বর্তমানে করোনাভাইরাস ওষুধ আবিষ্কারের চলমান রিসার্চগুলোর মাধ্যমে এইডসের মতো মরনঘাতি রোগের ওষুধও দূর্ঘটনাক্রমে আবিষ্কার হয়ে গেলেও অবাক হবার কিছুই থাকবে না!

নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে বিশ্বের স্বনামধন্য ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি ফাইজার এর সায়েন্টিস্টরা UK-92480 নামক একটি সম্ভাব্য নতুন ড্রাগ নিয়ে গবেষণা করেন। তারা আশা করছিলেন, এই ড্রাগটি এনজিনা নামের হার্টের একটি রোগে কাজ করবে। এনজিনা এমন একটি অবস্থা যেখানে হার্টে রক্ত সরবরাহকারী রক্তনালীগুলো সংকুচিত হয়ে আসে, ফলে বুকে ব্যথা এবং শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়।

UK-92480 ড্রাগটির কার্যকারিতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য সায়েন্টিস্টরা এটি বেশ কিছু পুরুষ এনজিনা রোগীদের (ট্রায়াল ভলান্টিয়ার) উপর প্রয়োগ করেন। এতে করে দেখা যায়, এই ওষুধটি বুকের ব্যথা তেমন একটা কমাতে ব্যর্থ হচ্ছে এবং বেশিরভাগ পুরুষই এমনটি রিপোর্ট দেয়া শুরু করেছেন। যখন রিপোর্টগুলি একটি স্বতন্ত্র প্যাটার্ন দেখাতে শুরু করলো, তখন ফাইজার ড্রাগটি নিয়ে আর গবেষণা না করার সিদ্ধান্ত নিল এবং গবেষণাকার্য থেকে বাদ দেয়ার দিকে এগিয়ে গেল।

এই যখন অবস্থা, ঠিক সেই সময় অনেক পুরুষ ট্রায়াল ভলান্টিয়ার একটি অস্বাভাবিক সাইড ইফেক্ট বা পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ার কথা সায়েন্টিস্টদের জানাতে শুরু করলেন। যার খাঁটি বাংলা হলো খাড়াকরণ বা পুরুষাঙ্গ খাড়াকরণ। আমরা ইংরেজিতে যাকে বলি Erection। UK-92480 ড্রাগটি হার্টের রক্তনালীগুলি আশানুরূপে প্রসারিত করে বুকের ব্যথা কমানোর পরিবর্তে, তাদের লিঙ্গগুলির রক্তনালীগুলি প্রাসারিত করে তাতে রক্তের সাপ্লাই বাড়িয়ে দেয় এবং খাড়াকরণ ঘটায়। ফলে তাদের পুরুষাঙ্গ দণ্ডায়মান হয়।

সিনিয়র ফাইজার বিজ্ঞানী ক্রিস ওয়ামেন নপুংসক পুরুষদের থেকে লিঙ্গের টিস্যু নমুনা সংগ্রহ করে নমুনাগুলির উপর ড্রাগটি পরীক্ষা করে কী ঘটছে তা তদন্ত শুরু করেন। এর প্রভাব ছিল নাটকীয়। যুক্তরাষ্ট্রের ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন ১৯৯৯ সালে UK-92480 ড্রাগটি ভায়াগ্রা নামে অনুমোদন করেছিল; এর আগে খাড়াকরণজনিত সমস্যায় কোন মুখে খাওয়ার ওষুধ ছিল না; কেবলমাত্র ছিল ইনজেকশন বা একটি সিন্থেটিক ইমপ্লান্ট। 

ভায়াগ্রা ছয় ঘন্টা পর্যন্ত কার্যকর বলে মনে করা হয়। তবে, যারা মনে করেন এই ড্রাগটি আকাঙ্ক্ষা জাগায়, তাদের জন্য সমবেদনা। এটি আকাঙ্ক্ষা জাগানোতে কোন কাজ করে না। বরং আপনি জাগ্রত বোধ করলে তা খাড়াকরণ এবং দণ্ডায়মান অবস্থা বজায় রাখতে সহায়তা করে।

ভায়াগ্রার পরবর্তী সাফল্য ওষুধের কিংবদন্তির উপাখ্যান। পরবর্তিতে ফাইজার কোম্পানি কর্ক নামের একটি কাউন্টির ছোট্ট গ্রাম রিঙ্গাস্কিডিতে অবস্থিত তাদের ফ্যাক্টরিতে ভায়াগ্রা তৈরি করে চলেছে। ওই গ্রামের স্থানীয়দের দ্বারা ওই গ্রামটিকে আদর করে ‘ভায়াগ্রা জলপ্রপাত’ বলে ডাকা হয়। গ্রামের মানুষগুলো মনে করে, বাতাসে ভায়াগ্রা ভেসে বেড়ানোর কারণে গ্রামবাসী আশ্চর্যজনক যৌন জীবন উপভোগ করে।

এভাবেই হার্টের ওষুধ আবিষ্কার করতে গিয়ে ভুলক্রমে বা দূর্ঘটনাক্রমে ইরেক্টাইল ডিস্ফাংশন কিংবা খাড়াকরণজনিত সমস্যার ওষুধ ভায়াগ্রা আবিষ্কার হয়ে যায়। আর এই ঘটনা কেবল একটা ওষুধের জন্যই নয়, এমন অনেক ওষুধ আছে যেগুলো দূর্ঘটনাক্রমেই আবিষ্কার হয়েছে। একে আমরা মেডিকেল সায়েন্সে Serendipity বলি, যার বাংলা অর্থ হলো, দূর্ঘটনাক্রমে সুখকর বা লাভজনক কোন কাজ বা ঘটনা সংঘটিত হওয়া।

এবার আসা যাক কোভিড-১৯ এর ওষুধ বা ভ্যাকসিন আবিষ্কারের বিষয় নিয়ে। কখনো খবর পাচ্ছি অনেক পুরাতন মেডিসিন হাড্রক্সিক্লোরোকুইন আর এযিথ্রোমাইসিন দিয়ে চিকিৎসা করলে এই রোগ দ্রুত সেরে যায়। আবার দেখছি, কালোজিরা নাকি এই রোগের চমৎকার উপশম। কখনো খবরে পাচ্ছি, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া কিংবা জার্মানী এরা নাকি করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন পেয়ে গেছেন। এখন ট্রায়াল চলছে। ট্রায়াল শেষে সফল হলেই অনুমোদনের জন্য এপ্লাই করা হবে। আর অনুমোদন পেয়ে গেলেই বাজারে চলে আসবে। এভাবে ভুল ঠিক রিসার্চ চলতেই থাকবে। এতে হতাশ হবার কিছুই নেই, বরং আশাহ্নিত হবারই কারণ রেয়েছে। সে পর্যন্ত আমাদের দুটা কাজ করতে হবে-

১. ধৈর্যের সাথে অপেক্ষা করতে হবে
২. ডাক্তার আর ফার্মাসিস্ট এর পরামর্শ ছাড়া সোশ্যাল মিডিয়াতে বিভিন্ন আর্টিকেল পড়েই ওষুধ খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।

শেষ কথা: HIV এর আক্রমণে AIDS হয়। এটিও একটি ভাইরাসজনিত অসুখ। বর্তমানে করোনাভাইরাস ওষুধ আবিষ্কারের চলমান রিসার্চগুলোর মাধ্যমে এইডসের মতো মরনঘাতি রোগের ওষুধও দূর্ঘটনাক্রমে আবিষ্কার হয়ে গেলেও অবাক হবার কিছুই থাকবে না!


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা