বাটা সু কোম্পানীর চাকরি নিয়ে যে মানুষটা বাংলাদেশে এসেছিলেন, বর্বর পাকিস্তানীদের অকথ্য নির্যাতন তার হৃদয়কে ছুঁয়ে গেছে, সাধারণ মানুষের নিপীড়িত মন তাকেও বিদ্ধ করেছে। তাই উইলিয়াম এ এস ওডারল্যান্ড হয়ে গিয়েছিলেন আমাদেরই একজন...

মুক্তিযুদ্ধে ভীনদেশী বন্ধু’রা সহায়তা করেছেন এমন সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। তাদের মধ্যে ডব্লিউ এ এস ওডারল্যান্ডকে আলাদা ভাবে উল্লেখ করার কারণ হচ্ছে, তিনিই একমাত্র বিদেশি মুক্তিযোদ্ধা যিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার কারণে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত হয়েছেন। মানুষটার পুরো নাম উইলিয়াম আব্রাহাম সাইমন ওডারল্যান্ড। ১৯১৭ সালের এক শুভ দিনে তিনি জন্মেছিলেন নেদারল্যান্ডের রাজধানী আমস্টারডামে। যদিও তার পিতৃভূমি অস্ট্রেলিয়ায়।     

সংগ্রামই তার জীবন 

জীবনযুদ্ধে প্রচন্ডরকম সংগ্রামী ছিলেন ওডারল্যান্ড। তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিলো না। মাত্র ১৭ বছর বয়সেই জীবনের প্রয়োজনে তাকে কাজ নিতে হয়েছিলো জুতার দোকানে। জুতার দোকানে তার কাজ ছিলো মানুষের জুতা পালিশ করে দেওয়া। জুতা পালিশের কাজ খুব আনন্দদায়ক হবার কথা না। তবুও তাকে এই কাজটি করতে হয়েছিলো সময়ের তাগিদেই। বাটা স্যু কোম্পানিতে তার চাকরি হয়েছিলো। চাকরিটা অবশ্য বেশিদিন করেননি। ছেড়ে দিয়েছিলেন। 

রক্তেই ছিল যোদ্ধা মনোভাব 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন উইলিয়াম ওডারল্যান্ড। বাটা স্যু কোম্পানির চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পর তিনি নেদারল্যান্ডের ন্যাশনাল সার্ভিসে যোগ দিয়েছিলেন। পরে রয়েল সিগনাল কোরে সার্জেন্ট পদে যুক্ত হন। সেখানে তার দলটিতে ৩৬ জন সদস্য ছিলো। কিন্তু জার্মানি দ্বারা নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম, ফ্রান্স দখল হয়ে যায়। ফলে, এসব দেশের পক্ষে যারা ছিলো তাদের গ্রেফতার হতে হয় তৎকালীন সময়ে। ওডারল্যান্ডও বাদ গেলেন না। তাকেও গ্রেফতার করা হলো। কিন্তু, ওডারল্যান্ড একটু ভিন্ন ধাতুতে গড়া। তাই জেল থেকে তিনি পালিয়ে বেরিয়ে যেতে সক্ষম হন। তার একটি সুবিধা ছিলো তিনি জার্মান ও ডাচ দুইটি ভাষাতেই অসাধারণ দঃক্ষ ছিলেন। ফলে এই ভাষাগত সুবিধা কাজে লাগিয়ে তিনি ডাচ আন্ডারগ্রাউন্ড রেজিসট্যান্স মুভমেন্টের হয়ে গুপ্তচর হিসেবে কাজ করেন। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট, জার্মানদের নৃশংসতা, বন্দিশিবিরে অবর্ণনীয় কষ্ট প্রভৃতি ঔডারল্যান্ডকে সাহসী, প্রতিবাদী ও মানবতাবাদী করে। তাই পরে আবার সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়ে জার্মানদের বিরুদ্ধে অসমসাহস ও বীরত্ব প্রদর্শন করেন। বাংলাদেশের তার আগমন যুদ্ধ বিগ্রহ শেষে ওডারল্যান্ড তার পুরানো কাজে আবার মনযোগী হলেন। বাটা স্যু কোম্পানির চাকুরিতে তার প্রমোশন হচ্ছিলো ভালোই। বাংলাদেশে তার আগমনও বাটা স্যু কোম্পানির কল্যাণে। এই কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে ১৯৭০ সালের শেষ দিকে তিনি নেদারল্যান্ড থেকে ঢাকায় আসেন। 

উইলিয়াম এ এস ওডারল্যান্ড

যেখানে যখন যা কিছু করেছেন ওডারল্যান্ড সব কিছু মন দিয়েই করেছেন। বাটা কোম্পানিতে অল্প দিনে তিনি নির্বাহী পরিচালক পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৭১ সালের ৫ মার্চ। মেঘনা টেক্সটাইল মিলের সামনে শ্রমিক-জনতার মিছিল চলছে। মিছিলে ইপিআর-এর সদস্যরা শ্রমিক জনতার উপর গুলি চালালো। এই ঘটনা খুব কাছ থেকে দেখলেন ওডারল্যান্ড। দেখলেন কিভাবে বাঙ্গালির দাবিগুলো নিগৃহীত হয়। কাছ থেকে দেখলেন মার্চের গণ আন্দোলন। দেখলেন ভয়াল ২৫ মার্চের অপারেশন সার্চলাইট। মানুষকে কিভাবে রাতের অন্ধকারে আচমকা আঘাত করা হলো, কিভাবে গনহত্যা চালানো হলো সব কিছুই তিনি প্রত্যক্ষ করলেন। 

পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর নির্বিচার হত্যাকান্ড ও নৃশংস বর্বরতা দেখে উইলিয়াম ওডারল্যান্ড ভীষণ ভাবে মর্মাহত হন। তিনি নিজে একজন যোদ্ধা ছিলেন। নিজে সংগ্রাম করেছেন, দেখেছেন জার্মানদের অত্যাচার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘটনাগুলো তার মনে পড়লো। তিনি বুঝতে পারলেন বাংলাদেশের এই মুহূর্তে সাহায্য দরকার। ১৯৭১ সাল তাকে যেনো ফিরিয়ে নিয়ে গেলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই দিনগুলিতে। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করবেন, অংশ নেবেন মুক্তিযুদ্ধে। 

স্বাধীনতা যুদ্ধ ও একজন ওডারল্যান্ড 

একাত্তরে তার বয়স ৫৪। এই বয়সে এসেও যৌবনের ন্যায় তার রক্ত মানবতার পক্ষে দাঁড়াতে চাইলো। তিনি মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে তার যতরকম অভিজ্ঞতা আছে সব কিছু সাহায্য করতে শুরু করলেন। টঙ্গীতে ছিলো বাটা স্যু কোম্পানির কারখানা। ওডারল্যান্ড এই বাণিজ্যিক কারখানাকে মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজনে কাজে লাগালেন। টঙ্গীর এই জুতার কারখানার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য স্থাপন করলেন একটি গোপন ক্যাম্প। মুক্তিযোদ্ধারা এই কারখানাতে থাকতো, রণকৌশল সাজাতো। তাদের খাওয়া দাওয়া, প্রশিক্ষণ, অস্ত্র সংগ্রহ, আর্থিক সাহায্য থেকে শুরু করে সবকিছুতেই নিজে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করেছেন ওডারল্যান্ড। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গেরিলা কম্যান্ডো হিসেবে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতাগুলো তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে ভাগাভাগি করতেন। তাদেরকে বিভিন্ন কৌশল সম্পর্কে জানাতেন। মুক্তিযোদ্ধারা এখান থেকে বিভিন্ন গেরিলা অপারেশন করতে থাকেন। 

শত্রুমুক্ত করার জন্যে শত্রুর ঘরেই গুপ্তচরবৃত্তি 

বাটা স্যু কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হওয়ায় যেকোনো জায়গায় যাওয়ার অবাধ সুযোগ তার ছিল। তিনি সে সুযোগকে কাজে লাগাতে চাইলেন। গুপ্তচরের কাজ তিনি যৌবনেও করেছেন নিজ দেশের পক্ষে। এবার বাংলাদেশের জন্যও এই কাজ করবেন চিন্তা করলেন। কিন্তু একটু ভিন্ন ভাবে। 

প্রথমে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২২ বেলুচ রেজিমেন্টের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান নেওয়াজের সঙ্গে তিনি খাতির জমান। ফলে ঢাকা সেনানিবাসে তার যাওয়া আসা শুরু হয়। ঢাকা সেনানিবাসে তিনি যোগাযোগ বাড়ালেন। নিজের গুণেই অল্প দিনে অনেকের সাথে পরিচিত হলেন। অনেকের সাথে ভালো সম্পর্ক হয়ে গেল তার। এক পর্যায়ে লেফট্যানেন্ট জেনারেল টিক্কা খান, পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফট্যানেন্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি সহ আরো অনেক সামরিক বেসামরিক কর্মকর্তাদের সাথে ঘনিষ্ঠতা করে ফেলেন ওডারল্যান্ড। তিনি এতটাই মিশে গিয়েছিলেন যে নিয়াজীর ইস্টার্ন কমান্ড হেডকোয়ার্টার তাঁকে “সম্মানিত অতিথি” হিসাবে সম্মানিত করে। 

স্মরণে ডাব্লিউ এ এস ওডারল্যান্ড

এই সুযোগে তিনি সব ধরনের “নিরাপত্তা ছাড়পত্র” সংগ্রহ করেন। এই ছাড়পত্র কাজে লাগিয়ে তিনি সব জায়গায় অবাধ প্রবেশ শুরু করলেন। এমনকি কারফিউ চলাকালীন সময়েও তিনি যেকোনো জায়গায় যেতে পারতেন। কেউ তাকে বাধা দেওয়ার ছিলো না। তার অবস্থান এমন ছিলো যে, সেনানিবাসে সামরিক অফিসারদের আলোচনা সভায় অংশগ্রহণেরও  সুযোগ পেতেন তিনি। এক পর্যায়ে তিনি পাকিস্তানীদের গোপন সংবাদ সংগ্রহ করা শুরু করলেন। পাকিস্থানি সেনাদের পরিকল্পনাগুলো তিনি গোপনে প্রেরণ করতেন ২নং সেক্টর এর ক্যাপ্টেন এ. টি. এম. হায়দারের কাছে। 

স্বীকৃতি 

২ নং সেক্টরের ক্যাপ্টেন মেজর হায়দারের দেয়া এক সনদপত্রের সূত্রে জানা যায়, “ওডারল্যান্ড মুক্তিযুদ্ধে গণযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, পরামর্শ, নগদ অর্থ, চিকিৎসা সামগ্রী, গরম কাপড় এবং অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছেন।“ উইলিয়াম ওডারল্যান্ড ছিলেন অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ। তিনি তার নিজের যাবতীয় অভিজ্ঞতা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছেন। গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ, আর্থিক সহায়তা তো দিয়েছেনই তবে এর আগে যুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য যুদ্ধকালীন বিভিন্ন আলোকচিত্র গোপনে বিভিন্ন গণমাধ্যমের কাছে পাঠাতে থাকলেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরির পেছনে তিনি বিরাট অবদান রাখেন। 

কিন্তু পাকিস্তানী বাহিনীর বর্বরতা তাকে এতোটাই বেদনা দিয়েছে যে নিজেই জীবনের মায়া ত্যাগ করে সশস্ত্র যুদ্ধে নেমে পড়েন। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে নিয়ে টঙ্গী-ভৈরব রেললাইনের ব্রীজ, কালভার্ট ধ্বংস করে দিলেন। এর ফলে ওই অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে যায়। ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে বহু অপারেশন সংঘটিত হয় যার অনেকগুলোই ছিলো ওডারল্যান্ড এর পরিকল্পনায়। যুদ্ধকালীন সময়ে তিনি প্রধান সেনাপতি এম এ জি ওসমানীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে তার অবদানকে সম্মানিত করেছে বাংলাদেশ সরকার। তাকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। তিনিই একমাত্র বিদেশী যিনি মুক্তিযুদ্ধের জন্য এই খেতাব পেয়েছেন। 

১৯৯৮ সালের ৭ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা ও সনদপত্র বিতরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানে ওডারল্যান্ড আমন্ত্রিত ছিলেন। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি উপস্থিত হতে না পারলেও  বীর প্রতীক পদকের সম্মানী বাবদ তার প্রাপ্তি ১০,০০০/ টাকা মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টে দান করে দেন। 

১৯৭১ সালে পাকিস্তানীদের নির্যাতন কতটা ভয়াবহ ছিলো তা বোঝা যায় ওডারল্যান্ডের সাহসিকতায়। বর্বর পাকিস্তানীদের অকথ্য নির্যাতন একজন বিদেশির হৃদয়কে ছুঁয়ে গেছে, সাধারণ মানুষের নিপীড়িত মন তাকেও বিদ্ধ করেছে। তাকে পুড়িয়েছে কষ্টের চিত্রগুলো। ১৯৭১ সালে তাই ওডারল্যান্ড হয়ে গিয়েছিলেন আমাদেরই একজন। দেশ কাল পাত্রের উর্ধ্বে গিয়ে তিনি পক্ষ নিয়েছিলেন মানবতার। মানবতার এই সৈনিকের গল্পের সামনে যুগে যুগে লজ্জায় কুঁকড়ে মরে কাপুরুষ রাজাকারেরা... 

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা