
একজন বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়ক, অন্যজন ভারতবর্ষের ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা পরিচালকদের একজন। দুজনে একসঙ্গে কাজও করেছেন। অথচ সত্যজিৎ রায় নাকি একবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল স্বয়ং অরুণ কুমার চ্যাটার্জি তথা উত্তম কুমারের কাছ থেকে!
মহানায়ক উত্তম কুমার নিঃসন্দেহে বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র। ৩০ বছরের বর্ণিল ক্যারিয়ারে উত্তম কুমার পর্দায় হাজির হয়েছিল ২১১টি চলচ্চিত্রে। এর মধ্যে কয়েকটি আবার তার মৃত্যুর পরও মুক্তি পেয়েছিল। অপরদিকে বাংলা চলচ্চিত্রের সর্বকালের সেরা নির্মাতার খেতাবটি সংখ্যাগরিষ্ঠের মতে সত্যজিৎ রায়ের দখলে। কিন্তু টালিগঞ্জে একটি গুজব চাউর আছে, সত্যজিৎ রায় নাকি একবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল স্বয়ং অরুণ কুমার চ্যাটার্জি তথা উত্তম কুমারের কাছ থেকে!
কথিত আছে, ১৯৫৬ সালের শুরুর দিকে সত্যজিৎ শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন, এবং বেশ কিছুদিন তাকে গৃহবন্দি থাকতে হয়। ওই সময়ই তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কালজয়ী উপন্যাস 'ঘরে বাইরে' অবলম্বনে একটি ছবি নির্মাণের চিন্তা করেন। সে অনুযায়ী চিত্রনাট্যও তৈরি করে ফেলেন। তার ইচ্ছা ছিল উত্তম কুমার সন্দীপের ভূমিকায় অভিনয় করবেন।
কিন্তু উত্তম নাকি বিনয়ের সাথে সত্যজিতের সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। কেননা ইতোমধ্যেই 'সাড়ে ৭৪' (১৯৫৩), 'অগ্নিপরীক্ষা' (১৯৫৪), 'সবার উপরে' (১৯৫৫)-এর মতো বক্স অফিস হিট ছবিতে কাজ করে উত্তম নিজের একটি স্বতন্ত্র ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছিলেন। তার মনে হয়েছিল, এরকম সময়ে সন্দীপের মতো একটি নেতিবাচক চরিত্রে কাজ করলে তার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হতে পারে।
তবে হ্যাঁ, একের পর এক রোমান্টিক ঘরানার ছবিতে অভিনয় করে যখন উত্তম ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন, ওদিকে বিচিত্র সব বিষয়বস্তুর উপর ছবি নির্মাণ করে ক্রমশই নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছিলেন সত্যজিৎ, তখন কিন্তু আবার উত্তম নিজে থেকেই চেয়েছিলেন সত্যজিতের সাথে কাজ করতে। তাই তো একবার সত্যজিতের এক সহকারীকে তিনি বলেছিলেন, "মানিকদাকে (সত্যজিৎ রায়) বলিস রে! চাকরের রোল দিলেও আমি করব। এইসব কাজ আর ভাল লাগছে না!"

১৯৬৬ সালে প্রথম সত্যজিতের সাথে কাজের সুযোগ হয় উত্তমের। মূলত 'নায়ক' ছবির চিত্রনাট্য সত্যজিৎ লিখেছিলেন উত্তম কুমারের কথা ভেবেই। সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের এক অভিনয়-পাগল যুবক ছবিতে নেমে তরতরিয়ে সাফল্যের শিখরে পৌঁছে যাচ্ছে। এই অবস্থায় এই যুবকের মনে কী ধরনের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে, তার মূল্যবোধে কী পরিবর্তন হতে পারে, এ-ই ছিল গল্পের বিষয়।
চিত্রনাট্য শুনে খুবই খুশি হয়েছিলেন উত্তম। এর একটি কারণ হতে পারে এই যে তার ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে কাহিনির সাদৃশ্য। সত্যজিতের ভাষ্যমতে, গল্পের গভীরে প্রবেশ করতে না চাইলেও, বা না পারলেও, তার চরিত্রটি কীভাবে ফুটিয়ে তুলতে হবে সেটি উত্তম মোটামুটি বুঝে নিতে পেরেছিলেন চিত্রনাট্য পড়েই। পাশাপাশি এটি যে গতানুগতিক প্রেমের গল্প নয়, বরং এখানে প্রেমের উপস্থিতি খুবই প্রচ্ছন্ন, আর নায়কের মাঝে দোষ-গুণ উভয়ই বিদ্যমান, এসব বাস্তবতাও উত্তম নিঃসঙ্কোচে মেনে নিয়েছিলেন।
ফলে সত্যজিতের নির্মাণে, উত্তমের অসাধারণ অভিনয়ে 'নায়ক' শেষ পর্যন্ত যা দাঁড়িয়েছিল, তা ছিল আক্ষরিক অর্থেই একটি মাস্টারপিস। অনেকেরই বিশ্বাস, উত্তমের ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া চলচ্চিত্র ছিল এই 'নায়ক'। নিজের ভাবমূর্তি নিয়ে ভাবান্বিত উত্তম, সত্যজিতের ছবিতে একটি ভিন্নধারার চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমেই তার প্রায় সব নিন্দুক-সমালোচকদের মুখ বন্ধ করিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
উত্তমের সাথে কাজ করে দারুণ সন্তুষ্ট ছিলেন সত্যজিতও। ১৯৮০ সালে উত্তমের মৃত্যুর পর তাকে স্মরণ করে সত্যজিৎ লিখেছিলেন, "এটা বলতে পারি যে— উত্তমের সঙ্গে কাজ করে যে তৃপ্তি পেয়েছিলাম, তেমন তৃপ্তি আমার এই পঁচিশ বছরের ফিল্ম জীবনে খুব বেশি পাইনি। উত্তম ছিল যাকে বলে খাঁটি প্রোফেশনাল। রোজকার সংলাপ সে সম্পূর্ণভাবে আয়ত্ত করে কাজে নামত। তার অভিনয় ক্ষমতা ছিল সহজাত। অঙ্গপ্রত্যঙ্গের উপর দখল ছিল ষোলো আনা। ফলে স্বভাবতই তার অভিনয়ে একটা লালিত্য এসে পড়ত। রোজই দিনের শুরুতে সেদিনকার বিশেষ কাজগুলি সম্পর্কে একটা প্রাথমিক আলোচনার পর আমাকে নির্দেশ দিতে হত সামান্যই। সবচেয়ে বড় কথা এই যে, নিছক নির্দেশের বাইরেও সে মাঝে মাঝে কিছু সূক্ষ্ম ডিটেল তার অভিনয়ে যোগ করত যেগুলি সম্পূর্ণ তার নিজস্ব অবদান। এই অলংকরণ কখনই বাড়াবাড়ির পর্যায় পড়ত না; এটা সব সময়েই হত আমার পক্ষে একটা অপ্রত্যাশিত উপরি প্রাপ্তি। বড় অভিনেতার একটা বড় পরিচয় এখানেই।"
উত্তমের সাথে এরপর আরো একটি ছবিতে কাজ করেছিলেন সত্যজিৎ। শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায়ের সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সীকে 'চিড়িয়াখানা' (১৯৬৭) ছবির মাধ্যমেই প্রথম পর্দায় হাজির করেছিলেন তিনি। আর সেখানে ব্যোমকেশ রূপে ছিলেন উত্তম। এই ছবির শুটিং চলাকালীন একবার হার্ট অ্যাটাক করেছিলেন উত্তম। তারপরও এই ছবি, সেই সাথে 'এন্টনী ফিরিঙ্গী' (১৯৬৭)-এর জন্য সে বছর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার খেতাব জিতেছিলেন তিনি। আর সত্যজিতও 'চিড়িয়াখানা'-র সুবাদে হয়েছিলেন শ্রেষ্ঠ পরিচালক।
অর্থাৎ উত্তমের জীবনের সেরা দুইটি কাজের সাথেই ছিল সত্যজিতের সংযোগ। তাই তো উত্তমের ব্যাপারে সত্যজিতের নির্মোহ মূল্যায়ন, "শিল্পীর বিচার সবসময়ই হয় তার শ্রেষ্ঠ কাজের উপর। উত্তমের অভিনয়ের পরিধি যে খুব বিস্তৃত ছিল তা নয়, কিন্তু তার এই নিজস্ব পরিধিতে ক্রমান্বয়ে ত্রিশ বছর ধরে সে যে নিষ্ঠা ও ক্ষমতার পরিচয় দিয়ে গেল, তার তুলনা নেই। তার অভাব পূরণ করার মতো অভিনেতা আজ কোথায়?"
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন