দেনমোহর ১ টাকায়ও হয়, ১ কোটি টাকায়ও হয়। যাকে বিয়ে করছেন, তার অর্থনৈতিক অবস্থা বুঝে এটা চাইতে হবে।

আসাদুজ্জামান জীবন: কয়েক বছর আগেও যৌতুক প্রথা এই দেশে প্রবলভাবে বিরাজমান ছিল। জীবন যাত্রার মানোন্নয়ন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, শিক্ষার প্রসার, সামাজিক সচেতনতা এবং আইনগত ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে এই টেন্ডেন্সি পুরোপুরি বিলুপ্ত না হলেও, যৌতুক প্রথার চর্চা কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। যৌতুক যেমন একজন কন্যা সন্তানের পিতার জন্য মানসিক চাপ সৃষ্টি করে, তেমনি বিয়ের সময় দেনমোহরও একজন পুরুষকে সেই একই ধরনের মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে নিয়ে যায়। 

দেনমোহর শব্দটা শুনতে যতটুকু শ্রুতিমধুর লাগে, যতটা সহজ মনে হয়, তার বাস্তবচিত্র ততোটা সহজ না। আজকাল বিয়ে করার সময় দেনমোহরের পরিমান নিয়ে সমাজে যে প্রতিযোগিতা চলতে দেখা যায়, এটা আমাদের মানসিকভাবে পিছিয়ে যাওয়ারই প্রতিচ্ছবি। একজন মেয়েকে বিয়ে করার সময় উচু মূল্য প্রদান করে তাকে ঘরে আনতে হবে, তার সাথে জীবন কাটাতে হবে, এই ব্যাপারটা সেই মেয়ের নিজস্বতাকে নষ্ট করে দেয়।

ধর্মীয় ভাবে যেহেতু দেনমোহর দেওয়াটা বাধ্যতামূলক, সেহেতু তার একটা লিমিটেশন থাকা উচিত। ২০ হাজার টাকা মাসিক বেতন প্রাপ্ত পুরুষকে যখন ৩০ লাখ টাকার দেনমোহরের শর্তে রাজি হয়ে বিয়ে করতে হয়, তখন এটা আর সহজ এবং সুন্দর থাকেনা। মেয়ের আত্মীয় স্বজনরা অনেকসময় বলে উঠে, এত সুন্দরী মেয়ে বিয়ে করবে আর দেনমোহর এত কম টাকা? আমরা কি টাকার বিনিময়ে সন্তানকে বিক্রি করে দিচ্ছি না? টাকা দিয়ে একটা মানুষকে কিনে ফেলা যায় কখনো? নাকি একজন মেয়েকে ভোগ করার জন্য একজন পুরুষকে তার মূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে?

আমি একজনকে বলতে শুনেছি, দেনমোহরের টাকার পরিমান বেশি হলে পুরুষ মানুষ যখন তখন ডিভোর্স দিয়ে চলে যেতে পারেনা। আমার একটা প্রশ্ন জন্মায়, যাকে বিয়ের আগে বিশ্বস্ত মনে হবে না, তার সাথে তুমি সারাজীবন কাটানোর সিদ্ধান্তই নাও কী করে? সংসার তো বাচ্চাদের খেলা না। সংসারের মূল স্তম্ভটা আসলে বিশ্বাস। এটুকু যার প্রতি জন্মায় না, তার সাথে এক জীবন কাটিয়ে দেওয়ার ডিসিশন নেওয়াটা বোকামি না? 

আমার এক বন্ধুকে দেখেছিলাম, ভালোবেসে বিয়ে করেছে। বিয়ের সময় দেনমোহর দিয়েছিলো ৫০ লাখ টাকা। নিজের প্রেমিকাকে খুশি করার জন্য ৫০ লাখ টাকা দেনমোহর দেওয়া যতটা সহজ ছিল, এই সিচুয়েশনটাকে ওভারকাম করা ততোটা সহজ হয়নি তার। একসময় তাদের সম্পর্কে ফাটল ধরে। বিয়েটা ডিভোর্সের দিকে চলে যায়। মেয়েও নাছোরবান্দা, এক টাকাও ছাড়বেনা। 

সম্পর্কে তো ফাটল ধরতেই পারে। জীবনে এত এত জটিলতা, এত এত মোড়, এত বিচ্ছিরি সব বিচ্ছিন্ন ঘটনার মাঝ দিয়ে পার হতে হয়, আর নানান কারনেই কাছের মানুষও দূরে চলে যায়। একসাথে থাকতে ভালো লাগছেনা কিংবা একসাথে আর থাকা যাচ্ছেনা, এসব ঘটনা থেকে মুক্তি পাওয়ার যে তেষ্টা জন্মায়, তা থেকে মানুষ চাইলেই মুক্তি পেতে পারেনা। দেনমোহরের দোহাই দিয়ে যে সম্পর্ক টিকে থাকে, সেটাকে আর সম্পর্ক বলা যায়না। 

বিবাহ বিচ্ছেদের পর দেনমোহরের একটা ভালো এমাউন্ট পাওয়া যায়, এটা সত্যি। তবে বিচ্ছেদের রিকভার কি টাকা দিয়ে সম্ভব? সম্পর্কটাই যদি না থাকে, টাকা দিয়ে কী হয়? আপনি বলতে পারেন- বিবাহ বিচ্ছেদের পর একটা মেয়ে সামাজিকভাবে এবং শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং তার বাকিজীবন কাটানোর ভরণপোষনের জন্য টাকাটা জরুরী। আমি বলি- এটাই মূলত নারীদের পিছিয়ে পড়ার প্রধান কারণ। দেনমোহরের টাকার উপর ডিপেন্ডেন্সী একটা মেয়ের পরনির্ভরশীলতারই প্রতিচ্ছবি।

আমি আমার এক মেয়ে বন্ধুকে চিনি; বিয়ের পর যখন তাদের বিচ্ছেদ হয়েছিলো, তখন ১০ লাখ টাকার দেনমোহর সে প্রত্যাখ্যান করেছিলো এবং একটা সোনার অলংকারও সে নিয়ে বের হয়নি। তার একটাই কথা, "সম্পর্কটা যেখানে বাঁচাতে পারিনি, সেখানে টাকা নিয়ে কী করবো? টাকা দিয়ে কি মানুষের শূন্যতা পূরণ হয় কখনো?" সে এটা করতে পেরেছিলো তার কারণ, সে আত্মনির্ভরশীল ছিল। তার অর্থনৈতিক পরনির্ভরশীলতা ছিলনা। 

এই যে নারীদের এগিয়ে যাওয়ার, বেঁচে থাকার যেই আত্মবিশ্বাস, এটা জন্মালে এসব টাকা পয়সার মেজারমেন্টের প্রয়োজন হয়না। টাকা দিয়ে স্ত্রীকে ঘরে আনার এই প্রথা একজন নারীকে বিক্রি করে দেওয়ার মতনই। দাম্পত্য জীবন যেহেতু দুজনই ভোগ করে, আনন্দ এবং দুঃখ যেহেতু একসাথেই ভাগ করে নিতে হয়, তাহলে এত এত দেনমোহরের প্রশ্নটাই আসবে কেন? যে সম্পর্ক টিকবে, সেটা এমনিতেই টিকবে। ভালোবাসায় টিকবে, বিশ্বাসে টিকবে। অর্থনৈতিক লেনদেনে যে সম্পর্ক টিকে থাকে, সেটা ব্যবসা হয়ে যায়। 

আপনি ধর্মীয় অনুশাসনে যদি দেনমোহর ধার্য করেনও, সেটা যাতে লাগামহীন না হয়ে যায়। আপনি যে পরিমান টাকা দিয়ে সংসার শুরু করতে পারবেন, সেটাই ধার্য করুন। আবেগ দিয়ে সবকিছু হয়না। আপনার দেনমোহরের পরিমান কম হওয়াতে যে বিয়ে করতে চাইবেনা, তাকে বিয়ে করার প্রয়োজন নেই। 

মনে রাখুন, পন্য নিয়ে সংসার হয়না। সংসার করতে দুজন মানুষের ইচ্ছাশক্তি এবং সহনশীলতা থাকতে হয়। সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখতে এপ্রিসিয়েশনের মানসিকতা থাকা লাগে। সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখতে বিশ্বাসের নির্ভরশীলতা জরুরী। আপনারা যারা দেনমোহর কম শুনে বিয়ে করতে রাজি হননা, কিংবা আপনার পরিবার আপনাকে বিয়ে দিতে রাজি হয় না, তারা মূলত মানসিক সীমাবদ্ধতায় ভুগছেন। এই মানসিক সীমাবদ্ধতা থেকে যেদিন আমরা বের হতে পারবো, সেদিনই আমাদের মুক্তি সম্ভব। 

দেনমোহর ১ টাকায়ও হয়, ১ কোটি টাকায়ও হয়। যাকে বিয়ে করছেন, তার অর্থনৈতিক অবস্থা বুঝে এটা চাইতে হবে। আর যদি টাকাই বড় হয়ে যায়, দাসত্বকে মেনে নিয়ে সারাজীবন কাটাতে চান, যদি বিচ্ছেদের ভয় নিয়েই জীবন শুরু করতে হয়, তাহলে সংসার থেকে দূরে থাকুন। নিজে নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখুন। অর্থনৈতিক মুক্তির স্বাদ গ্রহণ করুন। আত্মনির্ভরশীল হন। স্বনির্ভরতার উপর ভর দিয়ে বাঁচুন।

আপনি যখন স্বনির্ভর হবেন, তখন কোনো মানুষের হুটহাট চলে যাওয়াতেই আপনার পরনির্ভরশীল হতে হবেনা। যার সাথে থাকবোনা, তার টাকায়ও বাঁচবোনা। এটাই মুক্তি! এটাই স্বনির্ভরতা! 

১ টাকা দেনমোহর দিন। নিয়ম মানুন। পন্য হবেন না, পন্য বানাবেন না। সম্পর্ককে কখনো টাকায় পরিমাপ করা যায় না।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা