স্বৈরাচার প্রতিহত দিবস হয়ে গেলো ভ্যালেন্টাইন্স ডে। আমরাও ভুলে গেলাম দীপালী-জয়নাল-জাফর-কাঞ্চনদের কথা।

প্রতিবছর ১৪ই ফেব্রুয়ারি দিনটা এই দেশে ভালোবাসার বার্তা নিয়ে আসে। বিশেষ করে গত ১০-১৫ বছরে বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের সাথে সঙ্গতি রেখে ১৪ই ফেব্রুয়ারি আমাদের দেশে উদযাপিত হয় প্রবল আনন্দ আর ভালোবাসাবাসির সাথে। অথচ প্রতিবছরের এই দিনটা হাইকোর্টের গেট থেকে বাংলা একাডেমী পর্যন্ত রাস্তাটা ভিজে থাকে শহীদ জয়নালের তাজা রক্তে, শিশু দীপালীর গুম হয়ে লাশটা থেকে চুইয়ে চুইয়ে পড়তে থাকে টকটকে লাল রক্ত!

ফাগুনের দ্বিতীয় দিনে বসন্তের মৃদুমন্দ হাওয়ায় ভালোবাসার মানুষটির হাতে হাত ধরে হাঁটতে থাকা তরুণ-তরুণীরা শুনতে পায় না ৩৭ বছর আগের সেই আন্দোলন-সংগ্রামে উত্তাল বাংলা একাডেমী চত্বরের গর্জন, শুনতে পায় না পুলিশের নির্বিচার গুলিবর্ষণ আর নাম না জানা অজস্র শহীদের আর্তচিৎকার। হ্যাঁ, আমি জাফর, জয়নাল, দীপালী সাহা, আইয়ুব, ফারুক, কাঞ্চনদের কথা বলতে এসেছি, ২৫ বছর আগে স্বৈরাচারী তেলাপোকা এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে যারা প্রথম রাজপথে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিল, মাথা উঁচু করে শহীদ হয়েছিল নির্বিচার গুলিতে, এমনই এক ১৪ই ফেব্রুয়ারিতে, যাদের আমরা ভুলে গেছি একেবারেই, ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে ভালোবাসার লাল গোলাপে!

২৪শে মার্চ ১৯৮৪ সালে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিল তৎকালীন সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সে জানতো, একটা দেশের শিক্ষিত ত্রুণ ও যুবসমাজ অর্থব আর অকর্মণ্য হলেই কেবল সেই জাতির উপর স্বৈরশাসন চালানো যায়। তাই ক্ষমতায় বসে প্রথমেই সে শিক্ষাকে ধ্বংস করে দেবার মাস্টারপ্ল্যান হাতে নেয়। ১৬ জুলাই '৮২, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সদস্যদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেওয়ার সময় এরশাদ বলে, তার সরকার একটি জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করবে। যা দেশের শিক্ষার উন্নয়ন ও ভবিষ্যৎ বংশধরদের চরিত্র গড়ে তোলার জন্য অপরিহার্য।

মজার ব্যাপারটা হচ্ছে, সেই সভাতেই শিক্ষার মানোন্নয়নে নিজে নেতৃত্ব দেওয়ার প্রস্তাব করে এবং খুবই বিচিত্রভাবে এর কিছুদিন পরেই এরশাদ এই সংগঠনের চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত হয়! শিক্ষক না হয়ে শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের চেয়ারম্যান হবার এই নজির সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসে আর নাই। এরশাদের সামরিক শাসন জারির প্রথম দিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রতিবাদ জানিয়ে বিক্ষোভ করেছিলেন। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্টার লাগাতে গিয়ে বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর তিন সদস্য গ্রেপ্তার হন।

কলাভবনে ২৪ মার্চ সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে পোস্টার লাগাতে গিয়ে গ্রেপ্তার হওয়া এই ছাত্রনেতারা হলেন শিবলী কাইয়ুম, হাবিব ও আ. আলী। পরে সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালতে তাঁদের সাত বছরের কারাদণ্ড হয়। সেই থেকে শুরু হয় সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্রদের আপসহীন লড়াইয়ের দিনগুলো। ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতারা ২৬ মার্চের স্বাধীনতা দিবসে সাভারের স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিতে গিয়ে শহীদ বেদিতেই সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান দেন। মিছিলের খবর শুনে সাভার সেনানিবাস থেকে সেনাবাহিনী চলে আসে, স্মৃতিসৌধে ছাত্রদের ওপর চলে নির্মম নির্যাতন।

এদিকে এরশাদের সুযোগ্য শিক্ষামন্ত্রী ড. মজিদ খান ২৩ সেপ্টেম্বর '৮২ তারিখে একটি নতুন শিক্ষানীতির প্রস্তাব পেশ করে। প্রথম শ্রেণী থেকেই আরবি ও দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে ইংরেজি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব করা হয়। আরেকটি বিতর্কিত বিষয় ছিলো উচ্চশিক্ষা। উচ্চশিক্ষা অর্জনের মাপকাঠি নির্ধারণ করা হয় মেধা অথবা পঞ্চাশ শতাংশ ব্যয়ভার বহনের ক্ষমতা! সংক্ষেপে সেই শিক্ষানীতির ধারাগুলো দেখে নেওয়া যাক-

• শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে কর্মমুখী-উৎপাদনমুখী শিক্ষার উপর বিশেষভাবে গুরুত্বের কথা উল্লেখ করা হলো। • প্রথম শ্রেণী থেকে আরবি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হলো। মাদ্রাসা শিক্ষার প্রসারের প্রস্তাবনা হাজির করা হলো। এর উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার সাম্প্রদায়িকীকরণ ঘটানো। • শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ ত্বরান্বিত করতে সুপারিশ করা হলো “….. অর্থাৎ শিক্ষার বেতনের ৫০ ভাগ শিক্ষার্থীদের থেকে আদায় করা হবে।” রেজাল্ট খারাপ হলেও ৫০ শতাংশ বেতন দিলে উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেয়ার কথা বলা হলো। • বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের অধিকারকে টুঁটি চেপে ধরতে বলা হল, “বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে রাষ্ট্রের মতই স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হয়েছে। ফলে গবেষণা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনার কেন্দ্র হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৃত ভূমিকা থেকে সরে গেছে।” অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়কে এখন রাষ্ট্রের অধীনেই চলতে হবে।

স্বাভাবিকভাবেই গণবিরোধী এ শিক্ষানীতি এদেশের সংগ্রামী ছাত্র সমাজ মেনে নেয় নি। বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা এই শিক্ষানীতিকে আইউব খানের শরীফ শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের নবায়ন ভিন্ন সংস্করণ হিসেবে আখ্যা দেন। শিক্ষানীতি বিরোধী আন্দোলন এক পর্যায়ে রাজনৈতিক আন্দোলন তথা স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে।

সারাদেশের ছাত্র ও শিক্ষক সমাজ এই নীতির প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসেন। শুরু হয় মিছিল প্রতিবাদ। ১৯৮২ সালের ৮ই নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের লাঠিপেটায় গুরুতর আহত হন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক নুরুল আমিন বেপারীসহ ছাত্র, কর্মচারী ও সাংবাদিক। গ্রেফতার করা হয় ৩০ জনকে। এর প্রতিবাদে পরদিন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়, প্রতিবাদ মিছিল হয়। বন্ধ ঘোষণা করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৪ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় খুললে ১৪টি ছাত্র সংগঠন একযোগে আন্দোলন কর্মসূচী চালায়।

ছাত্রদল আর ছাত্রশিবির পৃথক কর্মসূচী পালন করে। একদিকে প্রতিবাদ আন্দোলন আরেকদিনে দমন নিপীড়ন চলতে থাকে। এখানে একাত্তরের গণহত্যাকারী আলবদর নরপিশাচদের নিয়ে গড়া ইসলামী ছাত্রশিবিরের ভূমিকাটা ছিল খুবই বিচিত্র। একটু পরেই সে আলোচনায় আসছি। ১৯৮২ সালের ২১শে নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে গণসাক্ষরতা অভিযান চলে। ছাত্র সংগ্রামের নেতৃত্বে দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মজিদ খান শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়। ছাত্ররা ২৯ ডিসেম্বর দাবি দিবস ও ১১ জানুয়ারি সচিবালয়ের সামনে শান্তিপূর্ণ অবস্থান ধর্মঘট কর্মসূচি ঘোষণা করে।

কিন্তু এরশাদ তাতে একটুও না থেমে '৮৩র জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে দেশের ১৪২টি থানার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় বাধ্যতামূলক আরবি শিক্ষা শুরুর আদেশ দেয়। একই সঙ্গে ১১ জানুয়ারির কর্মসূচির বিরুদ্ধে কড়া প্রেসনোট হুমকি দেয়। কিন্তু তাতেও ছাত্ররা পিছপা না হলে এরশাদ ছাত্রদের সঙ্গে বৈঠকের প্রস্তাব দেয়। ছাত্ররা ৭ জানুয়ারি '৮৩র সেই প্রস্তাবিত বৈঠক প্রত্যাখ্যান করে। ১১ জানুয়ারি প্রস্তাবিত তারিখে হাজার হাজার ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবেশে সমবেত হয়। অপরদিকে অস্ত্রসজ্জিত প্রচুর দাঙ্গা পুলিশ মোতায়েন করা হয় বিশ্ববিদ্যালয় ও সচিবালয়ের চারপাশে। ব্যাপক সংঘর্ষ এড়াতে ছাত্ররা সচিবালয়ে না গিয়ে শহীদ মিনারে গিয়ে আন্দোলন তীব্রতর করার শপথ গ্রহণ করেন। একুশে ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। এরশাদ এবার একুশের চেতনায় আঘাত হানতে শুরু করে।

জানুয়ারির মাঝামাঝিতে বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদাররেসিন আয়োজিত আন্তর্জাতিক ইসলামী মহাসম্মেলনে প্রধান অতিথির ভাষণে এরশাদ বলেন: “বাংলাদেশ মুসলমানদের দেশ, বাংলাদেশকে ইসলামী রাষ্ট্র করার জন্যই আমাদের সংগ্রাম। ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে তৈরি হয়েছিলো শহীদ মিনার। কিন্তু আমরা দেখি সেখানে আল্পনা আঁকা হয়। এ কাজ ইসলাম বিরোধী। শহীদ আবুল বরকত আল্লাহর বান্দা, তার জন্য আল্পনা কেন, কোরানখানি হবে। গত ২৪ মার্চ আমি দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছি। কিন্তু সেদিন আমি আল্লাহর কাছে হাত তুলে কেঁদেছি, আমার জীবনে একটা অসম্পূর্ণতা রয়ে গেছে। ২৬ বছরের বিবাহিত জীবনের পরও আমার কোন সন্তান নেই। গাউসুল আজমের সেই চাদর হাতে নিয়ে আল্লাহর কাছে আমি কেঁদেছি, একটি সন্তান চেয়েছি, আল্লাহ আমার কান্না শুনেছেন। আমাদের সন্তান হবে ইনশাল্লাহ।“

এরই মধ্যে এরশাদ ফরিদপুরের আটরশির পীর হজরত মওলানা শাহ্ সুফী হাশমতউল্লাহ সাহেবের কাছে মুরিদ হন। চারজন জেনারেলকে নিয়ে হেলিকপ্টারে করে পীরের ছবক নিয়ে আসেন। বাংলাদেশকে ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার ব্যাপারে পীর সাহেব পরামর্শ দিয়েছেন। আজকের বাংলাদেশে যখন ধর্মান্ধতা এবং উগ্র মৌলবাদীতার উর্বর চাষাবাদ দেখি আমরা, যখন সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীকে এই উগ্রতায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সায় জানাতে দেখি, তখন আমরা টের পাই, খন্দকার মুশতাক-জেনারেল জিয়াদের মত বেঈমানদের পথ ধরে এরশাদ রোপণ করেছিল এই বিষবৃক্ষের চারা, রাষ্ট্রীয়ভাবে একুশ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করতে ধর্মীয় উগ্রবাদ ও ধর্মান্ধতাকে ঠিক এভাবে দাঁড় করিয়েছিল মুখোমুখি, যেন ভবিষ্যতের অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশে ইসলামের নামে ভাঙ্গিয়ে, ইসলামকে ব্যবহার করে পাকিপন্থী ধর্মান্ধ বেইমানেরা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারে, রাজনীতি করতে পারে, ক্ষমতায় যেতে পারে! আফসোস, মুশতাক-জিয়া-এরশাদের সেই মাস্টারপ্ল্যানই আজ বাস্তবায়িত হতে দেখছি আমরা।

সেদিনের ভ্যালেন্টাইন্স ডে 

এদিকে এরশাদ ও তার দোসর মজিদ খান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে স্টেডিয়াম উদ্বোধন করতে গেলে ছাত্ররা তা বর্জন করে। বর্জন প্রতিবাদের মুখে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসব বাতিল হয়। এদিকে চলতে থাকে ছাত্রনেতাদের গ্রেফতার অভিযান। ছাত্রলীগ [মু-হা] সাহিত্য সম্পাদক মোহন রায়হান, ছাত্র ইউনিয়ন নেতা ও ইকসুর সহ সভাপতি খন্দকার মোহাম্মদ ফারুক এবং ছাত্রলীগ [মু-হা]র কেন্দ্রীয় নেতা আতাউল করিম ফারুক ও খোন্দকার আবদুর রহীমকে গ্রেপ্তার করা হয়।

এই সময়েই উন্মোচিত হয় একাত্তরের আলবদর নরপিশাচ ইসলামী ছাত্র শিবিরের আসল রুপ। সভাপতি সাইফুল আলম খান মিলন ও সাধারণ সম্পাদক তাসনীম আলম এক যুক্ত বিবৃতিতে ঘোষিত শিক্ষানীতিকে "আদর্শহীন" উল্লেখ করে শিক্ষানীতির আদর্শ হিসেবে দেশের শতকরা ৮৫ জন মানুষের আদর্শ ইসলামকে গ্রহণ করার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানায়। অর্থাৎ যেটা বলছিলাম, একাত্তরে ওরা যেভাবে ইসলামের নামে স্বজাতির উপরে চালিয়েছিল গণহত্যা, ’৮৩ তেও রাষ্ট্রীয় মদদে ঠিক একইভাবে ইসলামের নাম ব্যবহার করে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাবার কূটকৌশলে হাত মিলিয়েছিল ছাত্রশিবির। ছাত্রশিবিরের এই রুপ গত ৩৫ বছরেও পরিবর্তন হয়নি। পাকিস্তানপন্থী ষড়যন্ত্রে আর জঙ্গীবাদের চাষাবাদে এবং প্রতিষ্ঠায় স্রেফ আরো দক্ষ এবং ভয়ংকর হয়ে উঠেছে একাত্তরের এই খুনী নরপিশাচেরা!

১১ই জানুয়ারির সচিবালয়ে অবস্থান ধর্মঘট কর্মসূচি রদবদল কেন করা হলো এই নিয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে অসন্তোষ তৈরি হয়। প্রতিবাদে ছাত্ররা ডাকসু অফিস ভাংচুর করে। তবু ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দ শান্তিপূর্ণ পথেই দাবি আদায়ের সংগ্রাম এগিয়ে নেওয়ার পথে অবিচল থাকেন। ১৪ ফেব্রুয়ারি বিক্ষোভ কর্মসূচির ঘোষণা দেন। ৬ই ফেব্রুয়ারি ইসলামী ছাত্র শিবিরের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবেশে মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতার মূল্যবোধ বিরোধী অপপ্রচার চালানো হয়। সম্মিলিত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এই খুনীদের এহেন মিথ্যাচারের বিরোধিতা করলে দুইপক্ষে সংঘর্ষ হয়, আহত হয় অর্ধশত ছাত্র।

এই ঘটনার খবর সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লে সারাদেশেই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও শিবিরের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এদিকে ছাত্রদের কঠোর মনোভাবে এরশাদ কিছুটা বিচলিত হয়, ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রস্তাবিত শিক্ষানীতির ব্যাপারে একটি জনমত যাচাই কমিটি গঠনের প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী আন্দোলন অব্যাহত রাখে। ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার ছাত্র ছাত্রী মিছিলসহ স্মারকলিপি পেশ করতে সচিবালয়ের দিকে ধেয়ে যায়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও এই আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করে এবং আন্দোলনে অংশ নেয়। সেদিন মিছিলে অংশ নেওয়া ছাত্রনেতা মোস্তাক হোসেনের বর্ণনা মতে, '১৪ ফেব্রুয়ারি আরো সুশৃঙ্খল, আরো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে ছাত্ররা কর্মসূচিতে যোগ দেন।

মিছিলের প্রথমে শতাধিক ছাত্রীর অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখ করার মতো। খুবই শান্তিপূর্ণ মিছিল ছিল, উৎসবের মতো অনেকটা। ব্যারিকেডের সামনে যখন মিছিল যায় হাইকোর্টের গেট ও কার্জন হল-সংলগ্ন এলাকায়, তখন মেয়েরা ব্যারিকেডের সামনে বসে পড়েন। নেতারা তারকাঁটার ওপর উঠে বক্তৃতা দিতে শুরু করেন। মিছিলটি ছিল হাইকোর্টের গেট থেকে বাংলা একাডেমী পর্যন্ত। কিন্তু কোনো উসকানি ছাড়াই তারকাঁটার একদিক কিছুটা সরিয়ে রায়ট কার ঢুকিয়ে রঙিন গরম পানি ছিটাতে শুরু করে পুলিশ। এরপর ভেতরে ঢুকে বেধড়ক লাঠিচার্জ শুরু করে। সাধারণ ছাত্ররা তখন এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করে পুলিশের দিকে ইট-পাটকেল ছুড়তে শুরু করেন। পুলিশ তখন ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। এ সময় গুলিবিদ্ধ হন জয়নাল।

সেদিন জয়নালকে গুলিবিদ্ধ করেই ক্ষান্ত হয়নি, তাঁর শরীর বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে পুলিশ। বেয়নেট ফলা আর জয়নালের শরীর থেকে চুইয়েপড়া রক্ত বাংলার পথ-প্রান্তর ভাসিয়ে দেয়। জয়নালের গুলিবিদ্ধ দেহকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে তবে শান্ত হয় পশুরা। শুধু জয়নাল নয়, ছাত্রদের ওপর পুলিশি তাণ্ডবের সময় শিশু একাডেমীতে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসা দিপালী নামের এক শিশু গুলিবিদ্ধ হয়। তবে দিপালীর লাশ পুলিশ গুম করে ফেলে। জয়নাল পড়েছিলেন কার্জন হলের মধ্যে। তাঁকে ধরে ঢাকা মেডিক্যালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন।

এ ঘটনা ছড়িয়ে পড়লে যেসব ছাত্র সকালে মিছিলে আসেননি, তাঁরা বিকেলে জয়নালের জানাজায় বটতলায় উপস্থিত হন। হাজার হাজার সাধারণ মানুষও উপস্থিত হয়। তাৎকালীন অনেক জাতীয় নেতারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন।' প্রায় সারাদিনব্যাপী এই অসম সংঘর্ষে জাফর, জয়নাল, দীপালী সাহা, আইয়ুব, ফারুক, কাঞ্চন প্রমুখ নিহত হন। দশ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়, কিন্তু সরকারি প্রেসনোটে দাবী করা হয় ১ জনের মৃত্যুর কথা। আর আহতের সংখ্যা অগুনতি। গ্রেফতারের সংখ্যাও অগুনতি। পুলিশ সেদিন শুধু হত্যা করেই স্থির থাকেনি, বিকেলে ক্যাম্পাসে একটি যুদ্ধ-পরিস্থিতি তৈরি করে সেনাবাহিনী। তার সঙ্গে যোগ দেয় বিডিআর-পুলিশ।

শাহবাগ, টিএসসি চত্বর, কলাভবনের সামনে, নীলক্ষেত, কাঁটাবনের রাস্তা ধরে পুরো অঞ্চল ঘেরাও করে ফেলে তারা। অপরাজেয় বাংলার সমাবেশে পুলিশ অতর্কিত লাঠিচার্জ শুরু করে। এ সময় বহু ছাত্রনেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। উপাচার্যের কার্যালয়ে ঢুকে পুলিশ ছাত্রছাত্রীদের মেরে হাত-পা ভেঙে ট্রাকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। এ ঘটনার প্রতিবাদে তৎকালীন উপাচার্য পদত্যাগ করেন। কলাভবনের ভেতরে ঢুকে পুলিশ ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক যাঁকে পেয়েছে তাঁকেই নির্যাতন করেছে। ওখান থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক খ ম জাহাঙ্গীরকে গ্রেপ্তার করে। ওই বিভীষিকাময় দিনের বর্ণনা করেছেন স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্রনেতা মোস্তাক হোসেন, 'আমরা জয়নালের লাশ লুকিয়ে ফেলেছিলাম মুহসীন হলের ডাইনিংয়ে।

লাশের খোঁজে পুলিশ চারুকলায় ঢুকে ছাত্রদের নির্যাতন ও গ্রেপ্তার করে। পুলিশ খুঁজে খুঁজে পোশাকে রঙিন গরম পানির চিহ্ন দেখে দেখে গ্রেপ্তার করে। অবশেষে মুহসীন হলের ডাইনিংয়ে লাশ পাওয়া গেলে অন্যান্য হলে লাশের তল্লাশি বন্ধ করা হয়।' কিন্তু গ্রেপ্তার করে দুই সহস্রাধিক ছাত্র-জনতাকে। সরকারি হিসাব মতে এক হাজার ৩৩১ জন। সবাইকে গ্রেপ্তার করে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় শাহবাগের পুলিশ কন্ট্রোল রুমে। এরপর তাঁদের তুলে দেওয়া হয় আর্মির হাতে। বন্দি ছাত্র-জনতার ওপর চলে প্রথমে পুলিশ ও পরে আর্মির নিষ্ঠুর নির্যাতন। মেয়েদের গ্রেপ্তার করে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রবল চাপের কারণে তাঁদের ১৫-১৬ তারিখের মধ্যে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।

এই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে পরদিন, অর্থাৎ ১৫ ফেব্রুয়ারি ছাত্রজনতা রাস্তায় নেমে আসে। সংঘর্ষ হয় মিরপুর, আমতলী, তেজগাঁ, বাহাদুরশাহ পার্ক, ইংলিশ রোড, মতিঝিল এবং অবশ্যই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। শুধু ঢাকাতেই না, আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। পুলিশ গুলি চালায়। চট্টগ্রামে নিহত হন মোজাম্মেলসহ আরো কয়েকজন। যদিও এদিনও সরকারী প্রেসনোটে নিহতের সংখ্যা ১জন দাবী করা হয়। ভীত সন্ত্রস্ত এরশাদ ঢাকা ও চট্টগ্রামের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করে। জাহাঙ্গীরনগর ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে সারাদেশে গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এসব খবর যাতে সারাদেশে ছড়াতে না পারে, সেজন্য সংবাদপত্রগুলোতে আরো কড়াকড়িভাবে সেন্সরশীপ আরোপ করা হয়।

শহীদ জয়নাল

১৪ থেকে ১৭ ফেব্রুয়ারির আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে সারাদেশে প্রচুর গ্রেফতার অভিযান চলে। শেখ হাসিনা, মতিয়া চৌধুরী, সাহারা খাতুন, মেনন, জলিল, অলি, তোফায়েল, মান্নান, সামাদ আজাদ থেকে শুরু করে শীর্ষস্থানীয় প্রচুর ছাত্রনেতাকে গ্রেফতার করে এরশাদ বাহিনী। তবু আন্দোলনকে দমাতে পারেনি। ব্যাপক ছাত্রগণআন্দোলনের মুখে ১৭ ফেব্রুয়ারি তারিখে এরশাদ বলতে বাধ্য হয় যে- "জনগণের রায় ছাড়া শিক্ষা সম্পর্কে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না।" মজিদ খান প্রস্তাবিত স্বৈরশাসক এরশাদের বিতর্কিত শিক্ষানীতির প্রতিবাদে সামরিক নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে, লাঠি গুলি টিয়ার গ্যাসকে পরোয়া না করে, গ্রেফতার নির্যাতন হুমকি হত্যার তোয়াক্কা না করে সেই যে মানুষ রাস্তায় নেমেছিলো '৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি তারিখে, সেখান থেকেই মূলত এরশাদ বিরোধী গণআন্দোলনের সূত্রপাত।

'৮৩র ১৪ ফেব্রুয়ারি তারিখেই এদেশে সামরিক শাসনের ভীত কাঁপিয়ে দেয় সাধারণ নিরস্ত্র ছাত্ররা। ধীরে ধীরে যা সার্বিক গণআন্দোলনে রূপ লাভ করে। এবং সবশেষে ১৯৯০ সালে স্বৈরশাসক এরশাদের পতন ঘটে। বস্তুতপক্ষে মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৮৩ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারির এই আন্দোলনই বাংলাদেশের প্রথম গণ আন্দোলন। এবং যা বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত থামেনি। এই অকৃতজ্ঞ জাতির অন্যতম অকৃতজ্ঞতা নমুনা সম্ভবত কালের বিবর্তনে শোকাবহ সেই ১৪ই ফেব্রুয়ারির ভালোবাসার উৎসবের দিনে পরিণত হওয়া। এতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল আরেক কালপ্রিট সাংবাদিক শফিক রেহমান। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম গণ আন্দোলনের এই ঐতিহাসিক ঘটনা, শহীদদের রক্তে ভেজা শোকাবহ ১৪ই ফেব্রুয়ারিকে লাল গোলাপের ভালোবাসায় আড়াল করে দিতে এগিয়ে আসে সে। 

এই অসামান্য বিপ্লব এবং বিজয়কে বিস্মৃতির অতলে ফেলে দেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টায় ধীরে ধীরে দীপালী-জয়নাল-কাঞ্চনদের লাশের উপর গড়ে ওঠে আর্চেস আর হলমার্কের দোকান, আনন্দ-উৎসবের উপলক্ষ্যে পরিণত হয় এই দিন, সবাই ভুলে যায় এইদিনের শহীদদের কথা, যাদের আত্মত্যাগে রচির হয়েছিল স্বৈরাচার পতনের মঞ্চ! কি অদ্ভুত এক জাতি আমরা, ১৪ই ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবসে কত অসংখ্য মানুষ ভালোবাসি শব্দটা উচ্চারণ করে, অথচ এই দিনে জাতির জন্য, এই তরুণদের জন্য যে মানুষগুলো সবচেয়ে প্রার্থিত সবচেয়ে দামী প্রাণটা হাসিমুখে দিয়ে গেল, তাদের স্মৃতি স্মরণ করে এক ফোঁটা চোখের পানি কেউ ফেলে না, তাদের কেউ ভালোবাসে না, তাদের কথা কারো মনেই পড়ে না...

বিঃদ্রঃ  এই লেখাটি সাজাতে সবচেয়ে বড় কৃতজ্ঞতা সচলের নজরুল ইসলাম ভাইয়ের! তার এই অসাধারণ তথ্যসমৃদ্ধ লেখাটি থেকে নানা তথ্যউপাত্ত এবং গুরুত্বপূর্ণ অংশ নেওয়া হয়েছে।

এছাড়া আরো তথ্য সহযোগিতা ও সার্বিক কৃতজ্ঞতাঃ ১। ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৩ ২। রক্তের অক্ষরে লেখা শহীদের নাম ভেসে গেছে ভ্যালেন্টাইনের জোয়ারে ৩।১৪ ফেব্রুয়ারি : ভালোবাসা দিবসের ধূম্রজালে ম্লান হবে না স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র অধিকারের চেতনা ৪। ১৪ ফেব্রুয়ারি : যে ইতিহাস আমরা ভুলতে বসেছি

 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা