নিম্ন মধ্যবিত্ত এক পরিবার থেকে উঠে এসে তিনি বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তিতে পরিণত করেছেন নিজেকে। তার পুরো জার্নিটা অসম্ভব রোমাঞ্চে ভরপুর, সব মিলিয়ে ভ্লাদিমির পুতিন নামের এই মানুষটা আসলে অনেক বেশি বর্ণময় এক চরিত্র, রহস্য মানব বললেও ভুল হবে না তাকে...

২০১৪ সালে বিবিসিতে প্রকাশিত হওয়া একটা কলামের কথা খুব মনে পড়ছে। রাশিয়াজুড়ে তখন ভ্লাদিমির পুতিনের জনপ্রিয়তা, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ক্ষমতার প্রদর্শন তিনি করে চলেছেন, বা বলা চলে শুরু করেছেন। তখন থেকে ঠিক দুই বছর পরেই ক্রেমলিনে পুতিনের মেয়াদকাল শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। তবে বিবিসির সেই প্রতিবেদক খুব আস্থার সাথেই দাবী করেছিলেন, পুতিন এত সহজে ক্ষমতা ছাড়ার লোক নন। নিশ্চয়ই তার হাতে প্ল্যান-বি বলে কিছু একটা আছে, সময় হলেই সেটা রাশিয়ার মানুষ দেখবে, দেখবে বিশ্ববাসীও। 

সেই প্রতিবেদক যে বড়সড় একটা স্যালুট ডিজার্ভ করেন, তাতে কোন সন্দেহ নেই। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে পুতিন নিজের আসন আরও সুসংহত করেছেন। রাশিয়ায় তার বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছে, সেসবকে পাত্তা না দিয়ে তিনি ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছেন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পদটাকে অনেকটা নিজের ব্যাক্তিগত সম্পত্তি বানিয়ে ফেলেছেন পুতিন, নিজে যাতে দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে পারেন, সেজন্যে পরিবর্তন করেছেন শতবর্ষের পুরনো সংবিধানও, বাতিল করেছেন টানা দুইবারের বেশি কারো প্রেসিডেন্ট পদে থাকতে না পারার নিয়মটা! ধারণা করা হচ্ছে, আমৃত্যু রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট থাকবেন পুতিন। তিনি জীবিত থাকা অবস্থায় এই চেয়ারে অন্য কেউ বসার সাহস পাবেন কিনা, এটাও অবশ্য একটা বড় প্রশ্ন! 

নিম্ন মধ্যবিত্ত এক পরিবার থেকে উঠে এসে তিনি বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তিতে পরিণত করেছেন নিজেকে। পুরো জার্নিতে তার মাথার ওপর 'মেন্টর' বা রাজনৈতিক গুরু টাইপের কেউ ছিল না। তিনি লড়েছেন, লড়তে লড়তে শিখেছেন, সেই শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে ওপরের সিঁড়ি ভেঙেছেন। নিজ দেশে গণমাধ্যমের অধিকার কুক্ষিগত করা থেকে ক্রিমিয়ায় আক্রমণ বা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভূমিকা রাখা থেকে শুরু করে রাশিয়ার নিউ জারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া- সবকিছু মিলিয়ে ভ্লাদিমির পুতিন নামের এই মানুষটা আসলে অনেক বেশি বর্ণময় এক চরিত্র, রহস্য মানব বললেও ভুল হবে না তাকে। 

ভ্লাদিমির পুতিন, যাকে রহস্যমানব বললেও ভুল হবে না

জন্ম ১৯৫২ সালে, লেলিনগ্রাদে, এখন যে জায়গাটাকে সবাই সেন্ট পিটার্সবার্গ নামে চেনে। শৈশবটা খুব বেশি আনন্দময় ছিল না, তাকে লড়তে হয়েছে অভাবের সঙ্গে। পুতিন যে সময়টাতে বেড়ে উটেছেন, রশিয়ায় তখন কেজিবি এজেন্টদের প্রচণ্ড সম্মানের চোখে দেখা হতো। তারা দেশের জন্য পরিচয় গোপন করে কাজ করেন, প্রাণের ঝুঁকি নেন অকাতরে, একেকজন এজেন্ট তখন জাতীয় বীর। আরও অজস্র শিশুর মতো পুতিনেরও স্বপ্ন ছিল, তিনি বড় হয়ে কেজিবিতে যোগ দেবেন। আইন শাস্ত্রে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়ে কেজিবিতে ভর্তি পরীক্ষা দিলেন, সিলেক্টও হলেন। রোমাঞ্চকর এক জীবনের প্রত্যাশায় পুতিন যোগ দিলেন সিক্রেট সার্ভিস এজেন্ট হিসেবে। 

১৯৮৫ সালে রাশিয়া থেকে তাকে বদলি করা হয় পূর্ব জার্মানিতে। স্নায়ু যুদ্ধের অস্থির সময়টায় তিনি তৎকালীন পূর্ব জার্মানিতে কেজিবির গোয়েন্দা হিসেবে কাজ করেন। জার্মানির ডেসড্রেনে তিনি ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। চোখের সামনে কমিউনিস্ট ভাবধারার রাষ্ট্র পূর্ব জার্মানীকে ভেঙে পশ্চিম জার্মানীর সাথে একাত্ম হয়ে যেতে দেখেছেন তিনি। বার্লিন দেয়াল যেদিন ভেঙে পড়লো, সেদিন পুতিনের মতো কষ্ট খুব কম মানুষই পেয়েছিলেন। আরেক কষ্ট তিনি পেয়েছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পরে, যেটাকে তিনি উল্লেখ করেছেন বিংশ শতাব্দীতে ঘটা সবচেয়ে অনভিপ্রেত এবং হৃদয়বিদারক ঘটনা হিসেবে। 

১৯৯৭ সাল, বরিস ইয়েলেৎসিন তখন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট। পুতিনের ডাক পড়লো ক্রেমলিনে, প্রেসিডেন্টের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হলো পুতিনকে। এর মাঝের সময়টায় পুতিন ছিলেন লেলিনগ্রাদে, সেখানকার মেয়র আনাতোলি সোবচাকের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন পুতিন। তবে সময়ের পাকে সোবচাকের পতন ঘটলেও, পুতিন নিজের অবস্থান ঠিকই ধরে রাখতে পেরেছিলেন। ক্রেমলিনে আসার পরে বরিস ইয়েলেৎসিনের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা হলো পুতিনের। বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে পুতিনের সঙ্গে পরামর্শ করে নিতেন তিনি। আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং আইন শাস্ত্র সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকায় পুতিনও তাকে সাহায্য করতে পারতেন। 

পুতিন নিজের ক্ষমতাকে সুসংহত করেছেন ধীরে ধীরে

১৯৯৯ সালে সবাইকে অবাক করে দিয়ে পুতিনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিলেন ইয়েলেৎসিন। এভাবেই রাজনীতির ময়দানে আবির্ভাব হলো কেজিবি এজেন্ট পুতিনের, যার বাবা সামান্য বেতনে কাজ করতেন একটা কারখানায়, যার দাদা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বৃদ্ধ শরীর নিয়ে বাবুর্চির কাজ করে গেছেন, নইলে পরিবার চলবে না, এই কারণে। সেই পরিবার থেকে উঠে এসে ভ্লাদিমির পুতিন হয়ে গেলেন রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী! তবে চমকের আরও বাকি ছিল তখনও, সেবছরই প্রেসিডেন্টের পদ থেকে ইস্তফা দিলেন ইয়েলেৎসিন, দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন পুতিনকে! রাশিয়ার সর্বোচ্চ ক্ষমতাবান ব্যক্তি হয়ে উঠলেন পুতিন। পরের বছর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও জিতলেন, এবার আর ভারপ্রাপ্ত নয়, নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবেই দেশ শাসন শুরু করলেন। 

গত বিশ বছর ধরে রাশিয়ার রাষ্ট্রক্ষমতায় আছেন পুতিন, সুস্থ থাকলে আরও আট থেকে বারো বছর যে তিনিই থাকছেন, এটা নিশ্চিত। মাঝে চার বছর সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, তবে ক্ষমতার নাটাই ছিল তার হাতেই। এই কুড়ি বছরে পুতিন রাশিয়ার পুরনো ঐতিহ্য আর শক্তিমত্তা ফিরিয়ে আনার মিশনে প্রায় শতভাগ সফল বলা চলে। সোভিয়েত ইউনিয়নের মিলিত শক্তি যতটা ছিল, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাশিয়ার প্রভাব এখন তার চেয়ে কম নয় মোটেও। অনেকেই তাকে ডাকেন রাশিয়ার নতুন জার (শাসক) হিসেবে। লেলিন বা স্ট্যালিনের মতো কিংবদন্তী নেতাদের পাশাপাশি উচ্চারিত হয় পুতিনের নামটাও। 

ক্ষমতায় আরোহন করা থেকে আজ পর্যন্ত পুতিনের শাসনকাল বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, পুতিন বরাবরই ধীরে চলো নীতিতে এগিয়েছেন, শক্তি সঞ্চয় করেছেন, অস্ত্রের পরিবর্তে মাথা দিয়ে লড়তে চেয়েছেন তিনি। শুরুর সময়টায় তিনি পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেছেন, তাদের সমর্থন দিয়েছেন, সমর্থন আদায় করেও নিয়েছেন। পুতিন আগে ঘর গুছিয়েছেন, যখন নিশ্চিত হয়েছেন যে রাশিয়ায় তাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো কোন শক্তি নেই, তখন তিনি মনযোগ দিয়েছেন বাইরে। ক্রিমিয়া আক্রমণ হোক কিংবা সিরিয়ায় বাশার আল আসাদকে সমর্থন দিয়ে পুরো পরিস্থিতিটা ন্যাটো জোটের হাত থেকে ছিনিয়ে নেয়া- পুতিন বরাবরই মাস্টার স্ট্রোক সব চাল দিয়েছেন, বাজীমাত করে ধরাশায়ী করেছেন প্রতিপক্ষকে। 

অনেকের ধারণা, ট্রাম্পের ক্ষমতায় আসার পেছনে কলকাঠি নেড়েছেন পুতিন

ছোটবেলায় পুতিন একবার খেলতে গিয়ে মারামারিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন, তার সাথীরা তাকে বেদম পিটিয়েছিল সেদিন। সেই বিকেলেই পুতিন একটা শিক্ষা পেয়েছিলেন- 'লড়াই যদি অনিবার্য হয়, তাহলে অবশ্যই প্রথম আঘাতটা তোমাকেই করতে হবে!' এই শিক্ষাটা পুতিন তার রাজনৈতিক জীবনে কাজে লাগিয়েছেন দারুণভাবে। দুম করে কাউকে কিচ্ছু ইঙ্গিত না দিয়ে ক্রিমিয়া দখল করে তিনি সবাইকে হতভম্ভ করে দিয়েছেন, সেইসঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বকে বার্তা দিয়েছেন- রাশিয়া এখন যা খুশি করতে পারে, কারো ধার ধারে না! 

সিরিয়াতেও একই ব্যাপার ঘটেছে। পশ্চিমা জোট যখন একের পর এক আক্রমণ শাণিয়ে বাশার আল আসাদের বাহিনীকে কাবু করে এনেছে, বাশারের পরাজয় যখন সময়ের ব্যাপার মাত্র- তখনই আচমকা সেখানে নাক গলিয়েছেন পুতিন। সিরিয়ায় বাশার সরকার যে এখনও টিকে আছে বহাল তবিয়তে, সেটার একমাত্র কৃতিত্ব পুতিনের। তার কারণেই সিরিয়াতে বেদম মার খেয়েছে ন্যাটো জোট, সিরিয়ার সাধারণ মানুষও মরেছে অকাতরে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো অর্বাচীন নেতা যে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়ে গেলেন, তার পেছনেও অনেকে পুতিনের ভূমিকা দেখেন। পুতিন চাননি বিশ্বনেতা তার বিপরীতে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে শক্তপোক্ত কেউ থাকুক। নির্বাচনের ঠিক আগে আগে হিলারির ইমেইল স্ক্যান্ডাল ফাঁস করার পেছনে রাশিয়ার হাত ছিল- এটা তো খোদ সিআইএ গোয়েন্দারাই অভিযোগ করেছেন! 

সব মানুষের মধ্যেই ভালো-মন্দের মিশেলে দ্বৈত একটা স্বত্বা বাস করে। পুতিন কোন ফেরেশতা নন, তিনি মানুষ, তিনি ভুল করেন, অন্যায় করেন, তার সিদ্ধান্তের বলি হয়ে শত শত নিরীহ মানুষ প্রাণ হারায়। তবে সবকিছু একপাশে রেখে এটা বলতে কোন সমস্যা নেই যে, বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি এবং ধুরন্ধর রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে পুতিনের প্রতিপক্ষ এখন কেবল পুতিন নিজেই। সময় এখন পুতিনের- সেটা বললেও ভুল হবে না একটুও... ... 

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা