় কনে আর তার আত্মীয় স্বজনের কান্না দেখে বরের বাড়ীর মানুষজনও কাঁদত। আর এখন কনে আর বর তো হিন্দী সিনেমার অনুকরনে নানা ফটো সেশনের নানা ধাপে থাকে। তাদের সময় কই চারিপাশ দেখার? আর কান্না কাটি কনে করে কিভাবে, মেকাপ নষ্ট হয়ে যাবে না। মানছি সময় পাল্টাচ্ছে তাই বলে এত দ্রুত নিজেদের বাঙ্গালীপনা ছাড়তে হবে? মাত্র তো দুটো বা তিনটি দিন এই কয়েকটি দিন লাজনম্র বউ হলে ক্ষতি তো নেই কিছু।
একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে কত আনন্দ কত উত্তেজনা ছড়িয়ে থাকে অথচ এই যান্ত্রিক সভ্যতায় বিয়ের অনুষ্ঠানগুলো হয়ে দাড়িয়েছে বাড়তি ঝামেলায়।এখনকার বিয়েতে কে কত গয়না কিনল, কে কোথায় শপিং করল এর যেন এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। আমরা একবারও ভাবি না এই ধরনের অন্ধ অনুকরন আর প্রতিযোগিতা করে আমাদেরই ক্ষতি আমরাই করছি।
এইসব বিয়েতে হয়ত চোখ ধাধঁনো কিছু ছবি তোলা থাকবে কম্পিউটারের ডিস্কে বা ফেসবুকে। কিন্তু সেই ছবির প্রান হল সুখকর স্মৃতি। সেই স্মরনীয় স্মৃতিগুলোই থাকছে না বর্তমান বিয়ের অনুষ্ঠানগুলোতে। এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা আর বিদেশী সংস্কৃতির আগ্রাসনে আমরা হারিয়ে ফেলছি আমাদের ঐতিহ্য আর আনন্দ।
এই প্রজন্মের সব ছেলে মেয়েদের কাছে অনুরোধ- বিয়ের সেই পুরনো রীতিনীতির কাছে ফিরে এসো, দেখো ঠকবে না। হিন্দী চটুল গানের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে বোনের গলার সেই মিষ্টি গানগুলো। একবার শুনেই দেখো “লীলাবতী………..কি দিয়া সাজামু তোরে”, কিংবা “হলুদ বাট মেন্দী বাট” গানগুলো। এই যে শুনছো, আজকের তরুনী মেয়েটিকে বলছি, নিজেকে ক্যামেরার সামনে মডেলের মতন দাঁড় না করিয়ে মিষ্টি বউ হয়ে দেখ, সেই স্বাভাবিক ছবিগুলোই কত প্রানবন্ত আর কত সুন্দর হয়। তোমরা যদি নিজেদের সংস্কৃতি ভুলে যাও, তবে কিভাবে বাঁচিয়ে রাখব আমাদের স্বকীয়তা।
লেখিকা- মুনিরা চৌধুরি, উপদেষ্টা, প্রচেষ্টা ফাউন্ডেশন
শিক্ষিকা, বি,এম ল্যাবরেটরী স্কুল ধানমন্ডি, ঢাকা
ছবি কৃতজ্ঞতা- ChitroGolpo - চিত্রগল্প
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন