
এরকম একটি সময়, যখন যানবাহনের চালকেরা যাত্রীর কথা ভাবছেন না মোটেও, সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যাচ্ছে অহরহ, সেখানে একজন ভ্যানচালকের এমন ব্যতিক্রমী একটি ছোট্ট উদ্যোগ আশার বাতিঘর হয়ে দাঁড়ায় আমাদের কাছে।
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত বছরে বাংলাদেশে শুধু সড়ক দুর্ঘটনাই ঘটেছে ৪৭০২ টি। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৫২২৭ জন মানুষ। এর আগের দুই-তিন বছরের তুলনায় গত বছরে দুর্ঘটনার হার ছিল সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের বয়স যত বাড়ছে ততই ঘিঞ্জি হচ্ছে পরিবেশ, মানুষ বাড়ছে, যানবাহন বাড়ছে, দুর্ঘটনা বাড়ছে। দুই বাসের পাল্লায় বাসযাত্রী মারা যাওয়া থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের রাস্তাজুড়ে আন্দোলন...সড়কের আয়োজন-বিয়োজনগুলো ক্রমশই হচ্ছে বৃদ্ধের কপালের ভাঁজের মতো গভীর, জটিল, ঘন।
যানবাহনগুলোর কাণ্ডজ্ঞানশূন্য প্রতিযোগিতা, বেসামাল গতিতে গাড়ি চালানো, ট্রাফিক নিয়মকানুন থোড়াই না করার কারণেই একেকটি রাস্তা যেখানে পরিণত হয়েছে রাশিয়ান রুলেত এ, সেখানে পথচারী হিসেবে আমাদের দায়ও মোটেও কম না। উদাসীন হাঁটাচলা, রাস্তার আইনকানুন সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতাও সড়ক দুর্ঘটনার বেশ বড়সড় কারণ।
এরকম একটি সময়, যে সময়ে এসে যানবাহনের চালকেরা যাত্রীর কথা ভাবছেন না মোটেও, সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যাচ্ছে খোলামকুচির মতন... সেখানে একজন ভ্যানচালকের ব্যতিক্রমী একটি ছোট্ট উদ্যোগ "আশার বাতিঘর" হয়ে এসে দাঁড়ায় আমাদের কাছে। বলছি সেই মানুষটির গল্পই।

দৈনিক প্রথম আলোর একটি লেখায় উঠে আসে ভ্যানচালক আকিমুল ইসলামের কথা। ঝালকাঠিতে দরিদ্র পরিবারে বেড়ে ওঠা আকিমুল ইসলাম ওরফে সাজু খুব বেশিদূর পড়াশোনা করতে পারেননি। অষ্টম শ্রেনিতে থাকাকালীন পড়াশোনায় ইস্তফা দিয়ে দোকানে কাজ শুরু করতে হয়। এরপর ভ্যান চালানো শুরু করেন। ১৩ বছর ধরে ভ্যান চালাচ্ছেন তিনি। সে সাথে চালাচ্ছেন স্থানীয় সড়কগুলোকে নিরাপদ করারও কাজ।
এরকমই একটি সড়ক ঝিনাইদহের পাগলাকানাই থেকে জিয়ানগর হয়ে কোটচাঁদপুর মেইন বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে মিশেছে । এই সড়কের কোটচাঁদপুর অংশের তালসারের ঘাঘা থেকে সদর উপজেলার হাজিডাঙ্গা পর্যন্ত দুই পাশে প্রচুর জঙ্গল তৈরি হয়েছে বেশ কিছুদিন ধরেই। রাস্তার বিভিন্ন বাঁকে এই জঙ্গলগুলো এমনভাবে থাকে যানবাহন চালকেরা ঠিকঠাকভাবে বুঝে উঠতে পারেন না রাস্তার আকৃতি-প্রকৃতি। এভাবেই ঘটে একেকটি দুর্ঘটনা। বেশ ক'মাস ধরে নিয়মিতই হচ্ছিলো দুর্ঘটনাগুলো। গত সপ্তাহে টানা কয়েকটি দুর্ঘটনায় মানুষ মারাও গিয়েছে।
