অঙ্কের হিসেব মেলাতে গিয়ে জীবনের হিসেবটাই ভুলে গিয়েছিলেন যিনি!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
মাত্র উনিশ বছর বয়সে পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করেছিলেন গণিতের এই বিস্ময়। সেই মানুষটাকেই গত চল্লিশ বছর ধরে 'বদ্ধ উন্মাদ' বানিয়ে রেখেছিল সবাই! দারিদ্র্যের কষাঘাতে ধুঁকে ধুঁকে তিনি মারা গিয়েছেন...
বলা হতো, গণিতে নোবেল পুরস্কার দেয়ার ব্যবস্থা থাকলে নাকি সবার আগে তিনিই সেটা পেতেন! মাত্র উনিশ বছর বয়সে পিএইচডি ডিগ্রী সম্পন্ন করেছিলেন মানুষটা, গণিতে তার অসামান্য প্রতিভা দেখে আমেরিকান এক প্রফেসর তাকে নিজ উদ্যোগে নিয়ে গিয়েছিলেন সেদেশে, ব্যবস্থা করে দিছিলেন উচ্চশিক্ষার। আজকে যে মানুষটার কথা বলবো, বশিষ্ট নারায়ণ সিং, তিনি গণিতের ওপর অনেকগুলো বই লিখেছেন, অজস্র ফর্মূলার উদ্ভাবন করেছেন। চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন আইনস্টাইনের থিওরিকেও। কিন্ত সেই বশিষ্ট নারায়ণ সিংই জীবনের শেষ দিনগুলো পার করেছেন মানবেতর অবস্ত্যহায়, একসময় নাসায় কাজ করা এই অসামান্য গণিতিবিদ বছরের পর বছর বেঁচে ছিলেন মানুষের টিটকারি আর অবহেলা সয়ে! ২০১৯ সালের ১৪ই নভেম্বর মৃত্যু হয়েছে তার, সেই মৃত্যুটা হয়তো জাগতিক কষ্টের বোঝা থেকে মুক্তিই দিয়েছে তাকে।
বিহারের রাজধানী পাটনা থেকে প্রায় ষাট কিলোমিটার দূরের শহর ভোজপুর, সেখানেই বসন্তপুর নামের একটা জায়গায় পৈতৃক বাড়িতে থাকতেন বশিষ্ট নারায়ণ সিং। মাস তিনেক আগে সেখানে গেলে দেখা মিলতো তার, কাঁচাপাক চুল-দাঁড়িতে ঢাকা চেহারা, ভাঙা গাল আর জরাজীর্ন শরীর সাক্ষী দিতো আর্থিক অনটনের। বাড়ির দোরগোড়ায় হোয়াইট বোর্ডে মার্কার দিয়ে কাউকে অঙ্কের সূত্র লিখতে দেখলেই বোঝা যেতো, ইনিই বশিষ্ট নারায়ণ চৌধুরী। তিনি কে, এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা হলে নিজের পরিচয় দিতেন আইআইটি কানপুরের প্রফেসর হিসেবে। সমস্যা হচ্ছে, যে পরিচয়টা তিনি দিতেন, সেটা আজ থেকে পঁয়তাল্লিশ বছর আগে দিলে ঠিক ছিল, ২০১৯ সালে সেটা বড্ড বেমানান লাগতো!
একদম শুরু থেকেই তবে বলি গল্পটা। নারায়ণ সিংয়ের জন্ম বিহারের বসন্তপুরে, ১৯৪২ সালে। একদম ছোটবেলা থেকেই পড়ালেখার প্রতি দারুণ আগ্রহ ছিল তার, বিশেষ করে অঙ্কের প্রতি ভালোবাসা ছিল দেখার মতো। অন্যান্য সহপাঠীরা যখন মাঠে খেলছে বা বাবা-মায়ের সঙ্গে কৃষিকাজ করছে, তখন তাকে দেখা যেতো খাতা-পেন্সিল নিয়ে গণিতের কঠিন কঠিন সমীকরন মেলাতে! ক্লাস ফাইভে থাকা অবস্থাতেই কলেজ লেভেলের গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে পারতেন তিনি, আর কলেজে যখন পা দিয়েছেন, ততদিনে অনার্স আর মাস্টার্স লেভেলের অঙ্কগুলো তার কাছে ডালভাত! \
তার এই দুর্দান্ত মেধার কথা ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগলো না। পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই বছরের অনার্স কোর্স তিনি শেষ করলেন এক বছরেরও কম সময়ে। মাত্র উনিশ বছর বয়সেই তিনি পিএইচডি শেষ করলেন! সেই সময়ে ভারতে সর্বকণিষ্ঠ পিএইচডি ডিগ্রিধারী ছিলেন তিনি। পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি যখন ছাত্র, তখন জন কেলি নামের এক আমেরিকান প্রফেসর সেখানে এসেছিলেন কয়েকটা লেকচার দিতে, কিছু রিসার্চের কাজও ছিল তার। সেসব রিসার্চে তাকে সাহায্য করেছিলেন নারায়ণ সিং। গণিতে তার দারুণ মেধার ব্যাপারটা নজর এড়ায়নি কেলির, দেশে গিয়েই তিনি নারায়ণকে আমেরিকা নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। নিজের বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ায় নারায়ণ সিঙের জন্যে বৃত্তির ব্যবস্থাও করে দিলেন তিনি।
তল্পিতল্পা গুটিয়ে আমেরিকায় চলে গেলেন বশিষ্ট নারায়ণ সিং। আমেরিকায় গিয়ে সাইকেল ভেক্টর স্পেস থিওরির ওপরে আরেকটা পিএইচডি ডিগ্রি নিলেন নারায়ণ সিং, চাকুরী হলো নাসায়। আর আগে কিছুদিন শিক্ষকতা করেছেন ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে। গণিতের ওপর বেশ কয়েকটা বই লিখে ফেলেছেন তিনি ততদিনে, সেগুলো বেশ সাড়াও ফেলে দিয়েছে। অঙ্কের মাধ্যমেই আইনস্টাইনের কয়েকটা সূত্রকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন তিনি, বলেছিলেন, আইনস্টাইনের দেয়া এই মতবাদগুলো যে ভুল, সেটা তিনি প্রমাণ করে দিতে পারবেন।
কিন্ত সেই সুযোগটা তিনি আর পেলেন না। ১৯৭১ সালে হঠাৎই আমেরিকা ছেড়ে ভারতে চলে এলেন, দূর পরবাসে ভালো লাগছিল না একদমই। কানপুরের আইআইটিতে চাকুরি নিলেন প্রফেসর হিসেবে। বছরখানেক বাদে সেটা ছেড়েও দিলেন। এরপরে কলকাতার স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট আর বোম্বের টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চে কাজ করেছেন। এর মাঝে ১৯৭৪ সালে বিয়ে করলেন। কিন্ত বিয়ের মাত্র এক বছরের মাথায় স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে গেলেন! কারণ হিসেবে জানালেন, এমন বদ্ধ পাগল আর উন্মাদ একজন মানুষের সঙ্গে ঘর করতে পারবেন না তিনি!
অঙ্কের জটিল সূত্র নিয়ে দিনরাত পড়ে থাকা সদাশান্ত এই মানুষটা বদ্ধ উন্মাদ? শুনে সবার চোখ কপালে উঠলো! স্কিজোফ্রেনিয়া তাকে গ্রাস করছিল একটু একটু করে, সেটা আশেপাশের মানুষজন বুঝতে পারেনি একটুও। হুটহাট রেগে যাওয়া, একটু একটু করে অনেককিছুই ভুলে যাওয়া, এগুলোকে তেমন পাত্তা দেয়নি পরিবারের লোকজন। তার স্ত্রীও যেমন তাকে পাগল আর উন্মাদ ভেবেই ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন! ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো তাকে, অনেক পরীক্ষা-নীরিক্ষার পরে ডাক্তারেরা জানালেন, ক্রনিক স্কিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন বশিষ্ট নারায়ন সিং!
সবকিছুই ভুলে যাচ্ছিলেন ধীরে ধীরে, অতীতের সব ঘটনা। শুধু অঙ্কের সূত্রগুলো গেঁথে ছিল মাথায়। একটু একটু করে পাগলামিও দেখা দিতে লাগলো, একটা সময়ে বাড়িতে তাকে রাখাই মুশকিল হয়ে পড়লো, ভর্তি করা হলো মানসিক হাসপাতালে। সেখানে দীর্ঘ একটা সময় কাটিয়েছেন নারায়ণ সিং, একটানা অনেকগুলো বছর। মাঝে একবার বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছিল তাকে, কিন্ত স্কিজোফ্রেনিয়ার উপসর্গ বেড়ে যাওয়ায় আবার নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। ১৯৮৮ সালে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে গেলেন তিনি!
চারটা বছর নিখোঁজ ছিলেন তিনি, যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিলেন একেবারে। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তার কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। ১৯৯৩ সালে খুঁজে পাওয়া গেল তাকে, বিহার থেকে কয়েকশো মাইল দূরের একটা জায়গায়। ছেঁড়া জামাকাপড়, অনেকদিনের অভুক্ত শরীর, লম্বা জটাধরা চুল। পরিবারের সদস্যরা খবর পেয়ে সনাক্ত করলেন তাকে নিয়ে এলেন বাড়িতে। তখন থেকে বসন্তপুরে নিজের পৈতৃক বাড়িতেই বাস করেছেন গণিতের এই বিরল প্রতিভা। কথা বলতে পারেন না ঠিকঠাক, জিভে জড়িয়ে যায় শব্দগুলো। ঘরজুড়ে অঙ্কের বসবাস, দরজার চৌকাঠ থেকে শোয়ার খাট পর্যন্ত, সব জায়গায় অঙ্কের ছড়াছড়ি।
এলাকার লোকজন তাকে শ্রদ্ধা করতো, আবার অনেকে টিটকারীও দিতো। সকালবেলা হোয়াইটবোর্ড আর মার্কার নিয়ে বাড়ির বারান্দায় পড়াতে বসতেন তিনি, কখনও স্থানীয় স্কুলের দুয়েকজন ছাত্র আসতো, কখনওবা কেউই থাকতো না। তাতে তার পড়ানো বন্ধ হতো না। সামনে কেউ না থাকলেও অদৃশ্য কাউকে অঙ্কের জটিক ধাঁধার সহজ সমাধানগুলো শেখাতেন তিনি! শেষ দিনগুলোতেও তার বদ্ধমূল ধারণা ছিল, তিনি আইআইটি কানপুরের প্রফেসর! সেই ভ্রমটা ভাঙানো যায়নি আর।
সরকারের পক্ষ থেকে তার চিকিৎসার জন্যে তেমন কোন উদ্যোগই নেয়া হয়নি, স্থানীয় রাজনীতিবিদেরাও খোঁজ নেননি কখনও। বছর ছয়েক আগে ভূপেন্দ্র নারায়ণ মণ্ডল ইউনিভার্সিটি নামের একটা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে গেস্ট লেকচারার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল, সম্মানীয় একটা পদ। সেখান থেকে কিছু টাকাপয়সা আসত, সেটা দিয়ে চলে যেতো দিন। তার জীবনী নিয়ে সিনেমা বানানোর কথাবার্তা চলছে, হয়তো বায়োপিক চলে আসবে অচিরেই। সেই সিনেমা কোটি কোটি টাকার ব্যবসাও করবে, কিন্ত জ্বলজ্যান্ত মানুষটার পাশে দাঁড়ানোর মতো কাউকে পাওয়া যায়নি, তার চিকিৎসার ভার কেউ নেইয়নি। দারিদ্র্যের কষাঘাতে ধুঁকে ধুঁকে বশিষ্ট নারায়ণ সিং মারা গিয়েছেন, অঙ্কের জটিল হিসেব বুঝতে গিয়ে যিনি জীবনের হিসেবটাই বুঝে উঠতে পারেননি!