
আমরা আসলেই লজ্জিত, এবং ক্ষমাপ্রার্থী। ক্ষমার অযোগ্য একটা অপরাধ করার পরেও যে মানুষ এরকম বাজে অজুহাত দিতে পারে, তাকে সাংসদ নির্বাচিত করার জন্যে আমরা লজ্জিত।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী মোজাম্মেল হক বলেছেন, সাংবাদিকেরা যদি তার কাছে নিঃশর্তভাবে ক্ষমা না চায়, তাহলে তিনি মামলা করবেন তাদের বিপক্ষে। রাজাকারের ভুলভাল তালিকা প্রণয়নে ষাট কোটি টাকা খরচ হয়েছে, এমন খবরের প্রতিবাদ জানিয়ে মন্ত্রী বলেছেন রাজাকারের এই তালিকা করায় এক পয়সাও খরচ হয়নি। যে বা যারাই ষাট কোটি টাকার সংবাদ ছড়িয়েছে, তারা অবিলম্বে ক্ষমা না চাইলে তিনি ব্যবস্থা নেবেন। কিন্ত দেশের জন্যে জীবন বাজী রেখে যুদ্ধ করা কিছু দামাল যোদ্ধাকে যে তিনি এবং তার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা মিলে বিজয়ের মাসে 'রাজাকার' বানিয়ে দিলো, সেটার জন্যে তিনি নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে পদত্যাগ করবেন কীনা- এটা কিন্ত মন্ত্রীমশাই বললেন না।
অনেক ঘটা করে রাজাকারদের নাম প্রকাশ করা হলো বিজয় দিবসের আগের দিন। এই দেশটার জন্মলগ্নে যারা বাধা দিয়েছিল, হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল, তাদের নামধাম-পরিচয় প্রকাশিত হবে, এটা স্বাধীনতার সপক্ষের মানুষের দীর্ঘদিনের চাওয়া ছিল। কিন্ত সেই তালিকা যে এমন বিতর্কের সৃষ্টি করবে, এতটা অপেশাদারী আচরণ করবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়- সেটা ভাবা যায়নি।
অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করা মুক্তিযোদ্ধা তো বটেই, শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী, এমনকি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, যিনি নিজেও একজন মুক্তিযোদ্ধা- তার নামও এসেছে তালিকায়! যে মানুষটা হাজারো বাধা বিপত্তি সয়ে, হুমকি অগ্রাহ্য করে অসম্ভব একটা লড়াইতে শামিল ছিলেন গত কয়েকটা বছর ধরে, নিজামী, মুজাহিদ বা সাকাদের মতো রাজাকারদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার জন্যে যিনি দিনরাত এক করে খেটেছেন, নিজের নাম রাজাকারের তালিকায় দেখে সেই গোলাম আরিফ টিপুর অনুভূতি কেমন হয়েছিল, সেটা কি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী খোঁজ নিতে গিয়েছিলেন?

সেসব তো তিনি করেনইনি, উল্টো দায় এড়ানোর খেলায় মেতেছেন। প্রথমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঘাড়ে দোষ চাপাতে চাইলেন, বললেন, এই তালিকা নাকি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেয়া, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ে সেটা শুধু প্রকাশ করেছে! এরপরে বললেন, ভুলের পরিমাণ বেশি হলে তালিকা প্রত্যাহার হতে পারে। যে তালিকা প্রত্যাহার হবে, সেটা করার কী দরকার ছিল তাহলে? মুক্তিযুদ্ধ ব্যাপারটাকে ফাজলামির জায়গায় নামিয়ে না আনলে হতো না?
সরকারের একটা কাজে ভুল হবে, আর সেখানে বিএনপি জামাতের দোষ খোঁজা হবে না- এটা যেন আজকাল হতেই পারে না। মোজাম্মেল হকও সেই পথেই হাঁটলেন। বললেন, 'এমনও হতে পারে যে বিএনপি-জামাত জোট সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রাখা কাগজপত্র কারসাজি করে রাজাকারদের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার নাম লিখে রেখেছে...'
একাত্তর টিভিতে মোজাম্মেল হকের লাইভ ইন্টারভিউ দেখছিলাম, তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, মুক্তিযোদ্ধার নাম রাজাকারের তালিকায় আসায় সেই মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানহানী হলো কীনা- তিনি জবাব দিলেন, 'সম্মানহানী কেন হবে, তাদের তো সম্মান বৃদ্ধি পেয়েছে বরং! এখন সবাই জানবে যে তারা আসলে রাজাকার নন।' বাহ! এই না হলে বাংলাদেশের মন্ত্রী!

নিরপরাধ এবং সম্মানীত একটা মানুষকে আপনি চুরির অপবাদ দিয়ে জনসম্মুখে চড়-থাপ্পড় মেরে বসলেন। আর আসল চোর ধরা পড়ার পরে এসে বললেন যে চড় খাওয়া মানুষটা আসলে নিরপরাধ- তাতে কি ওই চড়ের অপমান বা যন্ত্রণাটা মুছে যাবে? আপনাদের এই গরু মেরে জুতা দানের বাহারি গল্প সবাই কপাৎ করে গিলে খাবে, এমন ধারণা আপনার কী করে হলো মাননীয় মন্ত্রী? আপনি নিজে একজন মুক্তিযোদ্ধা, আরেকজন মুক্তিযোদ্ধাকে অপমান করার পরেও আপনি এসব বখাট্য যুক্তি কী করে হাজির করেন?
আমরা আসলেই লজ্জিত, এবং ক্ষমাপ্রার্থী। ক্ষমার অযোগ্য একটা অপরাধ করার পরেও যে মানুষ এরকম বাজে অজুহাত দিতে পারে, তাকে সাংসদ নির্বাচিত করার জন্যে আমরা লজ্জিত। আমরা লজ্জিত এমন মানুষ আমাদের সবচেয়ে গৌরবের অর্জন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে মন্ত্রণালয়, সেটার মন্ত্রী হয়ে বসে আছেন! বিএনপি জামায়াতের আমলে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা তৈরি হয়েছে হাজার হাজার, কোন সন্দেহ নেই তাতে। কিন্ত তারা ক্ষমতা ছেড়েছে ২০০৬ সালে, আপনারা গত এগারো বছর ধরে সরকার চালাচ্ছেন, তারপরেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় ভুল থাকে কী করে?
রাজাকারের তালিকা বানানো আর সেটাকে প্রকাশ করার কাজগুলো যারা করেছে, তালিকা প্রণয়নের দায়িত্বভার যাদের ওপর ছিল, তারা কি ঘোড়ার ঘাস কেটেছেন? এটাকে ভুল বললেও তো ভুলের সংজ্ঞা পাল্টে ফেলতে হবে। তালিকাটা প্রকাশ্যে আনার আগে রিসার্চ করার দরকার মনে হলো না কারো? মনে হলো না, মাঠ পর্যায়ে একটু খোঁজ নেয়া উচিত? নিজেদের কৃতকর্ম ঢাকার জন্যে আর কতবার বিএনপি জামাতের সেই পুরনো ট্রাম্পকার্ড খেলবেন? আপনাদের কাণ্ডকীর্তি দেখে আমরাই লজ্জায় পড়ে যাই, আপনাদের লজ্জা হয় না?