আকিমুল ভাবলেন এই সমস্যার সমাধান করা উচিত। সামাজিক মাধ্যমে যোগাযোগ করলেন কিছু মানুষ ও কয়েকটি সংগঠনের সাথে। বললেন সমস্যার কথা। চাইলেন জঙ্গল পরিষ্কার করার জন্যে কিছু কর্মী। অনির্বাণ সেচ্ছাসেবী সংগঠন, ঘাঘা প্রভাতী সংঘ, তালসার একতা সেবা সংঘ ও স্বপ্নছোঁয়া সামাজিক সংগঠন নামে চারটি সংগঠন একত্র হয় এই কাজে। সারাদিন পরিশ্রম করে দুই কিলোমিটার রাস্তা, ঘন জঙ্গল, বাঁশঝাড় পরিষ্কারও করে ফেলেন তারা।

সবাই যেখানে নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকছে কোনোকিছু না করেই, সেখানে আকিমুলের এই উদ্যোগ সবাইকেই অনুপ্রেরণা দিয়ে যায়। সে সাথে সবার প্রশংসাবাক্যেও ঋদ্ধ হন আকিমুল। অবশ্য এ প্রশংসাবাক্য আকিমুলের জন্যে নতুন কিছু না। তিনি এর আগেও সবার প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন রাস্তায় সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে। যে সাইনবোর্ডগুলো এখনো রয়েছে ঝালকাঠির স্থানীয় রাস্তার বিভিন্ন অংশে। নির্বাক সাক্ষ্য দিচ্ছে আকিমুলের সচেতনমূলক কর্মকাণ্ডের।
আকিমুল ইসলামের কাছ থেকে অনেককিছুই শেখার আছে আমাদের। মানবতা, মনুষ্যত্ব শেখার বিষয় তো রইলোই, সে সাথে নিজ উদ্যোগে জনকল্যানের যে উদ্যোগটি আমরা দেখি, তা আমাদের একটি বিষয়ই শেখায়, যেকোনো সংকটে হাত গুটিয়ে বসে না থেকে এগিয়ে আসতে হবে আমাদের। কারণ এ মানচিত্র আমাদের, তাকে আগলে রাখাও আমাদের দায়িত্ব। আমরা না দেখলে কেউই দেখে রাখবে না এই দীনহীন ভূখণ্ডকে।
সে সাথে আরেকটি বিষয় লক্ষ্যনীয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করে মানুষের কল্যানে এগিয়ে আসারও একটি নজির দেখি এখানে। তাছাড়া এটাও আমরা বুঝতে পারি, আকিমুলের এই মানসিকতাকে যদি দেশের সামান্য কিছু পরিবহন-শ্রমিকও ধারণ করতে পারে মনেপ্রানে, তাহলেও দেশের সড়ক দুর্ঘটনার হার কমে যাবে উল্লেখযোগ্য অংশে। হয়তো আকিমুল একা খুব বড় কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে না, সেটা সম্ভবও না। তবে এরকম আরো কিছু আকিমুল একত্রিত হয়ে কাজ করলে ভালো অনেককিছুই হওয়া সম্ভব এদেশে।
সেটাই তো আমাদের কাম্য। এরকম আকিমুল আরো অজস্র আসুক এ দেশে। এ দেশে আকিমুলদের বড্ড প্রয়োজন।
তথ্যসূত্র ও ছবি: প্রথম আলো
-
*প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন
* সমাজের নানান অসঙ্গতি নিয়ে আওয়াজ তুলুন। অংশ নিন আমাদের মিছিলে। যোগ দিন 'এগিয়ে চলো বাংলাদেশ' ফেসবুক গ্রুপে