কেন মুরালিধরনের বায়োপিক থেকে সরে যেতে হলো অভিনেতা বিজয় সেথুপতিকে?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
বায়োপিক থেকে বিজয় সেথুপতিকে থেকে সরে যেতে বলেছেন স্বয়ং মুরালিধরনই! কারনটা কী? জানতে হলে ফিরে যেতে হবে শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের সময়টাতে, জানতে হবে তামিল জাতির ইতিহাস; যে ইতিহাসে মুরালিধরন একজন বেইমানের নাম...
পাঁচদিন আগে যখন ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী বোলার মুত্তিয়া মুরালিধরনের বায়োপিকের ফার্স্ট পোস্টার রিলিজ পেয়েছিল, তখন স্পষ্টতই দুইভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল নেটিজেনরা। একপাশে ছিল নিখাদ সিনেমাপ্রেমীরা, যারা মুরালির রোলে তামিল অভিনেতা বিজয় সেথুপতিকে দেখে মুগ্ধতা প্রকাশ করেছিলেন। করারই কথা, মুরালির অ্যাগ্রেশন, মুরালির স্টাইল- সবটাই যেন পোস্টারের ওই ছবিটায় ফুটে উঠেছিল বিজয় সেথুপতির মধ্যে। কিন্ত আফসোসের ব্যাপার হচ্ছে, বিজয় সেথুপতিকে এই সিনেমায় দেখা যাবে না। খোদ মুত্তিয়া মুরালিধরনই সেথুপতিকে অনুরোধ করেছেন, তিনি যেন এই সিনেমা থেকে সরে দাঁড়ান। কিন্ত কারনটা কী?
আপত্তির কারনটা মূলত ভারত ও শ্রীলঙ্কার তামিল জনগোষ্ঠী, মুরালিধরনের বায়োপিকে একজন তামিল নায়ক অভিনয় করবে- এতে তাদের আপত্তি ছিল। আবার শ্রীলঙ্কার যারা সিংহলিজ জনগন, তারাও আপত্তি তুলেছে যে, লঙ্কান কিংবদন্তীর চরিত্রে কেন শ্রীলঙ্কার বাইরের কেউ অভিনয় করবে? সিংহলিজদের আপত্তির কারনটা নাহয় বোঝা গেল, কিন্ত তামিলরা কেন আপত্তি করছে? এর ইতিহাস জানতে হলে আমাদেরকে একটু পেছনে হাঁটতে হবে, ফিরে যেতে হবে নব্বইয়ের দশকের উত্তাল শ্রীলঙ্কায়।
শ্রীলঙ্কায় মোটাদাগে দুই জাতির মানুষ বসবাস করে। এক হচ্ছে সিংহলিজ, এখন এরা দেশটাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ, রাষ্ট্রক্ষমতাও তাদের হাতেই। সরকার থেকে শুরু করে পুলিশ, প্রশাসন, আর্মি- সবকিছুই তারা নিয়ন্ত্রণ করে। তবে বছর ত্রিশেক আগেও তামিলরা সংখ্যাগুরু ছিল। পড়াশোনায় তারা এগিয়ে ছিল সিংহলিজদের চেয়ে। কিন্ত ক্ষমতায় থাকা সিংহলিজরা তাদের বঞ্চিত করছিল নানাভাবে, একাত্তরের আগে পশ্চিম পাকিস্তান যেমন আমাদের বঞ্চিত করতো। ভাষার ক্ষেত্রেও বঞ্চবার শিকার হয় তামিলরা, তাদের ভাষাকে দেশটির অফিসিয়াল ভাষা হিসেবে মর্যাদা দেয়া হয়নি। সরকারী চাকরি থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি- সব জায়গাতেই বাধার সম্মুখীন হতো তামিলরা, এমনকি তাদেরকে ঠেকানোর জন্য রিজার্ভেশন সিস্টেমও চালু করা হয়েছিল।
এই বঞ্চনা আর ক্ষোভ থেকেই তামিলরা বিদ্রোহ শুরু করে। জন্ম হয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন তামিল টাইগার্সের, তারা সরাসরি সংঘর্ষে লিপ্ত হয় শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনী এবং পুলিশের সঙ্গে, দেশজুড়ে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। তামিল টাইগারদের অস্ত্র এবং টাকা দিয়ে সাহায্য করতো ভারত সরকার, কারন দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু ছিল পুরোপুরি তামিল অধ্যুষিত একটা এলাকা, স্বভাবতই স্বজাতির প্রতি একটা টান ছিল তামিলনাড়ুর লোকজনের।
তামিল টাইগার্স গেরিলাদের মূখ্য উদ্দেশ্য ছিল উত্তর-পূর্ব অঞ্চলটাকে মূল ভূখন্ড থেকে আলাদা করে ফেলা। এখানে তামিলতা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেনাবাহিনীও এই এলাকায় অভিযান চালাতে ভয় পেতো। তামিল গেরিলাদের অভয়ারণ্য ছিল জায়গাটা। সেনা বা পুলিশ চৌকিতে আক্রমণ চালিয়ে গেরিলারা চলে আসতো এই এলাকায়, তাদের নাগাল পেতো না লঙ্কান সেনাবাহিনী। তখন শ্রীলঙ্কার নিরাপত্তা বাহিনী সেসব আক্রমণের শোধ তুলতে শুরু করলো নিরপরাধ তামিল জনগনের ওপর হামলা চালিয়ে। হাজার হাজার নিরীহ তামিল নাগরিক নিহত হলো শুধু ক্ষোভের বলি হয়ে।
এখানে মুত্তিয়া মুরালিধরনের ভূমিকাটা কি? তার প্রতি কেন তামিলদের ক্ষোভ? তিনি নিজেও তো একজন লঙ্কান তামিল, তাহলে তো তাকে নিয়ে বরং তামিলদের গর্বিত হবার কথা। অথচ শুনলে অবাক হবেন, মুরালিধরনকে বেশিরচাগ তামিলই মনেপ্রাণে ঘৃণা করে। কারন জাতীয়তায় একজন তামিল হয়ে, একজন বৈশ্বিক তারকা হয়েও তামিলদের ওপর চালানো গণহত্যার সময় মুরালিধরন চুপ ছিলেন, কোনদিন তামিলদের পক্ষে একটি কথাও বলেননি, করেননি সরকারের এই অন্যায়ের প্রতিবাদ। বরং মহিন্দ্রা রাজাপক্ষের সরকারকে সমর্থন দিয়েছিলেন তিনি, যার সময়ে তামিল গেরিলারা আত্মসমর্পণ করেছে, শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটেছে।
সেই সময় মুরালিধরন শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় তারকা, সরকারের বিরোধিতা করলে হয়তো দল থেকে বাদ পড়তেন, হয়তো গ্রেপ্তারও হতেন, নিজের ক্যারিয়ারের কথা ভেবে চুপ ছিলেন এই অফস্পিনার। তার সেই চুপ থাকাটা যে কি মারাত্মক ঘৃণার জন্ম দিয়েছে তামিল জনগনের মনে, সেটা টের পাওয়া যাচ্ছে এখন। যতোই তিনি সুপারস্টার হন, তামিলদের চোখে মুরালিধরন স্বজাতির সঙ্গে বেইমানী করা একজন ব্যক্তি ছাড়া আর কিছুই নন।
একারনেই মুরালিধরনের বায়পিকে তামিল অভিনেতা বিজয় সেথুপতির অভিনয় করার খবরে শ্রীলঙ্কা এবং ভারত- দুই জায়গার তামিলরাই ক্ষেপে উঠেছে। তাদের কথা হচ্ছে, একজন বেইমানের বায়পিকে কোন তামিল অভিনেতা অভিনয় করতে পারে না। যে লোক নিজে তামিল হয়েও লাখো নিরীহ তামিলের মৃত্যুতে একবার শোক জানানোর দরকার মনে করলো না, উল্টো সিংহলিজ সরকারের পক্ষ নিলো, তাকে তামিলরাও বর্জন করছে। আর সেকারনেই সেথুপতিকে হুমকি দেয়া হচ্ছিল অনবরত, তিনি যেন '৮০০' টাইটেলের এই সিনেমা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন।
সেথুপতিকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়নি। মুরালিধরন নিজেই এগিয়ে এসেছেন এই অচলাবস্থা কাটাতে। লিখিত স্টেটমেন্টে মুরালিধরন বলেছেন, কারো জাতিগত ভাবাবেগে তিনি আঘাত করতে চাননি। সেথুপতি অসাধারণ একজন অভিনেতা, তার ক্যারিয়ার অনেকদূর যাবে। কোন বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে তিনি যেন বাধাগ্রস্ত না হন, এজন্যে মুরালিধরন নিজেই সেথুপতিকে অনুরোধ করেছেন এই প্রোজেক্ট থেকে সরে যাওয়ার জন্য। সেথুপতিও মুরালিধরনের সেই স্টেটমেন্ট টুইটারে শেয়ার করে লিখেছেন- 'থ্যাংক ইউ এন্ড গুডবাই!'
মুরালিধরনের চরিত্রটাকে রূপালি পর্দায় যে সেথুপতির চেয়ে ভালোভাবে কেউ ফুটিয়ে তুলতে পারতেন না, এটা খোদ মুরালিই বিশ্বাস করেন। তার মতো ডেডিকেশানও খুব কম অভিনেতাই দেখাতে পারতেন। কিন্ত পরিস্থিতির কারনেই এখন সিনেমার নির্মাতাদের বিকল্প খুঁজতে হবে। কেউ কি ভেবেছিল, এভাবে চিত্রপট পাল্টে যাবে? মুরালিধরন নিজে কি ভেবেছিলেন, তার বায়পিকের বিরোধিতায় নামবেন তার স্বজাতির লোকজনই? ভেবে থাকুন আর না থাকুন, নিরপেক্ষ দর্শকেরা যে একটা মাস্টারপিস সিনেমা থেকে বঞ্চিত হলাম, সেটা নিশ্চিত...
তথ্যসূত্র কৃতজ্ঞতা- দ্য হিন্দু, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, মোশাররফ হোসেন জিতু।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন