মানুষ একটি রাজনৈতিক প্রাণী, বলেছিলেন এরিস্টটল। তাহলে একবার ভাবুন তো সে প্রানীটি কতটুকু অসহায় হলে সামান্য টয়লেট টিস্যুতে আত্মজীবনী লিখে যায়?

মূল আলাপ শুরু করবার আগে, ১৬শ' শতক থেকে কিছু জেনে আসতে হবে। তৎকালীন ইউরোপের ধর্ম এবং রাজনীতি পারস্পরিক সাংঘর্ষিক ছিলো। মূলত ইংল্যান্ড, স্পেন আর ফ্রান্স ছিলো খ্রিস্ট ধর্মের রোমান ক্যাথলিক শাখার প্রধান ধর্ম গুরু পোপ বিরোধী। তবে সমাজের উঁচুস্তরে রোমান ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট দুই জাতের রাজনীতিবিদেরই বিচরণ ছিলো। কিন্তু প্রোটেস্ট্যান্টরা রাণী এলিজাবেথের অনুগ্রহ পাওয়ায়, ক্যাথলিকরা হয়েছে বিতাড়িত। এমনই এক আভ্যন্তরীণ সঙ্কটের মধ্যে ইংল্যান্ডের ক্ষমতায় আসেন স্কটিশ রাজা জেমস্। পারিবারিকভাবে রক্তের সম্পর্ক থাকা ছাড়াও নিঃসন্তান রাণী এলিজাবেথের মনোনীত উত্তরাধিকারী ছিলেন তিনি। অতএব তৎকালীন পার্লামেন্টারি সিস্টেম রইলো প্রোটেস্ট্যান্ট নিয়ন্ত্রণাধীন। তাই ক্যাথলিকরা এটি নিয়ে মোটেই সন্তুষ্ট ছিলো না।

গাই ফক্স

ক্ষমতার পালাবদল হলো শুধু, ক্যাথলিকদের উপর অত্যাচার অপরিবর্তিতই রইলো। তাই এক প্রকার বাধ্য হয়েই, স্পেনের রাজার অধীনে দীর্ঘ সময় যুদ্ধ করা অভিজ্ঞ ক্যাথলিক গাই ফক্স (Guy Fawkes) এর সহযোগীতায় রাজা জেমস এবং অন্যান্য সদস্যদেরসহ গানপাউডার বিস্ফোরণে তৎকালীন পার্লামেন্টারি সিস্টেম 'হাউজ অফ লর্ডস্' উড়িয়ে দেবার পরিকল্পনা করা হলো। পরিকল্পনাটি ছিলো মূলত রবার্ট ক্যাটসবি এর। ১৬০৪ সালে পরিকল্পনা করা হয়, ১৬০৫ সালের নভেম্বরের ৫ তারিখ এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। অতঃপর পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় ফক্স’কে বন্দী করা হলো। এবং ১৬০৬ সালের ৩১শে জানুয়ারি তাকে ঝুলিয়ে দেওয়া হলো ফাঁসিতে। এটিই ইতিহাস বিখ্যাত ৫ই নভেম্বরের গানপাউডার প্লট (Gunpowder Plot) নামে পরিচিত।

গানপাউডার প্লট

এজন্যেই বর্তমানে ইংল্যান্ডে প্রতিবছর ৫ই নভেম্বর বনফায়ার নাইট (Bonfire Night) উৎযাপন করা হয়। যার প্রচলন ঘটে ১৮শ' শতক থেকে। সাধারনত ছোটো বাচ্চারা বছরের এই দিনে মুখোশ পড়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে হানা দিয়ে চকোলেট, টাকা-পয়সা সংগ্রহ করে। একই সাথে পোড়ানো হয় আঁতশবাজি। 

ইংল্যান্ডে বনফায়ার নাইট উৎযাপন

সাধারণত কোনো মুখোশের অন্তরালে মূর্তিসদৃশ ব্যক্তিকে এফিগি (Effigy) বলা হয়। গাই ফকসের মুখায়বের আদলে এই এফিগির জন্ম হয় ১৯৮৮ সালে কমিক আঁকিয়ে ডেভিড লয়েড এবং কমিক লেখক অ্যালান মুর (ডিসি কমিক্স) এর V for Vendetta কমিকের মাধ্যমে। সেই কমিক বা গ্রাফিক নোভেল থেকে একই শিরোনামে ২০০৫ সালে চলচ্চিত্রে রুপান্তরিত হয় ভি ফর ভেন্ডেটা। যেখানে দেখানো হয় ২০২০ সালের শেষের দিকে ব্রিটেনে এক ফ্যাসিবাদী সরকার ক্ষমতায় আসে। সেই সরকার আইন সম্পূর্ণ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়ে ইচ্ছামতো স্বৈরাচারী কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করতে থাকে। ঠিক গাই ফকসের মতো করেই দুর্নীতিগ্রস্থ ব্রিটিশ পার্লামেন্ট উড়িয়ে দেবার প্ল্যান করে সিনেমার প্রটাগনিস্ট ভি (V)।

ভি ফর ভেন্ডেটা কমিকের প্রচ্ছদ / গাই ফকসের এফিগি

টিপিকাল মার্ভেল ''সিনেম্যাটিক ইউনিভার্স'' এর বাইরে গিয়েও যে দুর্দান্ত কমিক বুক মুভি বানানো যায়, 'ভি ফর ভেন্ডেটা' তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এই কারণেই বাকী কমিক বুক মুভিগুলোকে সরাসরি সেরা না বলে অন্যতম সেরা বলতে হয়।

V for Vendetta সিনেমা দিয়ে শুধুই প্রাতিহিংসাকে ইঙ্গিত করা হয়নি, এখানে V একটি আদর্শের প্রতীক। রোমান ভাষায় V অর্থ ৫, যা ৫ই নভেম্বরের ইঙ্গিত দেয়। শুধু তা-ই নয়, সিনেমাটিতে V'কে যে কারাগার কক্ষে রাখা হয় তার নাম্বারও ছিলো পাঁচ। সিনেমার ক্লাইম্যাক্সে 'কেঁচিগেইটের' একটি দৃশ্য রেয়েছে যেখানে গেইটের ডিজাইনও V এর ইঙ্গিত বহন করে। এমনকি বিশেষ দৃশ্যে ব্যাকরাউন্ড স্কোরে ব্যবহার করা হয়েছে বিটোভেনের 'ফিফথ্' (V) সিম্ফোনি। সিনেমার শুরুতে ব্রিটিশ হাইকোর্ট উড়িয়ে দেবার সময় যে ফায়ারওয়ার্ক্স দেখানো হয়, সেখানেও V দৃশ্যমান। সিনেমার ডায়লগেও V এর উপস্থিতি উল্লেখ্য; Vi Veri Veniversum Vivus Vici অর্থাৎ ''By the power of the truth, I, while living, have conquered the universe.''

সিনেমায় ব্রিটিশ হাইকোর্ট উড়িয়ে দেবার সময় ফায়ারওয়ার্ক্সে 'V' সাইনকে ইঙ্গিত করা একটি দৃশ্য

সিনেমায় ডমিনো চিপসের একটি দুর্দান্ত মেটাফোর রয়েছে। যেটাতে ২২,০০০ ডমিনোজ ব্যবহার করা হয়েছে। ৪ জন প্রফেশনাল ডমিনো এসেম্বলার মিলে ২০০ ঘন্টা পরিশ্রম করে ডমিনোগুলো সাজিয়েছিলেন। যার সিনেম্যাটিক স্থায়িত্ত্ব ছিলো মাত্র ৩০ সেকেন্ড। ডমিনো চিপস দিয়ে ভঙ্গুর রাষ্ট্র ব্যবস্থাকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। যখন একটা ডমিনোয় টোকা লাগে, পাশেরটিও তার ধাক্কায় পড়ে যায়; এটাই হচ্ছে বিপ্লব। এভাবে ২১,৯৯৯ ডমিনোজ পড়ে যায়, কিন্তু একটি ডমিনো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। ঠিক V এর মতন। তবে এই দৃশ্যটির আরেকটি ব্যাখ্যা রয়েছে। সিনেমায় V চরিত্রটি সবকিছু পরিকল্পনা মতো করে, কিন্তু পার্লামেন্ট উড়িয়ে দেবার ব্যাপারটা জনগনের উপর ছেড়ে দেয়। “A domino beyond his control, and which he will not allow his plan to force, to topple in either way. He balances his plan, so as to leave that choice to the people.’’ এখানে শেষে দাঁড়ানো সেই ডমিনোটাই হচ্ছে জনগনের ইচ্ছে।

ডমিনোতে টোকা দিয়ে দেখানো গুরুত্বপূর্ণ মেটাফোরিক দৃশ্য

সিনেমাটির সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হচ্ছে এর স্ক্রিপ্ট এবং ডায়লগ; যা আপনার ভোকাবুলারি এবং আদর্শে নতুন কিছু শব্দ যোগ করবে। প্রোটাগনিস্ট V এর চরিত্রে মাত্রাতিরিক্ত দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন হুগো ওয়েভিং; সাথে ছিলো তার ঐশ্বরিক কন্ঠ। পার্শ্ব চরিত্রে ন্যাটালি পোর্টম্যান ছিলেন অনবদ্য। সিনেমাটি দুর্দান্তভাবে নির্মান করেছেন জেমস্ ম্যাকটিগ। চিত্রনাট্য লিখেছেন ম্যাট্রিক্সের মাধ্যমে চলিচ্চিত্রে সায়েন্স ফিকশনের রেভুলশন ঘটানো ওয়াচস্কি ব্রাদার্স (বর্তমানে ওয়াচস্কি সিস্টার্স)। ৫৪ মিলিয়ন ইউএস ডলার বাজেটে নির্মিত এ সিনেমাটি বক্স অফিসে আয় করেছে ১৩২ মিলিয়ন।

ডমিনোতে টোকা দিয়ে দেখানো গুরুত্বপূর্ণ মেটাফোরিক দৃশ্য

২৭টি নমিনেশনে পুরস্কার জিতেছে ৭টি। ১০ লাখেরও বেশি ভোটে IMDb'তে V for Vendetta এর রেটিং ৮.২ এবং সেরা ২৫০ সিনেমার তালিকায় অবস্থান ১৫৪ তম। রটেন টমাটোতে ফ্রেশনেস ৭৩%, মেটাক্রিটিকে স্কোর ৬২%। এবং আমার দেখা সেরা সিনেমাগুলোর একটি। লেখাটি যে প্রসঙ্গে শুরু করেছিলাম, সে প্রসঙ্গ এসেছে এই সিনেমারই একটি দৃশ্যের মাধ্যমে। যার মর্মার্থ বুঝতে হলে আপনার সিনেমাটি দেখতে হবে। আর যারা ইতিমধ্যে দেখে ফেলেছেন তারা আসলেই রাজনৈতিক প্রাণী বটে। আর আমাদের মতো রাজনৈতিক প্রাণীদের জন্যেই তো ভি ফর ভেন্ডেটা একটি কাল্ট ক্লাসিক চলচ্চিত্র।

'People shouldn't be afraid of their government. Governments should be afraid of their people.' এটি শুধুই রক্ত গরম করে দেয়া ডায়লগবাজি, ডিস্টোপিয়ান বা কল্পিত পলিটিকাল থ্রিলার নয়। গাই ফক্সের আদলে V যেনো আমাদের ভেতরকার এক প্রতিবাদী সত্ত্বা। আর 'মোনালিসার মতোই ফকসের রহস্যময় হাস্যোজ্জল মুখের' মুখোশটি যেনো হয়ে উঠেছে বর্তমান অনলাইন/অফলাইন বিপ্লবের শেষ আশ্রয়। বিশ্ববিখ্যাত হ্যাকার গ্রুপ অ্যানোনিমাস (Anonymous) ছাড়াও অনেক অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট এই মুখোশটি ব্যবহার করে থাকেন। নিজ নিরাপত্তার ব্যাপারটি চিন্তা করলে এই মুখোশটি প্রতীকীভাবে বেশ কার্যকর।

সিনেমার একটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ  দৃশ্য

সিনেমার ভেতরের লেয়ার, মেটাফোর কিংবা সিম্বলিক ভিজ্যুয়াল স্টোরি টেলিং না বুঝলেও, একটি ভালো সিনেমা খুব সহজেই উপভোগ করা যায়। যেমন, ম্যাট্রিক্স মুভির ফিকশন কেউ কেউ না বুঝলেও একশন এনজয় করেছেন সবাই। তেমনই এক একশন ফ্লিক বলা যায় ভি ফর ভেন্ডেটাকে। সেই উপভোগ করা সিনেমাটা যখন নতুন ভাবনার খোঁড়াক জোগায়, দর্শকের সত্ত্বাতে বিপ্লব ঘটায় তখনই সেটা সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়ে ওঠে। চলচ্চিত্র যে কি পরিমাণ শক্তিশালী একটি মাধ্যম, সেটা এই ধরণের সিনেমাগুলোই প্রমাণ করে দেয়।

মৃত্যুর ৪০০ বছর পরেও গাই ফক্স হারিয়ে যায়নি কেন জানেন? কারণ, একজন মানুষকে হত্য করা যায় কিন্তু তার আদর্শকে নয়। এই সিনেমারই আরেকটি ডায়লগ, ''Beneath this mask there is more than flesh, Beneath this mask there is an idea, Mr. Creedy, and ideas are bulletproof.''

ছবি কথা বলে

 

একটি দারুণ চলচ্চিত্র শুধু নিছক বিনোদনের মাধ্যম নয়, বরং বাস্তবতার অন্য এক জগত তৈরি করতে সক্ষম। আর সে জগতে বিচরণ করে নিত্যনতুন সব উপলব্ধির বিকাশ ঘটে নিজের মধ্যে। এখানেই একটি চলচ্চিত্রের সার্থকতা। এই সিনেমাটি চারশো বছরের আদর্শকে ধারণ করেছে। যা এই মনোলগে বিদ্যমান...
Remember, remember! The fifth of November, The Gunpowder treason and plot; I know of no reason Why the Gunpowder treason Should ever be forgot!

শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা